স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংস্থার চেয়ারম্যান, নির্বাহী প্রধান বা পরিচালকদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার তথ্য জানার পরও তা আমলে নিচ্ছে না নির্বাচন কমিশন (ইসি)। রাজনীতি সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানের নাম বহাল রেখেই আগামীকাল বৃহস্পতিবার খসড়া তালিকা প্রকাশে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। এ তালিকায় কমবেশি ৮০টি সংস্থার নাম ঠাঁই পেতে যাচ্ছে। খসড়া তালিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে এসব পর্যবেক্ষক সংস্থা নিবন্ধন পাওয়ার ক্ষেত্রে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে। যদিও নির্বাচন কমিশনের ‘স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের নীতিমালা’ অনুযায়ী রাজনীতি সম্পৃক্তদের সংস্থাকে পর্যবেক্ষক হিসাবে নিবন্ধন না দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। তবে যেসব সংস্থার প্রধান ও পরিচালকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধে মামলা রয়েছে সেগুলোকে এ তালিকায় রাখা হবে না। মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশনের অনির্ধারিত এক বৈঠকে নীতিগত এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইসি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এ সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা হিসাবে ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এবার পর্যবেক্ষণ করতে আগ্রহী সংস্থার সংখ্যা কম। রাজনীতি সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠান বাদ দিলে এ সংখ্যা অনেক কমে যাবে। এ কারণে সেগুলোকে রেখেই খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হবে। ওই তালিকার ওপর সেগুলোর ওপর অভিযোগ বা আপত্তি জমা দেওয়ার সুযোগ দিয়ে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। কোনো সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়লে সেগুলো শুনানি করে নিবন্ধন চূড়ান্ত করা হবে। এ প্রক্রিয়ায় কয়েকটি সংস্থার নাম বাদ পড়তে পারে। সার্বিকভাবে স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংস্থা কমে যাওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। তারা আরও জানান, বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। এদিকে রাজনৈতিক সম্পৃক্তদের প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধন দেওয়া হলে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্য ভণ্ডুল হয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, নির্বাচন সঠিক হলো কিনা-তা নিরপেক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করতেই পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন দিয়ে আসছে নির্বাচন কমিশন। দলীয় সংশ্লিষ্টদের প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন পেলে তারা নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন না। উলটো তাদের প্রতিবেদন পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে। এর ফলে নির্বাচন আরও বিতর্কিত হবে। জানা গেছে, নির্বাচন ভবনে মঙ্গলবার বিকালে কমিশনের অনির্ধারিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল, নির্বাচন কমিশনাররা, ইসি সচিব, অতিরিক্ত সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে পর্যবেক্ষক সংস্থার তালিকা বৃহস্পতিবার প্রকাশের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, নির্বাচন কমিশনের কিছু কার্যক্রম পর্যালোচনা করতে কমিশন বসেছিল। আমাদের নিজস্ব কিছু বিষয় নিয়ে সেখানে আলোচনা হয়েছে। পর্যবেক্ষক সংস্থার খসড়া তালিকা প্রকাশের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিবন্ধন পেতে আবেদন করা পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করছি। যাচাই-বাছাই শেষে খসড়া তালিকা গণবিজ্ঞপ্তি আকারে পত্রিকায় প্রকাশ করা হবে। এ কার্যক্রম শেষ করতে আমাদের হাতে এখনো সময় আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য নিবন্ধন চেয়ে নির্বাচন কমিশনে ২০৬টি বেসরকারি সংস্থা আবেদন করে। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক বাছাইয়ে টিকেছে ৯৪টি। ওই ৯৪টি সংস্থার বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে প্রতিবেদন দিয়েছে সরকারের দুটি গোয়েন্দা সংস্থা। একটি সংস্থা ১১টি ও আরেকটি সংস্থা ৩৬টির বিষয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ জানিয়েছে। দুই গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে মোট ১৮-২০টি পর্যবেক্ষক সংস্থার প্রধান ও পরিচালকদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কথা উঠে এসেছে। গতকাল কমিশনের অনির্ধারিত সভায় ওই প্রতিবেদন দুটি উপস্থাপন করা হয়। ইসি সচিবালয় বৈঠকে জানায়, রাজনীতি সম্পৃক্তদের সংস্থা বাদ দেওয়া হলে এবার খুব কমসংখ্যক পর্যবেক্ষক সংস্থা নিবন্ধন পাবে। সর্বশেষ গত কমিশন ১১৮টির নিবন্ধন দিয়েছিল। কমিশন প্রতিটি সংস্থার প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে এবং যেসব পর্যবেক্ষক সংস্থার কার্যালয়ের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি সেগুলোকে বাদ দিয়ে বাকিদের নামের তালিকা তৈরির জন্য ইসি সচিবালয়কে নির্দেশনা দিয়েছে। বৃহস্পতিবার ওই তালিকা অনুমোদন দিয়ে সেদিনই গণবিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশের জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত দিয়েছে। যেসব সংস্থার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ : পাঁচটি সংস্থার বিরুদ্ধে গুরুতর ফৌজদারি অপরাধের তথ্য পেয়েছে নির্বাচন কমিশন। সংস্থাগুলো হচ্ছে-আইন ও মানবাধিকার সুরক্ষা ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন, ডেভেলপমেন্ট ফর ডিজাইবল্ড চিল্ড্রেন অ্যান্ড ওমেন, আজমপুর শ্রমজীবী উন্নয়ন সংস্থা (আসাস) ও অক্ষয় প্রতিবন্ধী সমাজকল্যাণ সমিতি। আইন ও মানবাধিকার সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান, নির্বাহী পরিচালকসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মানব পাচার ও প্রতারণার অভিযোগে গত ২৭ মে গুলশান থানায় মামলা দায়ের করেছে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস। ওই মামলায় তারা গ্রেফতারও হয়েছেন। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের নির্বাহী প্রধান ড. সাইফুল ইসলাম দিলদারের বিরুদ্ধেও প্রতারণা মামলা রয়েছে। তেজগাঁও থানায় দায়ের হওয়া একটি মামলায় এ সংস্থার মহাসচিবসহ সাতজন গ্রেফতার হন। একইভাবে অন্যদের বিরুদ্ধেও গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। ১৮-২০টি সংস্থার রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা : জানা গেছে, ইসির প্রাথমিক তালিকায় থাকা ১৮-২০টি সংস্থার পরিচালনা পর্ষদের এক বা একাধিক সদস্য রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। যাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা। এছাড়া বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই দুই প্রতিবেদনে যেসব সংস্থার পরিচালনা পর্ষদের এক বা একাধিক সদস্য রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে-বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর ইনটেনসিভ ডেভেলপমেন্ট (বিডিএআইডি), শিশু প্রতিভা বিকাশ কেন্দ্র (এসপিবিকে), নজরুল স্মৃতি সংসদ (এসএসএস) ও প্রত্যয় সোশ্যাল ফাউন্ডেশন। এ তালিকায় আরও রয়েছে গ্রাসরুট কো-অপারেশন, এসো সমাজ গড়ি, সলংগা প্রতিবন্ধী নারী উন্নয়ন সংস্থা, মানবাধিকার ও সমাজ উন্নয়ন সংস্থা (মওসুস) ও ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অব কোস্টাল এরিয়াস পিপল (ডোক্যাপ)। এছাড়া আছে সেবা ফাউন্ডেশন, এসডাপ, প্রোগ্রাম ফর ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট (পেসড), রুরাল অর্গানাইজেশন ফর অরিয়েন্টেশন অ্যান্ড টেকনিক্যাল সাপোর্টস (রুটস), ইন্টারন্যাশনাল আসফ লিগ্যাল এইড ফাউন্ডেশন, সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন, ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম, ডেমেক্রেসি ওয়াচ, মানব উন্নয়ন কেন্দ্র (মউক) ও রুরাল ভিশন (আরভি)।