কক্সবাজারে এক বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের শতকোটি টাকা মূল্যের ১৭ দশমিক ১৮ একর জমি বেদখল হয়ে গেছে। বুধবার নেতাকর্মীদের একটি বহর নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান বাবু এ জমি দখলে নেন বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। এদিন দুপুরে উখিয়ার জালিয়াপালং ইউনিয়নের মেরিনড্রাইভসংলগ্ন বাইলাখালি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের নামে ঢাকা থেকে বিমানে আসেন তিনি। দখলের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর সন্ধ্যার ফ্লাইটে ঢাকার উদ্দেশে কক্সবাজার ত্যাগ করেন। স্থানীয়ভাবে দখলবাজির নেতৃত্ব দেন কক্সবাজার স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রত্যাশী ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আলি আহামেদ। বন্যা ও শোকের (আগস্ট) মাসে একজন দায়িত্বশীল নেতার এমন ন্যক্কারজনক ঘটনায় জেলাজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। ভুক্তভোগী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল মান্নান চৌধুরীর সন্তান রেজাউল আলম চৌধুরী বলেন, কক্সবাজারে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির সুযোগে ঢাকা থেকে বিমানযোগে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান বাবু কক্সবাজার এসে একটি গ্রুপের হয়ে তার নেতৃত্বে ২০০-৩০০ নেতাকর্মীর গাড়িবহর নিয়ে বুধবার আমাদের ১৭ দশমিক ১৮ একর জমি দখল করে নেন। এ সময় আমাদের পাহারাদার রফিককে অস্ত্র ধরে গুলি করার হুমকি দিয়ে মারধর করা হয়। সাইনবোর্ড ভাঙচুর ও আমাদের গংয়ের নামফলকও মুছে ফেলা হয়েছে। দখলের সঙ্গে সঙ্গে জোরপূর্বক স্থাপনা নির্মাণের জন্য ইটপাথর নিয়েও এসেছে তারা। স্থানীয়ভাবে জায়গা দখলের সহযোগিতা করেন পালংখালীর ইয়াবা ব্যবসায়ী আলী আহমদ। তিনি সকাল ১০টার দিকে আমাকে হুমকিও দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, আমরাও আওয়ামী পরিবারের লোক। মুক্তিযোদ্ধা পরিবার। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। আমরা আশঙ্কা করছি স্বেচ্ছাসেবক লীগের বাবু ভাড়াটিয়া হয়ে একটি কোম্পানির ভুয়া জমি দখলে নিতে যেভাবে মরিয়া হয়েছে, এতে আমরা লজ্জিত এবং এটি দলের জন্য অশনিসংকেত। এখানে যদি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয় সব দায়-দায়িত্ব তাদের নিতে হবে। জমির আরেক মালিক ও ভুক্তভোগী সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ সালাহ উদ্দিন বলেন, আমরা আবুল খায়ের চেয়ারম্যান কাছ থেকে ১৯৩৬ সালে কক্সবাজার মুন্সেফি আদালত থেকে সর্বোচ্চ দামে একক নিলাম খরিদ করি। পরবর্তীকালে ১৯৩৭-৩৮ সালে আদালত কর্তৃক নিলাম খরিদদার আবুল খায়েরকে ঢোলবাদ্য বাজিয়ে নাজিরের মাধ্যমে দখল বায়নামা প্রদান করেন। সেই মতে নিলাম খরিদদার (আমাদের) নামে আরএস খতিয়ান চূড়ান্ত প্রচারিত হয়। সেই থেকে অদ্যাবধি শান্তিপূর্ণভাবে ভোগদখলে আছি। এরপর পরবর্তী সময়ে বিএস জরিপ শুরু হলে আবুল খায়ের বৃদ্ধাবস্থায় পতিত হলে তার নিকটাত্ময়ের নামে বিএস ভুল রেকর্ড হলে আবুল খায়েরের সন্তান প্রয়াত আলী আহমদ বাদী হয়ে ২০০৭ সালে স্বত্ব ঘোষণা ও ডিক্রি পাওয়ার মামলা করেন। উক্ত মামলায় ২০০৭ সালে সব বিবাদীর বিরুদ্ধে আদালত মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সম্পত্তি বেচাবিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন আদালত। তিনি দালিলিক তথ্য উপস্থাপন করে আরও বলেন, ২০১৯ সালে ৩৭নং বিবাদী মোশাররফ হোসেন সিকদার এক ব্যক্তি আদালতে মামলা চলমান ও নিষেধাজ্ঞা গোপন করে কথিত এসএমই করপোরেশনকে জমি হস্তান্তর করেন মর্মে জাল দলিল সৃজন করে। রায়ের আগ পর্যন্ত উক্ত মোশাররফ হোসেন সিকদার মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও হেরে যান। এবং আদালত উভয় পক্ষকে শুনে নালিশিভুক্ত জমি আবুল খায়েরের সন্তানরা ১৬ আনা স্বত্বের মালিক মর্মে বিগত ২০২২ সালের ৩১ জুলাই চূড়ান্ত রায়ও প্রচার করেন। আদালতে হেরে গিয়ে তারা ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী এনে জায়গা দখল করেন। ভুক্তভোগীরা আরও জানান, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান বাবুর সঙ্গে সেখানে গিয়েছিলেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহবায়ক মো. রহিম উদ্দিন সদস্য সচিব অ্যাড. একরামুল হুদা, আবদুর রহমান, রুস্তম আলী চৌধুরী, জসিম উদ্দিন সিদ্দিকীসহ অন্তত তিন শতাধিক নেতাকর্মী। এদিকে টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে কক্সবাজার জেলার ৭১ ইউনিয়নের মধ্যে ৬০ ইউনিয়নে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় বন্যা পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা দিগি¦দিক ছুটে যাচ্ছে। ঠিক এ সময় এসে সরকারি দলের দায়িত্বশীল নেতাদের দখলবাজি নিয়ে জেলাজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান বাবু বলেন, জায়গাটি আমাদের কেনা, আমাদের লোকজনকে মেরে বের করে দিয়েছে তারা। আজ তাদের আমি দেখতে এসেছি। কী কারণে তাদের মারা হয়েছে তাও দেখতে এসেছি। কক্সবাজার জেলাজুড়ে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির মধ্যে জমি দখলে নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমিও ত্রাণ দিতে এসেছি। এ সময় তিনি প্রতিবেদককে সংবাদ প্রকাশ না করার অনুরোধ করেন এবং অভিযোগকারীদের নিয়ে বসবেন বলে জানান। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সম্পাদক প্রত্যাশী ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আলি আহামেদ বলেন, অভিযোগকারী এরা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। কেন্দ্রীয় আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান বাবুও কেনা সূত্রে এ জমির একজন অংশীদার। তাই আমরা এখানে এসেছি। তাদের পক্ষে দেওয়া আদালতের রায় স্থগিত রয়েছে। এদিকে বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, বুধবার বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে ইউএস বাংলার বিএস ১৪৫নং ফ্লাইটে করে কক্সবাজার বিমানবন্দরে পৌঁছান আফজালুর রহমান বাবু। সেখান থেকে বৃষ্টি উপেক্ষা করে নেতাকর্মীদের সঙ্গে করে গাড়িবহর নিয়ে চলে যান মেরিনড্রাইভে। ত্বরিতগতিতে জমি দখল সম্পন্ন করে সন্ধ্যা ৭টা ১০ মিনিটে ইউএস বাংলার আরেকটি ফ্লাইট নং (বিএস-১৫৬) করে বিমানযোগে ঢাকায় ফিরে যান। কক্সবাজার ত্যাগ করার আগে ৫টা ৫৮ মিনিটে বিমানবন্দরের সামনে ব্যানার টানিয়ে কয়েকজনকে ত্রাণ দিয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করতে দেখা যায় আফজালুর রহমান বাবুকে। অথচ বিমানবন্দর এলাকায় কোনো বন্যার ঘটনা ঘটেনি বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।