ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পর এই প্রথম ফিলিস্তিনে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করল মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরব। জর্ডানে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত নায়েফ আল-সুদাইরিকে ফিলিস্তিনে অনাবাসিক দূত এবং জেরুজালেমের কনসাল জেনারেল ঘোষণা করা হয়েছে। শনিবার (১২) আম্মানে ফিলিস্তিনি দূতাবাসে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। যদিও সেই রাষ্ট্রদূতের জন্য জেরুজালেমে স্থানীয় কোনো দূতাবাস করতে দেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে নেতানিয়াহুর সরকার। সৌদি আরবের এই পদক্ষেপে স্পষ্ট যে, দীর্ঘদিন পর তেল আবিবের সঙ্গে রিয়াদের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো। বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি খোলাসা করা না হলেও ইসরায়েল যে এই মুহূর্তে আরবের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চাপের মুখে আছে তার ইঙ্গিত দেখা যেতে শুরু করেছে। বিশেষ করে সিনো–মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধ এবং রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে আরব দেশগুলোর যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চীন–রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে চলা নীতি তেল আবিবকে বিচলিত করেছে। ফিলিস্তিনের বিভিন্ন বিষয়াবলি আম্মানে সৌদি আরবের দূতাবাস থেকে পরিচালিত হয়। সৌদি আরব ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের পর থেকেই স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে কাজ করে আসছে। যার রাজধানী হবে পূর্ব জেরুজালেম। এ অবস্থান থেকে তারা কখনো সরেনি। রাষ্ট্রদূত নিয়োগের এই পদক্ষেপ তারই অংশ বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও ইসরায়েল জেরুজালেমকে নিজের রাজধানী মনে করে। ২০১৭ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতিও দেয়। তবে বিশ্বের অন্য পরাশক্তিগুলো এখনো স্বীকৃতি দেয়নি। এর ফলে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জেরুজালেমে ফিলিস্তিনিদের কূটনৈতিক তৎপরতায় বাধা দিয়ে যাচ্ছে। সৌদি আরব শুরু থেকেই ফিলিস্তিনকে গুরুত্ব দিয়েছে এবং দৃশ্যত ইসরায়েলের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক এড়িয়ে গেছে। ওয়াশিংটন অবশ্য ইসরায়েল-সৌদি সম্পর্ককে স্বাভাবিক করতে একটি ঐতিহাসিক মধ্যপ্রাচ্য চুক্তির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বহুদিন যাবত। ইসরায়েলের কট্টর-ডানপন্থী সরকারগুলো সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পথে প্রধান বাধা হয়ে থেকেছে। এবারও তারা বাগড়া দিতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। যদিও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট ভিন্ন বার্তা দিয়ে এসেছেন। গত জুলাইয়ে ইসরায়েলের ৭৫তম স্বাধীনতা দিবসে মার্কিন কংগ্রেসে বক্তৃতা করেন ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হেরজগ। সেই বক্তব্যের পরতে পরতে ছিল আরব–ইসরায়েল ঐক্য ও সমঝোতার তাগিদ। ফিলিস্তিনের মাটিতে ইসরায়েল নামের একটি ইহুদি রাষ্ট্রের জন্ম এবং আরব ও ইউরোপীয়দের হাত থেকে বারবার এই নতুন রাষ্ট্রকে রক্ষায় পাশে থাকার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন অকুণ্ঠচিত্তে। ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রু উইলসনের সমর্থন থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালে ফিলিস্তিন এবং একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনে ভূমি ভাগের পরিকল্পনায় প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের সমর্থন এবং ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠার মাত্র ১১ মিনিটের মধ্যে ইসরায়েল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা উল্লেখ করে কৃতজ্ঞতা জানান প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক। সেই সঙ্গে ফিলিস্তিনি এবং আরবদের প্রতি ইসরায়েলের বর্ণবাদী মনোভাব, ইসরায়েল রাষ্ট্রের সামরিকীকরণ, ফিলিস্তিনের আদি নিবাসীদের উৎখাতের মতো অপরাধ ইসরায়েলকেই ভেতর থেকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে— এমন বক্তব্য দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক। তিনি প্রশংসা করেছেন ফিলিস্তিনি নেতা মাহমুদ আব্বাসের। সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে তাঁর আকাঙ্ক্ষার কথা তিনি সবিস্তারে ও অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনিদের সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর একটি কথাও বিশ্বাস করবেন না; উনি তো ভীতি ছড়ানোর কারবার করেই তাঁর (রাজনৈতিক) ক্যারিয়ার গড়েছেন!’ তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বেশির ভাগ আরব দেশের মতো সৌদি আরবও ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি। আরব দেশগুলোতে সাধারণ মানুষের মধ্যেও তীব্র ইসরায়েল ঘৃণা রয়েছে। রিয়াদ ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার আগে তেল আবিবের কাছে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য পিএলও নিয়ন্ত্রিত ‘প্যালেস্টাইন অথোরিটি’ ও গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী হামাসের বিরোধও বড় বাধা হয়ে রয়েছে। রিয়াদে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত বাসাম আল-আগা ফিলিস্তিনে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত হিসেবে আল-সুদাইরিকে স্বাগত জানিয়েছেন। পাশাপাশি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প সবার আপত্তি উপেক্ষা করে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সশরীরে জেরুজালেম গিয়ে মার্কিন দূতাবাস উদ্বোধন করেন তিনি। আল-আগা ভয়েস অব প্যালেস্টাইন রেডিওকে বলেছেন, ‘রাষ্ট্রদূত নিয়োগের অর্থ সৌদি আরবের আগের অবস্থান অব্যাহত থাকছে।’ ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলাই কোহেন তেল আবিব ভিত্তিক রেডিও স্টেশন ১০৩ এফএমকে বলেছেন, সৌদি রাষ্ট্রদূত ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা–সাক্ষাৎ করতে পারবেন। তবে তিনি এখানে স্থায়ীভাবে অবস্থান করতে পারবেন না। সৌদি আরব ইসরায়েলের সঙ্গে সমন্বয় করে ফিলিস্তিনে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেয়নি বলে উল্লেখ করেন কোহেন। তবে এর মাঝেই সৌদি-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সূত্র খুঁজে পাচ্ছেন তিনি। কোহেন বলেন, ‘এই ঘটনা প্রবাহের পেছনে যা রয়েছে তা হলো, সৌদি আরব এবং ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনার পর্দার বাইরে সৌদিরা ফিলিস্তিনিদের কাছে একটি বার্তা দিতে চান যে, তাঁরা তাঁদের ভুলে যাননি।’ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের তাগিদ যে সৌদি আরবও অনুভব করছে সেটি অনেকটা স্পষ্ট। সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদান এবং মরক্কো ইসরায়েলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্থাপন করেছে। ইসরায়েলের ব্যাপারে উদার অবস্থানের পক্ষে জনসম্মতি তৈরি করতে পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তনে হাত দিয়েছে সৌদি আরব। ইসরায়েল ও ইহুদিদের ব্যাপারে ঘৃণাত্মক কনটেন্ট পাঠ্যপুস্তক থেকে ক্রমে বাদ দেওয়া হচ্ছে। তথ্যসূত্র: আল জাজিরা, সিএনএন