জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের (জাগৃক) উচ্চমান সহকারী দেলোয়ার হোসেনকে সার্টিফিকেট (সনদ) জালিয়াতি করে সরকারি চাকরিতে ঢোকার অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছে। মঙ্গলবার সনদ জালিয়াতির অভিযোগের শুনানিতে অংশ নিতে এলে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে করা মামলায় তাকে গ্রেফতার করে শাহবাগ থানা পুলিশ। তার বিরুদ্ধে প্রতারণা, জালিয়াতি, ফাইল গায়েব, প্লট ও ফ্ল্যাট মালিকদের হয়রানির শত শত অভিযোগ রয়েছে। তিনি বিগত ১৬ বছরে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দীন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আমি সচিব হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকে জাগৃক’র উচ্চমান সহকারী দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও অবৈধ সম্পদ আর্জনের শত শত অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়গুলোর ওপর তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জাগৃক’র চেয়ারম্যানকে পাঠিয়ে দিয়েছি। এমন কি দুর্নীতি দমন অভিযোগগুলো দুদকেও পাঠিয়েছি। কিন্তু কিছুতেই তার দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছিল না। এরপর অন্যান্য অভিযোগের সঙ্গে একটি অভিযোগ আসে তার এইচএসসির সনদ জাল। তার সনদ জালিয়াতির বিষয়টি তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ শুরু করি। তদন্ত কর্মকর্তা উপসচিব দেবময় দেওয়ানাকে দেলোয়ার হোসেন কুমিল্লা যে কলেজ থেকে পাশ করেছে, সেই কলেজে তথ্য সংগ্রহের জন্য পাঠাই। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ কোনো তথ্য দিতে অস্বীকার করে। এরপর তদন্ত কর্মকর্তাকে কুমিল্লা বোর্ডে পাঠানো হলে বোর্ড কর্তৃপক্ষও কোনো তথ্য দিতে প্রথমে অস্বীকার করে। পরে অনেক বলাবলির পর বোর্ড থেকে লিখিত আকারে জানানো হয়, দেলোয়ার হোসেনের পিতার নাম শিশু মিয়া। ওই সনদটির প্রকৃত মালিক এই দেলোয়ার হোসেন নন। পরে আমরা তার বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিই। সচিব আরও বলেন, তার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের অভিযোগের কোনো শেষ নেই। জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের ভূমি ব্যবস্থাপনা যাবতীয় কাজ দেলোয়ার একক ভাবে করত। তাকে খুশি না করলে সেখানে সেবা পাওয়া সম্ভব ছিল না। সে জাগৃক থেকে বরাদ্দ পাওয়া সব প্লট ও ফ্ল্যাট মালিকদের জিম্মি করে ফেলেছে। যে প্লট কিংবা ফ্ল্যাট মালিক তাকে খুশি করত না তার ফাইল সে গায়েব করে ফেলত। সে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। জাগৃক কিংবা রাজউকে সেবা নিয়ে সাধারণ মানুষকে যারা হয়রানি করবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, দেলোয়ার হোসেন মঙ্গলবার সচিবালয়ে এসে তদন্ত কর্মকর্তা উপসচিব দেবময় দেওয়ানকে তার পক্ষে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। তদন্ত কর্মকর্তা দেলোয়ারকে চলে যেতে বলেন। তখন দেলোয়ার হোসেন তদন্ত কর্মকর্তাকে মোটা অঙ্কের ঘুস দিতে চান। তদন্ত কর্মকর্তা বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করলে তাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেওয়া হয়। মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, পদে ছোট হলেও জাগৃক’র প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির চেয়ারম্যানের মতো ক্ষমতাবান হিসাবে পরিচিত দেলোয়ার হোসেন। গৃহায়ণ ভবনে বিশাল আকারের রুমে বসে রাজধানীসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ এলাকার প্লট ও ফ্ল্যাটের সব কাজ করেন দেলোয়ার। তবে তাকে সম্প্রতি রাজশাহীতে বদলি করা হয়। নিজে উচ্চমান সহকারী হলেও নিজের দাপ্তরিক কাজ করতে তার রয়েছে একাধিক লোক। নিজ নামের পাশাপাশি স্ত্রী, মা ও শ্যালকের নামে সংস্থাটি থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন কমপক্ষে ১০টি প্লট ও ফ্ল্যাট। মোহাম্মদপুর-ধানমন্ডি এলাকায় নিজের কব্জায় নিয়ে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়েছেন একাধিক প্লট। এভাবে নানা অনিয়মের মাধ্যমে রাতারাতি হয়ে উঠেছেন শত শত কোটি টাকার মালিক। ২০১৭ সালের শেষ দিকে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে জাগৃক’র কর্মচারী ইউনিয়নের (সিবিএ) সাধারণ সম্পাদকের পদটিও দখলে নেন তিনি। জাগৃক’র সাবেক চেয়ারম্যান খন্দকার আখতারুজ্জামান ও বিদায়ি চেয়ারম্যান মো. রাশিদুল ইসলামকে ব্যবহার করে বিধিবহির্ভূতভাবে ক্যাশিয়ার থেকে পদ বদলে হয়েছেন উচ্চমান সহকারী। জাগৃক’র পাম্প অপারেটর আব্দুল ওয়াহিদের ছেলে দেলোয়ার এখন সংস্থাটির অঘোষিত সম্রাট। পুনর্বাসন প্লট, পদোন্নতি, বদলি, নামজারি, বিক্রয় অনুমতি-সবই এখন দেলোয়ার সিন্ডিকেটের হাতে। দেলোয়ার সিবিএ’র সাধারণ সম্পাদকের পদ পাওয়ার পরই হয়ে ওঠেন বেশি বেপরোয়া। জাগৃক’র বিভিন্ন এলাকার নামজারি, হস্তান্তর, আম-মোক্তার নিয়োগ, বিক্রয় অনুমতি ও বন্ধক অনুমতি নিতে সরকারের এ সংস্থার দ্বারস্থ হতে হয়। এসব কাজের জন্য গুনতে হয় স্থানভেদে ৫০ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা। আর এসব কিছু দীর্ঘদিন একচ্ছত্রভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন দেলোয়ার। যদিও দেলোয়ার নিজে কোনো কাজই করেন না। তার কাজ করার জন্য দুই-তিনজন ব্যক্তিগত সহকারী রেখেছেন। যারা জাগৃক’র নিয়মিত কর্মচারী নন। তারা উদোর হিসাবে কাজ করছেন। জাগৃক’র খুলনা বয়রা এস্টেটের আবাসিক প্লট প্রকল্প থেকে এ ব্লকের ৩ কাঠা আয়তনের একটি প্লট (নং-৪৫) দেলোয়ারের স্ত্রী নুসরাত জাহান পপির নামে বরাদ্দ নেওয়া। প্লট বরাদ্দ পাওয়ার পর ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর জাগৃক’র অনুকূলে একসঙ্গে চার কিস্তির ১৯ লাখ ৯৮ হাজার ৭৫০ টাকা পরিশোধ করা হয়। দেলোয়ারের স্ত্রী গৃহিণী হলেও প্লট নিয়েছেন শিল্পী-সাহিত্যিক ক্যাটাগরিতে। ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে অর্ধকোটি টাকা মূল্যের এ প্লটটি হাতিয়ে নেয় সে। সূত্র জানায়, নুসরাত জাহান পপির ৮-৯ বছর আগে বিয়ে হয় দেলোয়ারের সঙ্গে। নুসরাতের নামে তখন তেমন কোনো সম্পদ ছিল না। কয়েক বছরের ব্যবধানে তার নামে ঢাকায় একাধিক বাড়ি, প্লট ও ঢাকার বাইরে জাগৃক’র প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন দেলোয়ার। সরকারিভাবে নেওয়া এসব প্লটের বিপরীতে কয়েক কোটি টাকা কিস্তিও পরিশোধ করা হয়েছে। কুষ্টিয়া, খুলনা এবং ঢাকার মোহাম্মদপুর ও লালমাটিয়া এলাকায় রয়েছে এসব প্লট-ফ্ল্যাট। এছাড়া দেলোয়ার তার শ্বশুর মুহাম্মদ শাহজাহানকে দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরে বিপুল পরিমাণ সম্পদ কিনেছেন। কর্মকর্তারা জানান, মায়ের নামে জাগৃক’র টাঙ্গাইলের একটি আবাসিক প্রকল্প থেকে একটি প্লট নিয়েছেন দেলোয়ার। এছাড়া কুষ্টিয়া হাউজিং এস্টেট থেকে নিজ নামে সাড়ে তিন কাঠার প্লট, ৪/৫ লালমাটিয়ায় ফ্ল্যাট, মোহাম্মদপুরে বিটিআই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির এ ব্লকের ৭/১ প্লটের ভবনে একটি ফ্ল্যাট, মোহাম্মদপুরের জাকির হোসেন রোডের ১/১৫ ব্লক-ই ফ্ল্যাট, প্লট এফ-৪ একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন তিনি।