সংক্রামক রোগে অকার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক

প্রকাশিতঃ সেপ্টেম্বর ৬, ২০২৩ | ৯:১৩ পূর্বাহ্ন
মোঃ রাছেল রানা, প্রধান সম্পাদক

দেশে কমপক্ষে ২১ ধরনের সংক্রামক রোগের চিকিৎসায় কার্যকারিতা হারাচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক। এর অতিরিক্ত, অপর্যাপ্ত ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে মানবদেহ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবার জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে ব্যাকটেরিয়ার এমন কিছু জিন মিউটেশন (অণুজীবাংশ) ও পরিবর্তন হয়েছে, যেগুলো বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মানবদেহে শনাক্তও হয়নি। সম্প্রতি সরকারি ৮টি মেডিকেল কলেজ এবং ৪টি বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট হাসপাতাল থেকে নানা বয়সি রোগীদের সংগৃহীত নমুনা গবেষণা করে এমন ভয়ংকর তথ্য পাওয়া গেছে। বৃহস্পতিবার আগারগাঁওয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের (এনআইএলএমসি) ইনফেকশাস ডিজিজ বা সংক্রামিত রোগে ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের কার্যকারিতা শীর্ষক এই গবেষণার আংশিক ফলাফল প্রকাশ করে। গবেষণায় ১২টি সরকারি মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সব বয়সি নারী, পুরুষ ও শিশু রোগী থেকে এই নমুনা নেওয়া হয়। সংগৃহীত নমুনার মধ্যে যেগুলোতে অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্ট (এএমআর) অণুজীব পাওয়া গেছে, এনআইএলএমসি’র নিজস্ব এনজিএস মেশিনে সেগুলোর জিনোম সিকোয়েন্স (জীবের বংশগতি তথ্য) করা হয়। সিকোয়েন্সিংয়ে বেশকিছু জিনে (ক্ষতিকর অণুজীব) নতুন মিউটেশন বা ব্যাকটেরিয়ার ধরনের পরিবর্তন শনাক্ত হয়। গবেষণার একটি অংশে বলা হয়, অন্যান্য কারণের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের যত্রতত্র ও ভুল ব্যবহারের ফলে মানবদেহে ভয়ংকরভাবে রেজিস্ট্যান্ট বা ওষুধ অকার্যকর করার অনুজীবের উপস্থিতি দেখা গেছে। এনআইএলএমসি পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহেদ আলী জিন্নাহ এ বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এই গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন এনআইএলএমসি’র মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. সাইফুল ইসলাম। গবেষণায় আরও যুক্ত ছিলেন একই প্রতিষ্ঠানে সহকারী অধ্যাপক ডা. সানজিদা এ্যারিনা, সহকারী অধ্যাপক ডা. নাজনীন তারানা, ডা. বায়েজিদ বিন মনির এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ ইউসুফ। জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্ল্যানিং মনিটরিং অ্যান্ড রিসার্স (পিএমআর) শাখার উদ্যোগে ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের মে পর্যন্ত ৮ মাস উক্ত গবেষণা কার্যক্রমটি পরিচালিত হয়। এই গবেষণার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ২০ লাখ টাকা অর্থায়ন করে। পাশাপাশি থার্মোফিশার নামে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশি শাখা ওএমসি সহায়তা করে। সারা বিশ্বে সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে ২০ থেকে ২২ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হবে। সেখানে এই গবেষণাটি উপস্থাপন করা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এর আগে দেশে অক্টোবরের শেষের দিকে জাতীয়ভাবে এ গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হবে। সংক্রমণ রোগ হচ্ছে একজন থেকে আরেকজনে ছড়ানো এক ধরনের অদেখা রোগ। অজানা সংক্রমণ। বাংলাদেশে অসংখ্য সংক্রমণ ব্যাধিতে মানুষ আক্রান্ত হয়ে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের দিকে ঝোঁকেন। এর মধ্যে অন্তত ২১টি সংক্রমণ রোগের নাম পাওয়া গেছে। যেগুলোতে মানুষ হরহামেশা আক্রান্ত হন। এরমধ্যে রয়েছে-টাইফয়েড, পোলিও, মায়েলাইসিস, হেপাটাইটিস (এ.ডি), কলেরা, ডায়রিয়া, আমাশয় ও বিভিন্ন কৃমি। এগুলো খাদ্য ও পানীয় জাতীয় সংক্রমণ। অপরদিকে, বায়ুবাহিত সংক্রমণের মধ্যে রয়েছে যক্ষ্মা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হুপিং কাশি, মেনিনজাইটিস, নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস, ব্রংকিওলাইটিস, মাম্পস, রুবেলা, বসন্ত, হাম ও করোনা। এই ২১টি সংক্রমণ রোগ ছাড়াও অদেখা আরও বহু রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষ অর্থ খরচ করে অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে থাকে। কিন্তু কাজ না হওয়ায় চিকিৎসকের কাছে ফের যান। তাকে নতুন কোনো অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। এভাবে রোগীও একটা চেইন স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়েন। ডা. মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্তদের দেহে অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকরিতায় ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি কতটুকু সেটি দেখাই ছিল এ গবেষণার উদ্দেশ্য। এ লক্ষ্যে আমরা রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রোগীদের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এর বাইরে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিকস ও পুর্নবাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর বা পঙ্গু হাসপাতাল), ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল এবং আমাদের এনআইএলএমসিতে বিভিন্ন রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে আসা রোগীদের নমুনা নেওয়া হয়। এসব নমুনার মধ্যে রয়েছে প্রস্রাব, উন্ড সোয়াব (ক্ষত নিসঃরিত রস) পুঁজ, স্পুটাম (কফ) ও ব্রংকোএলবুলো ল্যাবেজ (শ্বাসনালি নিঃসারিত রস) ও ইনফেকটেড বডি ফ্লুইড। নমুনাগুলো নিয়ে ল্যাবে নিবিড় পরীক্ষা করা হয়। তিনি জানান, এসব হাসপাতাল থেকে ১৩ হাজার ৩৫০টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এরমধ্যে টাফেস্ট (অত্যাধিক অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ক্ষতিকর অণুজীব) অরগানিজম (যেগুলো অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট) থেকে ১ হাজার ১৪৯টা ব্যাকটেরিয়া আইসোলেট (পৃথক) করি। সেখান থেকে ২০০ ব্যাকটেরিয়াকে ভাইটেক-২ দিয়ে রি-কনফার্ম (পুনঃনিশ্চিত) করি। ভাইটেক-২ হলো সারা বিশ্বে ব্যাকটেরিয়াল অরগানিজম আইসোলেশনের অত্যাধুনিক পদ্ধতির মেশিন। সেখান থেকে ৮৩টি সর্বোচ্চ ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে আমরা সিলেক্ট করি। যেগুলো পেন ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট ছিল, অর্থাৎ যেগুলোকে কোনো ওষুধেই কাজ করছে না। সেগুলোকে আবার ডিএনএ এক্সট্র্যাকশন (পৃথক) ও রি-কনফার্ম করি। সেখান থেকে কমিয়ে ৪০টি ব্যাকটেরিয়াকে জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের জন্য নির্ধারণ করে পুনরায় ডিএনএ এক্সট্র্যাকশন করা হয়। গবেষণায় বরাদ্দ কম থাকায় সেখান থেকে আরও কমিয়ে ৩২টি ব্যাকটেরিয়া বেছে নেওয়া হয়। প্রতিটা ব্যাকটেরিয়ায় লক্ষাধিক রেজিস্ট্যান্ট জিন (অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী অণুজীব) ও অন্যান্য উপাদান থাকতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সারা বিশ্বে মাইক্রোবায়োলজি ও ইনফেকশাস ডিজিজ একটি একক সাবজেক্ট। বাংলাদেশে এখনো আলাদা কোনো সাবজেক্ট হয়নি। অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে কম কাজ হচ্ছে। ওষুধের দোকানদার, হাতুড়ে চিকিৎসক, প্রেসক্রাইব চিকিৎসক এমনকি রোগী নিজেও কিনে খাচ্ছেন। অপ্রয়োজনীয় সেবনে সেগুলোর শতভাগ কার্যকারিতা হারাচ্ছে। অন্যদিকে গত ৩০ বছর সংক্রামক রোগের নতুন মলিকুলস অফ অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার হয়নি। যে অ্যান্টিবায়োটিকগুলো আছে শুধু সেগুলোর জেনারেশনকে এক্সটেনশন করে বাজারে ছাড়া হচ্ছে। এখন অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার সীমিত ও সঠিক রাখতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী কোনোভাবেই ব্যবহার করা যাবে না।