ডলারের দাম বাড়ার চাপ প্রবলভাবে আঘাত করছে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে। বিশেষ করে আমদানিনির্ভর উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে এমন আঘাত দফায় দফায় হানা দিচ্ছে। বাজারদর অনুযায়ী ডলারের দাম প্রায় ৮৫ টাকা নির্ধারণ করে যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল সেসব প্রকল্পে আর্থিক কাঠামো এখন ভেঙে চুরমার। কোনোভাবেই আগের দামে এসব প্রকল্পে বৈদেশিক কেনাকাটা করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ ডলারপ্রতি ২১ টাকা বেড়ে দাম দাঁড়িয়েছে ১০৬ টাকা। ডলারের এ রকম বড় ব্যবধান রেখে প্রকল্পের কাজ সামনে এগোনো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সরকারকে বাধ্য হয়ে এখন দাম সমন্বয় করে প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ বাড়াতে হচ্ছে। এজন্য সরকারকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সূত্র বলছে, ডলারের দাম বাড়ার কারণে সরকারি বেশিরভাগ উন্নয়ন প্রকল্পে শত শত কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে। যেভাবে ব্যয় বাড়াতে হচ্ছে তা শেষ পর্যন্ত কয়েক হাজার কোটি টাকায় ঠেকবে। এ অবস্থায় পরিকল্পনামন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-সচিবরাও এক রকম অসহায়। পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান মঙ্গলবার বলেন, এখন তো করার কিছুই নেই। বাধ্য হয়েই ব্যয় বাড়াতে হচ্ছে। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় জিনিসপত্রের দাম তো বেড়েছে। এখন যদি আমরা ব্যয় সমন্বয় না করি তাহলে প্রকল্পগুলো স্থবির হয়ে থাকবে। ফলে ইতোমধ্যেই যা বিনিয়োগ হয়েছে সেটিও ক্ষতি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে আমরা ডলারের সঙ্গে প্রকল্প ব্যয়ের ব্যবধানটা ভালোভাবে খতিয়ে দেখছি। কতটা দাম বেড়েছে, আর প্রকল্পের ব্যয় কী পরিমাণ বাড়ানোর প্রস্তাব আসছে সেটি ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। তিনি জানান, আগামীতে এ বিষয়ে আরও সতর্ক হতে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যদের নির্দেশনা দিয়েছি। সূত্র জানায়, বড়পুকুরিয়া-বগুড়া-কালিয়াকৈর ৪০০ কেভি লাইন প্রকল্পের ব্যয় অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে ডলারের দাম। কেননা এ প্রকল্পটি যখন প্রথম সংশোধন করা হয় তখন ১ ইউএস ডলার সমান ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। কিন্তু বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির কারণে টাকার মানে বড় ধরনের অবনতি ঘটেছে। এখন ১ ইউএস ডলার সমান ১০৬ টাকা ০৮ পয়সা। ডলারের বিনিময় হার এভাবে বাড়ার কারণে প্রকল্পের দুটি লট মিলে মোট ব্যয় বেড়ছে ৫৭৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। প্রকল্পটির কাজ দুটি প্যাকেজের অধীন ৫টি লটে বিভক্ত। এর মধ্যে বড়পুকুরিয়া-বগুড়া ৪০০ কেভি লাইনের লট-১ এবং বগুড়া-কালিয়াকৈর লাইনের লট-২ এ দাম বাড়ছে বেশি। কারণ এখানে পণ্য ও সেবা আমদানি আওতা বেশি। প্রকল্পটির মোট অনুমোদিত ব্যয় ছিল তিন হাজার ৩২২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের এক হাজার ৪২৪ কোটি ২৬ লাখ, বৈদেশিক ঋণ এক হাজার ৭৪৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা এবং সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন ছিল ১৫৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এরপর প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৫২ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এবার দ্বিতীয় সংশোধনীতে ব্যয় বেড়ে হয়েছে নয় হাজার ৮০৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের দুই হাজার ৮৪০ কোটি ৮৮ লাখ, বৈদেশিক ঋণ ছয় হাজার ২০৮ কোটি ৪৮ লাখ এবং সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন থেকে ৭৫৬ কোটি ৪৬ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে। এদিকে প্রকল্পটির মূল মেয়াদ ছিল ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। এরপর প্রথম সংশোধনীতে মেয়াদ বেড়ে দাঁড়ায় ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু এতেও কাজ শেষ না হওয়ায় দ্বিতীয় সংশোধনীতে দেড় বছর মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে। গত ১৮ জুলাই অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে প্রকল্পটির এ সংশোধনী প্রস্তাবে অনুমোদন দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের সদস্য (সচিব) আব্দুল বাকী বলেন, এখন যেসব প্রকল্পের সংশোধনী প্রস্তাব আসছে সেগুলোর বেশিরভাগ কারণ ডলারের দাম বৃদ্ধি। বিশেষ করে যেসব প্রকল্পের পণ্য ও সেবা বিদেশ থেকে কেনা বা আদমানি করতে হবে সেগুলোর খরচ বাড়ছে। কেননা প্রকল্প যখন অনুমোদন দেওয়া হয় তখন সে সময়ের রেট ধরা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে এখন আগের দর থাকছে না। এজন্য বিভিন্ন প্রকল্পের সংশোধনী প্রস্তাব আসছে। এদিকে মার্কিন ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় হাওড়ে ইকোসিস্টেম বেজড পরিবেশ উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়ছে। তবে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে গতি কম। প্রায় চার বছর পার করলেও বাস্তব অগ্রগতি ৪৮ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি প্রায় আট কোটি ৯৫ লাখ টাকা, যা মূল অনুমোদিত মোট প্রাক্কলিত ব্যয়ের ২০ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এখন নতুন করে মেয়াদও বৃদ্ধি পাচ্ছে সাড়ে ৩ বছর। ‘ইকোসিস্টেম বেজড এপ্রোচেস টু এডাপটেশন (ইবিএ) ইন দি ড্রাউট প্রোন বারিন্দ ট্র্যাক্ট অ্যান্ড হাওড় ওয়েটল্যান্ড এরিয়া’ প্রকল্প সংশোধনী প্রস্তাব এসেছে পরিকল্পনা কমিশনে। প্রথম সংশোধনী প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির ফলে প্রকল্পের ব্যয় ১৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রায় ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সঙ্গে অন্যান্য কারণ যোগ হয়ে প্রকল্পটির সংশোধন প্রয়োজন। এটি নিয়ে গত ১২ জুন অনুষ্ঠিত হয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা। প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২ কোটি ৭২ লাখ ২৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ১ কোটি ৮৭ লাখ ২০ হাজার টাকা এবং প্রকল্প সহায়তা থেকে ৪০ কোটি ৮৫ লাখ ৯ হাজার টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদন দেন পরিকল্পনামন্ত্রী। বর্তমানে আন্তঃখাত সমন্বয়, কিছু অঙ্গের ব্যয় বৃদ্ধি, নতুন অঙ্গ সংযোজন, প্রকল্পের ব্যয় ১৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা অর্থাৎ ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রকল্পের মেয়াদ সাড়ে ৩ বছর বৃদ্ধি করে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া পেট্রোবাংলার অধীন সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেডের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন কৈলাসটিলা-৮ নং কূপ (অনুসন্ধান কূপ) খনন শীর্ষক প্রকল্পেরও ব্যয় বাড়ছে ডলারের দাম বাড়ায়। সম্প্রতি প্রথম সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর অনুষ্ঠিত বিভাগীয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (ডিপিইসি) সভায় এ বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। সংশোধনী প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রকল্পটি যখন অনুমোদন দেওয়া হয় তখন কম রেট ছিল। কিন্তু গত ১৯ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের বিনিময় হার ১ মার্কিন ডলার সমান ১০৭ টাকার সঙ্গে আরও ৫ টাকা যুক্ত করে ডলার বিনিময় হার ধরা হয় ১১২ টাকা। সেই সঙ্গে কূপের গভীরতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে। প্রকল্পটির মূল ব্যয় ছিল ১৫০ কোটি ২৭ লাখ টাকা। এখন ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ১৭৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে বাড়বে ২৬ কোটি এক লাখ টাকা, যা মোট অনুমোদিত ব্যয়ের ১৭ দশমিক ৩১ শতাংশ।