ক্ষমতায় গেলে বর্তমান পুলিশ ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, বিএনপির এমন বিবৃতিতে আস্থা রাখার যৌক্তিক কারণ নেই। অতীতের রেকর্ড বলছে, যে দলই ক্ষমতায় ছিল, তারা পুলিশ ও প্রশাসনকে দলীয়ভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। দলীয় বিবেচনায় পদোন্নতি ও প্রাইজ পোস্টিং দেওয়া হয়। বিপরীতে প্রতিপক্ষ দলের তকমা দিয়ে পদোন্নতিবঞ্চিত করাসহ ওএসডি (বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করে ফেলে রাখা হয়। এমনকি চাকরি থেকে বিদায় করে দেওয়া হয়। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় দীর্ঘদিন থেকে প্রশাসন দলীয়করণের এমন নেতিবাচক চেহারা সবার কাছে স্পষ্ট। বিশেষ করে দুই প্রধান দলের আমলে কী হয়েছে তা ভুক্তভোগী আমলারা ভালো করেই জানেন। ফলে ভোটের আগে প্রশাসন নিরপেক্ষ করতে বিএনপির বিবৃতি তেমন একটা কাজে আসবে না। এমনটিই মনে করেন প্রশাসন এবং পুলিশের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তাদের কয়েকজন। সঙ্গে আলাপকালে বুধবার তারা বলেন, প্রশাসনের মধ্যে অতিমাত্রায় দলবাজি ঢুকে পড়েছে। বিশেষ করে একশ্রেণির সুযোগসন্ধানী আমলারা ব্যক্তিস্বার্থে ক্ষমতাসীন দলকে ব্যবহার করে থাকে। এর ফলে তারা দলীয় কর্মীর মতো আচরণ করে। এছাড়া ক্ষমতাসীন দলগুলো দেশ পরিচালনার একটা পর্যায়ে এসব আমলার ফাঁদে আটকে পড়ে। তখন দেখা যায়, প্রশাসনের ওপর ভর করে দেশ চালাতে গিয়ে নেতাকর্মী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে পুরো দল। এমন অপরাজনীতির সংস্কৃতি চারদিকে জেঁকে বসেছে। ফলে এমন একটা পরিস্থিতিতে প্রশাসন নিরপেক্ষ করতে বিএনপির এই আহ্বান বা ফর্মুলা তেমন একটা কাজে আসবে না। প্রসঙ্গত, প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে মঙ্গলবার রাতে একটি বিবৃতি দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এতে তিনি সততা ও নিরপেক্ষতা বজায় রেখে জনগণের জন্য কাজ করতে তাদের প্রতি আহ্বান জানান। বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, সিভিল প্রশাসন ও পুলিশের কিছুসংখ্যক দুর্নীতি ও দলবাজ কর্মকর্তা অপপ্রচার চালাচ্ছে, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী শাসনামলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুতি, এমনকি জেল-জরিমানার মতো পরিস্থিতির শিকার হতে হবে। তিনি বলেন, ‘এতে বোঝা যাচ্ছে, অনির্বাচিত ও অবৈধ আওয়ামী সরকার জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে এই ষড়যন্ত্র করছে। আমরা সুস্পষ্টভাবে বলছি, জনগণের সমর্থনে বিএনপি দেশ পরিচালনার সুযোগ পেলে প্রজাতন্ত্রের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরির সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে। সরকারি কোনো চাকরিজীবীর বিরুদ্ধে দলীয় বিবেচনায় কিংবা আক্রোশমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। উপরন্তু গত ১৫ বছরে যাদের অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত, বাধ্যতামূলক অবসর, দীর্ঘদিন ওএসডি রাখা এবং পদোন্নতিবঞ্চিত করা হয়েছে, তাদের প্রতিও ন্যায়বিচার করা হবে। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমান বলেন, এ ধরনের বিবৃতির ওপর বর্তমান প্রশাসনের আস্থা রাখার কথা নয়। তারা যতই বলুক ক্ষমতায় এলে কোনো ব্যবস্থা নেবে না, কিন্তু বাস্তবে এটি ঠিক নয়। ক্ষমতায় এলে অবশ্যই কিছু লোকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে এবং দলীয় লোকজনকে সামনে আনবে। বদিউর রহমান বলেন, আমি নিজেও চারবার সচিব পদে প্রমোশন বঞ্চিত হয়েছি। তিনি বলেন-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান এবং এরশাদের আমলেও প্রশাসনে কোনো দলীয়করণ ছিল না। কিন্তু ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার ক্ষমতায় আসার পর এটি শুরু হয়। এরপর থেকে চালু হয় ‘মনা’ সংস্কৃতি। অর্থাৎ প্রশাসনে কে বিএনপিমনা এবং কে আওয়ামীমনা সেটি বিবেচনায় আসে। বদিউর রহমান আরও বলেন, এই দুই দলই আমলাতন্ত্র এবং পুলিশ প্রশাসনকে শেষ করে দিয়েছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেও বেছে বেছে দলীয় লোকজনকে পদোন্নতি দেয়। অর্থাৎ ন্যায়ভিত্তিক শাসন আর হয়নি। বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে নামাতে এক সময় জনতার মঞ্চ তৈরি হয়। সেখানে ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরের নেতৃত্বে আমলাদের একটি দল সেখানে গিয়ে যোগ দেয়। ফলে সবকিছু মিলে মনে হচ্ছে এই সংস্কৃতি পরিবর্তন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ বর্তমান সরকার পরিবর্তন হলেও নতুনরা এসে বেশ কিছু লোকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। তার মতে, আমলাদের সুবিধা দিতে আওয়ামী লীগ সিনিয়র সচিব পদ সৃষ্টি করেছে। এছাড়া মুখ্য সচিব বানিয়েছে তারা। এগুলো অযৌক্তিক। কোনো দরকার ছিল না। এর সবকিছুই সরকারের পক্ষ থেকে প্রশাসনের জন্য ঘুস। বদিউর রহমান বলেন-প্রশাসনকে বিএনপির দরকার ভুয়া ভোটার তৈরি করতে এবং আওয়ামী লীগের দরকার রাতের ভোট নিশ্চিত করতে। ফলে কোনো সরকারই তাদের চরিত্র বদলাবে বলে মনে হয় না। সাবেক সচিব এবং অ্যাডমিনিস্ট্রিটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আবু আলম শহিদ খান বলেন, ‘বিএনপির বিবৃতি প্রশাসনে কী প্রভাব ফেলবে সে বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। তবে এটা বলতে পারি, সব সরকারের আমলে সরকারি কর্মচারীদের আইন ও সংবিধান মেনে কাজ করতে হবে। এটা না করলে বিএনপি কেন, দেশের যে কোনো নাগরিক তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারবে এবং আদালতে যেতে পারবে।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমানে যে ধরনের আস্থাহীনতার রাজনীতি বিরাজ করছে তার প্রভাব পড়েছে সবখানে। সরকারি কর্মচারীদের মধ্যেও কেউ কেউ দলীয় কর্মীর মতো আচরণ করেন, যা আচরণবিধি ও সংবিধানপরিপন্থি। কিন্তু তাদের মনে রাখা উচিত, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় ভরণপোষণ হয়। সরকারি কর্মচারী হয়ে তারা কোনোভাবে দলীয় কর্মীর মতো আচরণ করতে পারে না। ফলে এমন আচরণ যারা করছেন এবং যাদের কারণে জনস্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভবিষ্যতে সরকার পরিবর্তন হলে তাদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। বিএনপির বিবৃতি তখন কোনো কাজে আসবে না। এটাই চিরসত্য।’ জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক বলেন, যে সরকারই ক্ষমতায় আসে, তারা পুলিশকে তাদের মতো ব্যবহার করতে চায়। তাদের ইচ্ছা অনুসারে কাজ করতে বাধ্য করে। এটি রাজনৈতিক কিংবা সামরিক যে সরকারই হোক পুলিশকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে আচরণে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। অর্থাৎ এটি বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে সরকার পরিবর্তন হলে কিছু লোককে ভিকটিম (ক্ষতির শিকার) হতেই হয়। তিনি বলেন, ‘বিএনপি বিবৃতিতে বলেছে, তারা নিরপেক্ষ থাকবে। কিন্তু এর আগে বিভিন্ন সময়ে তারা হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছে। তাদের নেতারা বলেছে, পালানোর পথ পাবেন না। ফলে এই বিবৃতিতে প্রশাসন ও পুলিশের লোকজন আস্থা রাখবে না। তিনি বলেন, ‘আস্থা না রাখার আরেকটি কারণ হলো-পেছনে আপনারা কী করেছেন, সেটি বিবেচনায় নেওয়া হয়।’