আরসেপ জোটে যোগদান কতটা যৌক্তিক হবে

প্রকাশিতঃ অগাস্ট ১৮, ২০২৩ | ৭:৪৩ অপরাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় ঊর্ধ্বগতি এবং ডলার-জ্বালানি সংকটসহ নানামুখী সমস্যায় অর্থনীতির এ সংকটময় মুহূর্তে পণ্য রপ্তানির অব্যাহত প্রবৃদ্ধিতে দেশের আর্থসামাজিক সংকট উত্তরণের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। রপ্তানির ওপর ভর করে আগামী দিনে দেশের অর্থনীতি পুনরায় ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা। দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদদের মতে, আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে আসার সঙ্গে সঙ্গে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার ওপর যে চাপ তৈরি হয়েছিল, তা ধীরে ধীরে প্রশমিত হচ্ছে। সম্প্রতি দেশের অর্থনীতির ভিত আরও সুদৃঢ় করতে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর মুক্তবাণিজ্য জোট রিজিওনাল কম্প্রেহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি) বা আরসেপে যোগদানের বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ তথা এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে যে কোনো বাণিজ্যিক জোটের সঙ্গে সরকারের কাজ করার আগ্রহ অবশ্যই ইতিবাচক। একই সঙ্গে এককভাবে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য বা অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি করার জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রাক্কালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রেফারেন্সিয়াল ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (পিটিএ) এবং ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (এফটিএ) করার জোরালো প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। জোটে যুক্ত হয়ে জোটের অধীন দেশগুলোর সঙ্গে পিটিএ, এফটিএ চুক্তি এবং বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অর্থনীতির বাজারে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা পেতে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই আরসেপের সদস্যপ্রাপ্তির জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আবেদন করার প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা পাওয়ার পরপরই এ জোটে যোগ দেওয়ার যাবতীয় প্রস্তুতি শুরু করে মন্ত্রণালয়। আরসেপে যোগ দেওয়ার পর কীভাবে দেশের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা কাজ শুরু করেছেন। অচিরেই আরসেপে যোগদানসংক্রান্ত আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় উত্থাপন করা হবে। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন সমীক্ষার মাধ্যমে আরসেপে যোগদানের সুবিধা-অসুবিধাগুলো পর্যালোচনা করে জোটে যোগ দেওয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছে। তাদের সমীক্ষা মতে, বেশকিছু চ্যালেঞ্জ থাকলেও আরসেপে যোগ দেওয়া দেশের অর্থনীতির জন্য লাভজনক। আরসেপে যোগ দিলে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি ১৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ বাড়বে, যার পরিমাণ ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি। এ কারণে বাংলাদেশের দ্রুত আরসেপে যোগ দেওয়া প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, ‘আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় কিছু পূর্বসতর্কতাসহ আরসেপে বাংলাদেশের যোগদানের পক্ষে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। নিয়মানুযায়ী চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে অন্য দেশও আরসেপে অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করতে পারছে। ইতোমধ্যে শ্রীলংকা ও হংকং এ জোটে যোগ দেওয়ার জন্য আবেদন করেছে।’ বিশেষজ্ঞদের মতানুসারে, একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্ব অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হিসাবে আসিয়ানসহ পূর্ব এশিয়ার, বিশেষ করে আরসেপে অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মর্যাদা অপরিসীম। ফলে বিশ্ব অর্থনীতির প্রাসঙ্গিক একীভূত কেন্দ্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সংযুক্ত থাকা যৌক্তিক হবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ এখন যেসব দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করার বিষয়ে আলোচনা করছে, তার মধ্যে ছয়টি দেশ আরসেপে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আরসেপভুক্ত দেশগুলো নিজেদের শুল্ক কমানোর জন্য ১০ থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত সময় নিয়েছে। বাংলাদেশ আরসেপে অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করলে আরসেপভুক্ত ১৫টি দেশ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। এক্ষেত্রে প্রতিটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশকে পৃথকভাবে দরকষাকষি করতে হবে। ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস (আসিয়ান) জোটের ১০ সদস্য ব্রুনাই, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনসহ ১৫টি দেশ এই বাণিজ্য জোটে যোগদানের চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ১৫ দেশের বাণিজ্যিক জোট আরসেপ যাত্রা শুরু করে। ২০১২ সালে আরসেপ গঠনের পরিকল্পনা সর্বপ্রথম জনসম্মুখে প্রকাশ পেলেও ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আরসেপ গঠনের উদ্যোগ গতি পায়। এছাড়া কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর আগে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে আঞ্চলিক অর্থনীতি পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিু পর্যায়ে পৌঁছলে আরসেপের উদ্যোগ আরও বেগবান হয়। জোটভুক্ত দেশগুলোর মোট জনসংখ্যা ২৩০ কোটি এবং সম্মিলিত জিডিপির পরিমাণ ২৬ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার। এ জোটের অর্থনীতির আয়তন বিশ্বের মোট জিডিপির ৩০ শতাংশ। ফলে এ চুক্তি বিশ্বের সবচেয়ে বড় অবাধ বাণিজ্য এলাকা তৈরি করেছে। এশিয়ার নতুন এ বাণিজ্য অঞ্চলটির পরিধি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোর মধ্যে বিদ্যমান মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল বা ইউরোপের চেয়েও বড় বলে বিজ্ঞজনদের ধারণা। এ চুক্তির মূল লক্ষ্য হচ্ছে, সদস্য দেশের মধ্যে আন্তঃবাণিজ্য শুল্কের পরিমাণ হ্রাস, বাণিজ্যসেবার উন্মুক্তকরণ এবং উদীয়মান অর্থনীতির সদস্য দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আর্থসামাজিক উন্নয়ন। অর্থনীতিবিদদের মতে, আরসেপ চীনের নেতৃত্বাধীন বাণিজ্যিক ব্লক হলেও যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়া এ ব্লকের সদস্য। এছাড়া ভারতকে যে কোনো সময় এ জোটে ফাউন্ডার মেম্বার হিসাবে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। আরসেপে যোগ দিলে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাড়বে। একই ভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ শিল্পের কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে আরসেপ থেকে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে দেখতে হবে আরসেপে যোগ দিলে কী কী শর্ত পূরণ করতে হবে। যদি দেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো শর্ত না থাকে, তাহলে বাংলাদেশের উচিত যোগ দেওয়া। যে কোনো জোটে যাওয়া কিংবা চুক্তি করার আগে বিষয়গুলোর সমীক্ষা প্রয়োজন। তবে এ ধরনের উদ্যোগ ভালো। দেশের অর্থনীতি বড় হচ্ছে, আমরা স্বল্পোন্নত বা এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি। জীবনযাত্রার মান আরও উন্নত করতে হলে অবশ্যই দেশের রপ্তানি বাণিজ্য বাড়াতে হবে। সেক্ষেত্রে আরসেপ একটি গুরুত্বপূর্ণ জোট হতে পারে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘চীনের নেতৃত্বাধীন আরসেপ প্রাথমিকভাবে বাণিজ্যিক জোট মনে হলেও যতই দিন যাবে, ততই এটি রাজনৈতিক জোট হিসাবে আবির্ভূত হবে। এসব জোটে যুক্ত হলে সবার আগে দেশের স্বার্থ দেখতে হবে। দেশের স্বার্থবিরোধী হয় এমন কোনো শর্ত পূরণ করে জোটে যুক্ত হওয়া যাবে না। পাশাপাশি এসব দেশের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানিতে কী ধরনের সুবিধা বাংলাদেশ পাবে, তা-ও যুক্ত হওয়া উচিত।’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘আরসেপে যুক্ত হওয়ার আগে দেখতে হবে সাউথ এশিয়ান ফ্রি ট্রেড এরিয়া (সাফটা) চুক্তিসহ বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক যেসব চুক্তি রয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে এটি সাংঘর্ষিক হয় কি না। আমি মনে করি, আরসেপে যুক্ত হওয়া উচিত বাংলাদেশের। এতে জোটভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক বেড়ে যাবে। দেশের বাণিজ্য সম্প্রসারিত হবে।’ সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) একজন সম্মানিত ফেলো গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘এটি ভালো উদ্যোগ। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের প্রাক্কালে বাংলাদেশের আরসেপে যোগাদান এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নিয়ে আলোচনা একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ। আরসেপে যোগদান করতে হলে বাণিজ্য উদারীকরণ ও শুল্ক হ্রাসকরণ করতে হয়। স্থানীয় শিল্পের প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য মান বাড়ানো, সমন্বয় ও মান নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আসিয়ান চুক্তিতে দুই ধরনের নিয়ম ছিল। কম্বোডিয়াসহ কয়েকটি দেশ অন্যদের চেয়ে অতিরিক্ত সুবিধা পেত। বাংলাদেশও আরসেপে থেকে একই ধরনের সুবিধা পেতে পারে। অর্থাৎ বাংলাদেশ আরসেপভুক্ত দেশগুলো থেকে বেশি সুবিধা পাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ আরসেপে যোগ দিলে এসব দেশ থেকে পণ্য আমদানির সময় শুল্ক থেকে সরকারের আয় কমে যাবে। সরকারকে রপ্তানি বাড়িয়ে এর ক্ষতি পোষাতে বিদেশি বিনিয়োগের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশ আরসেপভুক্ত দেশগুলো থেকে বিনিয়োগ বাড়ালে রপ্তানিও বাড়বে। এর মাধ্যমে রপ্তানি বহুমুখীকরণও সম্ভব হবে।’ এতৎসংক্রান্ত বিশ্লেষণ-পরামর্শ পর্যালোচনায় এটি স্পষ্ট যে, উন্নয়নশীল বিশ্বে পদার্পণের চূড়ান্ত পর্যায়ের চলমান পরিক্রমায় আরসেপ জোটে যোগদান অতীব গুরুত্বপূর্ণ। দেশের স্বার্থ সুরক্ষায় এবং প্রাগ্রসর সমাজে রূপান্তরে সরকারের এ ধরনের জোটে যোগদানের উদ্যোগ দেশকে স্বাবলম্বী হওয়ার পথে এগিয়ে নেবে। ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়