গাড়ি কেনা, ব্যবহার ও জ্বালানি ব্যয়-এই তিন খাতের কোনো কিছুতেই নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। অর্থব্যয়ে কৃচ্ছ সাধনে সরকার যে পরিপত্র জারি করেছে, সেটি অনুসরণ করছে না সংস্থাটি। শুধু তাই নয়, কয়েকটি প্রকল্প শেষ হলেও সেগুলোর আওতায় কেনা গাড়ি সরকারের পরিবহণ পুলে জমা হয়নি। আবার সরকারি খাতে জমা দেওয়া হয়নি পুরোনো গাড়ি বিক্রির টাকা। গাড়ির জ্বালানি ব্যয়ের ক্ষেত্রেও উপেক্ষিত হচ্ছে সরকারের নির্দেশনা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এবং অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা যায়, সর্বশেষ একটি জিপ কেনার ক্ষেত্রে নিয়ম ভাঙার নতুন নজির সৃষ্টি করেছে বিআইডব্লিউটিএ। সম্প্রতি মিৎসুবিসি পাজেরো স্পোর্টস মডেলের সাদা রঙের একটি জিপ গাড়ি প্রায় ১ কোটি ৪৬ লাখ টাকা ব্যয়ে সরকারের আরেক প্রতিষ্ঠান প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে কিনেছে বিআইডব্লিউটিএ। অথচ সংস্থাটির ‘সংগঠন ও সরঞ্জামাদির তালিকা (টিওঅ্যান্ডই)’-তে জিপ কেনার কোটা খালি নেই। ওই তথ্য গোপন করে এ গাড়ি কেনার নথি উপস্থাপন ও অনুমোদন নেন বিআইডব্লিউটিএ-এর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কেনার পর থেকে গাড়িটি নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তফা কামালের ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, এর আগে নিয়মের লঙ্ঘন করে ২০২০ সালে দুটি জিপ কিনেছিল বিআইডব্লিউটিএ। ওই দুটি জিপ এখনো সংগঠন ও সরঞ্জামাদির তালিকাভুক্ত করেনি। তালিকার বাইরে গাড়ি দুটি ব্যবহার করা হচ্ছে। সংগঠন ও সরঞ্জামাদির তালিকায় নেই-এমন আরও ১৯টি গাড়ি রয়েছে সংস্থাটির যানবাহন পুলে। ওই ১৯টি গাড়ি বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় কেনা হয়। কয়েকটি প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও সেগুলোর আওতায় কেনা গাড়ি সরকারের পরিবহণ পুলে জমা দেয়নি। জ্বালানি ব্যয়েও একই অবস্থা। গাড়ির জ্বালানি খাতে গত অর্থবছরে এ সংস্থার বরাদ্দ ছিল ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। কৃচ্ছ সাধনে সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে ব্যয় করা হয়েছে ২ কোটি ৬৫ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। এছাড়া ২০২০ সালে একটি কার (নম্বর ঢাকা মেট্রো ক ০৩-১০২১) ১ লাখ ২ হাজার ৮০০ টাকায় এবং একটি পিকআপ (ঢাকা মেট্রো ঠ ১১-৫৫৬৯) মাত্র ৩০ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। ওই টাকা এখনো সরকারের ফান্ডে জমা দেননি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এসব অনিয়মের বিষয়ে জানতে রোববার বিআইডব্লিউটিএতে গিয়ে সংস্থাটির চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফাকে পাওয়া যায়নি। নতুন গাড়ি কেনার অনুমোদন প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকা সংস্থাটির তিনজন সদস্যের দুজনের সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। তারা দুজনই নিয়ম মেনে গাড়ি কেনা হয়েছে বলে জানান। তাদের একজন সদস্য (পরিকল্পনা ও পরিচালন) মোহাম্মদ মনোয়ার উজ জামান বলেন, আমার জানামতে ‘সংগঠন ও সরঞ্জামাদির তালিকা’র একটি গাড়ি বিক্রি করে নতুন গাড়িটি কেনা হয়েছে। কিন্তু ওই তালিকায় কোনো জিপ গাড়ি থাকার পরও এর তথ্য গোপন করা হয়েছে কি না, সেটি আমি বলতে পারব না। যারা নথি (যানবাহন পুলের কর্মকর্তা) উপস্থাপন করেছেন তারা বলতে পারবেন। সংস্থাটির আরেক সদস্য (অর্থ) মো. সেলিম ফকির বলেন, ‘সংগঠন ও সরঞ্জামাদির তালিকা’য় ১৬টি জিপ গাড়ির সংস্থান আছে। পুরোনো একটি গাড়ির প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। ‘সংগঠন ও সরঞ্জামাদির তালিকা’য় একটি গাড়ির তথ্য গোপন করে নতুন গাড়ি কেনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি তাৎক্ষণিক উপপরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম ভূঁঞাকে তার রুমে ডেকে পাঠান। একটি গাড়ির তথ্য গোপন করে নথি উপস্থাপনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিভিন্ন ধরনের তথ্য দেন ওই কর্মকর্তা। একপর্যায়ে তাকে সঠিক তথ্য উপস্থাপনের নির্দেশ দেন। এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, তথ্য গোপন করে গাড়ি কেনা হলে সেটি নিয়মের ব্যত্যয় হবে। সরেজমিন দেখা যায়, বিআইডব্লিউটিএ-এর নতুন কেনা গাড়িতে এখনো বিআরটিএ-এর রেজিস্ট্রেশন নম্বর লাগানো হয়নি। গ্যারেজ নম্বর হিসাবে পরিচিত ‘ঢাকা ১৪৮/ম’ লেখা রয়েছে। এ গাড়িতে চড়ে রোববার রাজধানীর বাংলামোটরে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ করপোরেশনের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন নৌসচিব মো. মোস্তফা কামাল। অনুষ্ঠান শেষে ওই গাড়িতেই ফিরে যান তিনি। বিআইডব্লিউটিএ ও সচিবের দপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ থেকে তিনি এ গাড়িটি ব্যবহার করছেন। এর আগে বিআইডব্লিউটিএ-এর ঢাকা মেট্রো ঘ ১৮-৭৭৪০ রেজিস্ট্রেশন নম্বরের যে গাড়িটি ব্যবহার করতেন, সেটি ফেরত দিয়েছেন। এ বিষয়ে যোগাযোগ করে নৌসচিব মো. মোস্তফা কামালের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। যেভাবে গোপন করা হয়েছে তথ্য : অনুসন্ধানে জানা যায়, ‘সংগঠন ও সরঞ্জামাদির তালিকা’ অনুযায়ী বিআইডব্লিউটিএতে ছয় ধরনের ৪৩টি গাড়ির অনুমোদন রয়েছে। এর মধ্যে জিপের সংখ্যা ১৬টি। বাস্তবে জিপ রয়েছে ১৭টি। নতুন গাড়ি কেনার প্রস্তাবে ১৭টি জিপ থাকার ওই তথ্য গোপন করা হয়। সেখানে বলা হয়, সংস্থাটির ১৬টি জিপের মধ্যে ঢাকা মেট্রো ঘ ১১-০৯১৬ রেজিস্ট্রেশন নম্বরধারী জিপটি ২০২২ সালের ২১ এপ্রিল বিক্রি করা হয়। ওই গাড়ির প্রতিস্থাপন হিসাবে নতুন জিপ কেনা হবে। ওই প্রস্তাব ১৮ জুলাই অর্থ মন্ত্রণালয় এবং ১৯ জুলাই নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেয়। ২৩ জুলাই ১ কোটি ৪৫ লাখ ৭৬ হাজার টাকায় মিৎসুবিসির পাজেরো স্পোর্টস গাড়ি সরবরাহ করতে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজকে নটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড দেন বিআইডব্লিউটিএ-এর উপপরিচালক (প্রশাসন) মো. সিরাজুল ইসলাম ভূঁঞা। ২৭ জুলাই গাড়ি সরবরাহ করে প্রগতি। যদিও ২ জুলাই জারি করা সরকারের এক প্রজ্ঞাপনে নতুন গাড়ি কেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে ১০ বছরের পুরোনো গাড়ির প্রতিস্থাপনের সুযোগ রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআইডব্লিউটিএ-এর একাধিক কর্মকর্তা বলেন, মো. সিরাজুল ইসলাম ভূঁঞা যতবার এ দায়িত্বে এসেছেন, ততবারই গাড়ি কেনা ও বিক্রির কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছেন। এর আগে ২০২০ সালে বাংলাদেশ-ভারত নৌপ্রটোকল রুট রক্ষণাবেক্ষণ খাতের অর্থ থেকে দুটি জিপ গাড়ি কেনার নেতৃত্ব দেন এই কর্মকর্তা। অনিয়মের মাধ্যমে কেনার কারণে ওই গাড়ি দুটি এখনো সংগঠন ও সরঞ্জামাদির তালিকাভুক্ত হয়নি। এমন অবস্থায় তথ্য গোপন করে আরেকটি গাড়ি কেনার নথি উপস্থাপন করেন এ কর্মকর্তা। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মো. সিরাজুল ইসলাম ভূঁঞা বলেন, আমি কি নিজের জন্য গাড়ি কিনেছি। আমি সংস্থার ভালোর জন্য গাড়ি কিনেছে। নতুন নতুন গাড়ি থাকায় সংস্থার কাজের গতি বেড়েছে, প্রকল্প পাশ হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বিআইডব্লিউটিএ-এর জন্য আরও ১৮৯টি গাড়ির সংস্থান রেখে ‘সংগঠন ও সরঞ্জামাদির তালিকা’ সংশোধনের চেষ্টা করছি। এসব কাজের জন্য আমাকে ধন্যবাদ দিতে পারেন। ফেরত যায় না প্রকল্পের গাড়ি : খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সংস্থাটির সংগঠন ও সরঞ্জামাদির তালিকার বাইরে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় কেনা ১৯টি গাড়ি ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৯টি জিপ, ছয়টি পিকআপসহ বিভিন্ন ধরনের গাড়ি রয়েছে। এসব গাড়ি পরিবহণ পুলে ফেরত দেওয়ার কথা থাকলেও তা মানা হয়নি। উদ্ধারকারী জলযান প্রকল্পের আওতায় ২০১১ সালে ঢাকা মেট্রো ঘ ১৩-০৭৪৩ নম্বরধারী জিপ ও ঢাকা মেট্রো ঠ ১১-০৩৮৪ নম্বরধারী একটি পিকআপ কেনা হয়। দুটি গাড়িই ব্যবহার করছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা। অথচ প্রকল্পটি ২০১৩ সালের জুনে শেষ হয়েছে। পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার নৌ-টার্মিনাল প্রকল্পের আওতায় একটি জিপ ও দুটি পিকআপ কেনা হয়। ওই প্রকল্পটিও ২০১৩ সালে শেষ হয়। একইভাবে আরও কয়েকটি প্রকল্প শেষ হলেও গাড়ি ফেরত যায়নি।