জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বেসরকারি পর্যবেক্ষক হিসাবে নিবন্ধন দেওয়ার লক্ষ্যে ৯৪টি সংস্থার (এনজিও) প্রাথমিক তালিকা তৈরি করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়। এর ৪২টির বিরুদ্ধেই রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা, মানব পাচার, চেক জালিয়াতি, মানবাধিকারকর্মী নামে প্রতারণাসহ বিভিন্ন ধরনের তথ্য রয়েছে। এমনকি মানব পাচারের অভিযোগে মার্কিন দূতাবাসের করা মামলার আসামিদের সংস্থাও আছে ইসির এ তালিকায়। ১৮-২০টি সংস্থার প্রধান, নির্বাহী প্রধান বা পরিচালকরা আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এগুলোকে ‘রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক সংস্থা’ বলে মনে করছেন ইসির কয়েকজন কর্মকর্তা। শুধু তাই নয়, নির্বাচন কমিশনে পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসাবে নিবন্ধন রয়েছে এমন ১৬টির বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ রয়েছে। দুটি গোয়েন্দা সংস্থা পৃথক গোপন প্রতিবেদনে এসব তথ্য নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, যেসব সংস্থা নিবন্ধন পাবে সেগুলোই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে পারবে। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে কিনা এবং নির্বাচনে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল না-ভোটের পর নিরপেক্ষভাবে সেই প্রতিবেদন দেবে পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো। ওই প্রতিবেদন নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতার অনেক মাপকাঠির একটি হিসাবে ধরা হয়। যেসব সংস্থা এসব প্রতিবেদন দেবে তাদের বিরুদ্ধে পক্ষপাত ও বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ থাকলে, তাদের প্রতিবেদন কতটা গ্রহণযোগ্য হবে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তারা। পর্যবেক্ষক সংস্থার বিষয়ে বিভিন্ন আপত্তি নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন ইসি পেয়েছে কিনা জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম বলেন, গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য গোপনীয়। গোপনীয় বিষয় গোপন থাকাই উত্তম। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কমিশন সভায় এ নিয়ে আলোচনার আগে এ বিষয়ে মন্তব্য করা উচিত হবে না। এটুকু বলতে পারি, পর্যবেক্ষক সংস্থা নিবন্ধন দেওয়ার কার্যক্রম চলছে। আশা করছি, আগস্টের মধ্যে নিবন্ধন দেওয়ার কাজ শেষ করতে পারব। নির্বাচনের কর্মপরিকল্পনায় পর্যবেক্ষক নিবন্ধনের সময় আগস্ট পর্যন্ত দেওয়া আছে। ইসি সূত্র জানায়, ‘নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নীতিমালা-২০১৭’ অনুযায়ী পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসাবে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন পেতে মোটা দাগে যেসব শর্ত রয়েছে সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে, ওই সংস্থার প্রধান নির্বাহী, পরিচালনা পর্ষদ বা ব্যবস্থাপনা কমিটির কোনো সদস্য রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকতে পারবেন না। গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে এবং যাদের গঠনতন্ত্রে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিষয়ে নাগরিকদের উদ্বুদ্ধ করার অঙ্গীকার রয়েছে তারাই নিবন্ধন পাওয়ার যোগ্য হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য নিবন্ধন চেয়ে নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছে ২০৬টি বেসরকারি সংস্থা। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক বাছাইয়ে টিকেছে ৯৪টি। ওই ৯৪টি সংস্থার বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে প্রতিবেদন দিয়েছে সরকারের দুটি গোয়েন্দা সংস্থা। একটি সংস্থা ১১টি ও আরেকটি সংস্থা ৩৬টির বিষয়ে তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছে। পাঁচটি পর্যবেক্ষক সংস্থার বিষয়ে দুটি গোয়েন্দা সংস্থাই একই ধরনের তথ্য দিয়েছে। এ হিসাবে ৪২টি সংস্থার বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দিল গোয়েন্দা সংস্থা দুটি। আরও জানা গেছে, নির্বাচন কমিশনে বর্তমানে নিবন্ধিত পর্যবেক্ষক সংস্থা রয়েছে ১১৮টি। পাঁচ বছরের জন্য পর্যবেক্ষক সংস্থা নিবন্ধন দেওয়া হয়। এই ১১৮টি পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধনের মেয়াদ ১১ জুলাই শেষ হয়েছে। রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা : জানা গেছে, ১৮-২০টি সংস্থার পরিচালনা পর্ষদের এক বা একাধিক সদস্য রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এর বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা। এছাড়াও রয়েছে বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। যেসব সংস্থার পরিচালনা পর্ষদের এক বা একাধিক সদস্য রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত সেগুলো হচ্ছে-বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর ইনটেনসিভ ডেভেলপমেন্ট (বিডিএআইডি), শিশু প্রতিভা বিকাশ কেন্দ্র (এসপিবিকে), নজরুল স্মৃতি সংসদ (এসএসএস) ও প্রত্যয় সোশ্যাল ফাউন্ডেশন। এ তালিকায় আরও রয়েছে, গ্রাসরুট কো-অপারেশন, এসো সমাজ গড়ি, সলংগা প্রতিবন্ধী নারী উন্নয়ন সংস্থা, মানবাধিকার ও সমাজ উন্নয়ন সংস্থা (মওসুস) ও ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশন অব কোস্টাল এরিয়াস পিপল (ডোক্যাপ)। এছাড়াও আছে, সেবা ফাউন্ডেশন, এসডাপ, প্রোগ্রাম ফর ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট (পেসড), রুরাল অরগানাইজেশন ফর অরিয়েন্টেশন অ্যান্ড টেকনিক্যাল সাপোর্টস (রুটস), ইন্টারন্যাশনাল আসফ লিগ্যাল এইড ফাউন্ডেশন, সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন, ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম, ডেমোক্রেসি ওয়াচ, মানব উন্নয়ন কেন্দ্র (মউক) ও রুরাল ভিশন (আরভি)। আরও জানা গেছে, নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক বাছাইয়ের ৯২ নম্বর তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর ইনটেনসিভ ডেভেলপমেন্ট (বিডিএইড)। এ সংস্থাটির চেয়ারম্যান বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ। বর্তমানে তিনি যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ সংস্থাটির জেনারেল সেক্রেটারি মোহাম্মাদ ইমরান খান ও ভাইস চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান লিমনসহ অন্য পদধারীদের প্রায় সবাই ছাত্রলীগের বিভিন্ন পদে ছিলেন। বর্তমানে তারা সরকারি দলের রাজনীতিতেও সক্রিয়। এ বিষয়ে কয়েকবার যোগাযোগ করেও সাইফুর রহমান সোহাগের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ইসির ৭৬ নম্বর তালিকায় থাকা নজরুল স্মৃতি সংসদের (এসএসএস) সহসভাপতি অশোক কুমার মজুমদার বরগুনার আমতলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। ইসির তালিকায় ৭৫ নম্বরে থাকা প্রত্যয় সোশ্যাল ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মো. নেছারুল ইসলাম নাজমুল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সিনিয়র সহসভাপতি ছিলেন। ওই সময়ে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর মামলায় ২০১০ সালের পহেলা ডিসেম্বর গ্রেফতারও হন। তালিকার ৬৭ নম্বর পর্যবেক্ষক সংস্থা এসো সমাজ গড়ির নির্বাহী প্রধান মো. আসলাম খান নড়াইল পৌর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। এ সংস্থার সদস্য আফরোজা খানম নড়াইল পৌর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ছিলেন। নির্বাচন কমিশনের তালিকার ৬৩ নম্বরে থাকা মানবাধিকার ও সমাজ উন্নয়ন সংস্থা-মওসুসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট ড. গোলাম রহমান জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতে সক্রিয়। সম্প্রতি তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে আটকও হন। ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশন অব কোস্টাল এরিয়াস পিপল (ডোক্যাপ), রুরাল অরগানাইজেশন ফর অরিয়েন্টেশন অ্যান্ড টেকনিক্যাল সাপোর্টস (রুটস), ডেমোক্রেসি ওয়াচ, মানব উন্নয়ন কেন্দ্রসহ (মউক) কয়েকটি সংস্থার পদধারীদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা রয়েছে। ফৌজদারি অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের সংস্থা : বেশ কয়েকটি সংস্থার পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের ফৌজদারি অপরাধে যুক্তের তথ্য রয়েছে। এর একটি হচ্ছে-আইন ও মানবাধিকার সুরক্ষা ফাউন্ডেশন। ইসির বাছাই তালিকার ৯ নম্বরে থাকা এ সংস্থার চেয়ারম্যান, নির্বাহী পরিচালকসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মানব পাচার ও প্রতারণার অভিযোগে ২৭ মে গুলশান থানায় মামলা করেছে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। ওই মামলায় তারা গ্রেফতারও হয়েছেন। ইসির তালিকার ১৩ নম্বরে থাকা সংস্থা বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের নির্বাহী প্রধান ড. সাইফুল ইসলাম দিলদারের বিরুদ্ধেও প্রতারণা মামলা রয়েছে। তেজগাঁও থানায় হওয়া একটি মামলায় এ সংস্থার মহাসচিবসহ সাতজন গ্রেফতার হন। একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে আরেক পর্যবেক্ষক সংস্থা ডেভেলপমেন্ট ফর ডিজাইবল্ড চিল্ডেন অ্যান্ড ওমেন নামক সংস্থার বিরুদ্ধে। এ সংস্থার নির্বাহী পরিচালকসহ সদস্যদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার কর্মকর্তা সাজিয়ে বিদেশে মানব পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের অভিযোগ আছে আজমপুর শ্রমজীবী উন্নয়ন সংস্থা (আসাস), অক্ষয় প্রতিবন্ধী সমাজকল্যাণ সমিতি, একটিভিটি ফর রিফরমেশন অব বেসিক নিডস, আরবানসহ কয়েকটি সংস্থার বিরুদ্ধেও। এছাড়া আব্দুল মোমেন খান মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন, বিবি আছিয়া ফাউন্ডেশন, জাতীয় প্রতিবন্ধী যুব ফোরামসহ কয়েকটি সংস্থার কার্যালয়ের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।