দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ যতই ঘনিয়ে আসছে, দেশের রাজনীতিতে ততই উত্তাপ বাড়ছে। প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমঝোতার পথে হাঁটার পরিবর্তে অবস্থান নিয়েছে দুই মেরুতে। পালটাপালটি কর্মসূচি দিয়ে মাঠের রাজনীতি সরব রাখলেও চলমান সংকট থেকে উত্তরণে সমাধান কোন পথে, তা বলছে না কোনো পক্ষই। এমনকি কোনো পক্ষ থেকেই সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সমস্যা নিরসনে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতিনিধিসহ অনেকেই বলেছেন তারা সংলাপের পক্ষে। তবে এর সঙ্গে (সংলাপ) আমরা যুক্ত হব না। তারা বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোকেই এ সংকট সমাধান করতে হবে। কিন্তু সেদিকে না গিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ তাদের শরিকরা সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনে অনড়। একইভাবে বিএনপিসহ বিরোধী শিবিরের রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার একদফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ ছাড়বে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। দুই পক্ষই কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এ অবস্থায় আগামী দিনে সব রাজনৈতিক দল নিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রশ্নেও জনমনে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। পারিবারিক বা সামাজিক আড্ডায় রাজনৈতিক আলোচনা উঠলেই সামনে আসে নির্বাচন প্রসঙ্গ। প্রশ্ন উঠে ভোট হবে কি না। হলে কীভাবে হবে, বিএনপিসহ শরিক দলগুলো আসবে কি না। যদি তারা না আসে, সেক্ষেত্রে নির্বাচন কি অংশগ্রহণমূলক হবে। যদি অংশগ্রহণমূলক না হয় তবে বিশ্ব কি এই নির্বাচন মেনে নেবে-প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনায় আড্ডা জমে ওঠে। অনেক সময় এ ধরনের আড্ডায়ও দুটি পক্ষ দাঁড়িয়ে যায়। পক্ষে-বিপক্ষে চলে ধুন্ধুমার কথার লাড়াই। এ লড়াই থেকেই উঠে আসে নির্বাচন ঘিরে ধোঁয়াটে পরিস্থিতি চিত্র। তদের প্রশ্ন হচ্ছে-সংবিধান অনুযায়ী ডিসেম্বরের শেষদিকে অথবা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। এই হিসাবে ভোটের আর বেশি দিন বাকি নেই। ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনও ভোট আয়োজনে তাদের যাবতীয় প্রস্তুতি শুরু করেছে। সেপ্টেম্বরের শেষদিকে অথবা অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে তারা তফশিল ঘোষণা করবে বলে জানিয়েছে। বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে আওয়ামী লীগসহ তাদের শরিকরা নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে। বসে নেই সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও। তবে বিএনপি-জামায়াতসহ তাদের বলয়ের দলগুলোর তৃণমূলের নেতারা আন্দোলনে সক্রিয়। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতসহ দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরাও নির্বাচন সামনে রেখে বেশ তৎপর। তবু ভোটের আবহ তৈরি হচ্ছে না কোথাও। সময় তো ফুরিয়ে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে চারদিকে ভোটের রব কবে উঠবে। ধোঁয়াটে অবস্থা কবে কাটবে-আগামী নির্বাচন ঘিরে ভোটারদের মধ্যে এ ধরনের নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। শাসক দল আওয়ামী লীগ কতটা ছাড় দেবে, বিএনপিসহ বিরোধীরা তাদের দাবি কতটা আদায় করতে পারবে। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে নাকি বিএনপিসহ একটি বড় অংশ নির্বাচন বর্জন করবে-এমন সব জিজ্ঞাসা রাজনীতির অন্দরমহল থেকে প্রকাশ্যে চলে আসছে। রাজনৈতিক দলগুলোর এই মুখোমুখি অবস্থানে জনগণের শঙ্কা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা, বিশিষ্ট আইনজীবী ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। তিনি শনিবার বলেন, পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তা কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না। তাই সমাধানের পথ খোঁজা জরুরি। তিনি আরও বলেন, বিগত দুটি নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কেমন হয়, তা দেশবাসী দেখেছে। দিনের ভোট রাতেই হয়ে গেছে। মানুষ ভোট দিতে পারেনি। তাই দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে-মানুষ এই কথা আর বিশ্বাস করে না। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও এখন আর সরকারকে বিশ্বাস করে না। কিন্তু তাদের দাবি কোন প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়িত হবে, এ বিষয়টিও খোলাসা করে বলতে হবে। এজন্য আলোচনায় বসতে হবে। আর আলোচনার এই উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। তা না হলে দেশে সংঘাত-সহিংসতার পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা আছে। তবে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে আলোচনায় বসার কোনো সুযোগ নেই দাবি করেন আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তিনি শনিবার বলেন, তারা (বিএনপি-জামায়াত) একটি গণতান্ত্রিক এবং সাংবিধানিক সরকারের পরিবর্তে আরেকটি অসাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠার কথা বলছে। তারা সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, মৌলবাদী শক্তিকে উসকে দিয়ে এবং ধর্মের নামে তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নিতে চায়। তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসা আওয়ামী লীগের পক্ষে সম্ভব না। তিনি আরও বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধে বৈষম্যহীন, শান্তি, সম্প্রীতি, উন্নয়ন ও অগ্রগতির বাংলাদেশ গড়ে তুলতে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কাজ করে যাচ্ছে। একই সঙ্গে আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াত নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র করছে। তাই তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসার কোনো সুযোগ নেই। সংকট উত্তরণে আলোচনার বিকল্প নেই দাবি করে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু এমপি বলেন, একদল যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকতে মরিয়া। আরেক দল যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় যেতে মরিয়া। এরা কেউ জনগণের কথা ভাবে না। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। এতে সংকট বাড়বে ছাড়া কমবে না। সংকট উত্তরণে প্রয়োজন আলাপ-আলোচনায় বসা। আমরা আগেই বলেছি, সবাই মিলে আলোচনার টেবিলে বসলে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কীভাবে আয়োজন করা সম্ভব, এ বিষয়ে ফর্মুলা দেব। এ বিষয়ে আমাদের নিজস্ব ফর্মুলা আছে। এ প্রসঙ্গে বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি বলেন, আমরা সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টির কোনো লক্ষণ দেখছি না। কারণ, আমাদের আন্দোলনটা শান্তিপূর্ণ। আওয়ামী লীগ কখনো কখনো আমাদের দেখাদেখি পালটা কর্মসূচি দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করে। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ যদি পরিস্থিতি সংঘাতময় করে তোলে বা তোলার চেষ্টা করে, তবে এর দায়দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমাদের আন্দোলনে সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। এ চাপেই সরকার দাবি মেনে নিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হবে। বিএনপির এই নেতা বলেন, সরকারের পদত্যাগের পর তাদের সঙ্গে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে আলাপ-আলোচনা হতে পারে, এর আগে নয়। সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, একপক্ষ যে কোনো মূল্যে আগামী নির্বাচন করতে চায়। আরেক পক্ষ যে কোনো মূল্যে এই নির্বাচন প্রতিহত করতে চায়। রাজনৈতিক দলগুলোর বিশেষ করে দুই বড় দলের এই অনড় অবস্থানের পরিণতি কার জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না। এতে সংঘাত-সহিংসতার দিকে দেশ ধাবিত হবে। তখন কোনো পক্ষই আর নিরাপদ থাকবে না। জাতি হিসাবে আমরাও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে খাদের কিনারায় গিয়ে দাঁড়াব। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন রাজনীতিবিদদের বোধোদয়। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া। সমাধানের পথ খোঁজা। একটি কথা মাথায় রাখতে হবে-অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে সংকট মোকাবিলায় দিনশেষে এগিয়ে আসতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকেই, রাজনীতিবিদদেরই।