রাইস ব্রান তেলের কাঁচামাল চলে যাচ্ছে ভারতে

প্রকাশিতঃ সেপ্টেম্বর ৭, ২০২৩ | ৯:৪৬ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা পূরণে পর্যাপ্ত কাঁচামাল রয়েছে। ধানের কুঁড়া থেকে তৈরি রাইস ব্রান তেল দিয়ে এ চাহিদা মেটানো সম্ভব। এতে একদিকে যেমন আমদানি নির্ভরতা কমবে তেমনিভাবে বছরে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। একই সঙ্গে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। কিন্তু দেশে বিপুল পরিমাণ রাইস ব্রান তেলের কাঁচামাল হাতের নাগালে থাকলেও তেল উৎপাদনে পর্যাপ্তসংখ্যক অয়েল মিল নেই। ফলে রাইস ব্রান তেলের কাঁচামাল বৈধ ও অবৈধপথে ভারত চলে যাচ্ছে। দেশটি বাংলাদেশের কাছ থেকে নেওয়া কাঁচামালে রাইস ব্রান তেল উৎপন্ন করে নিজেদের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করে লাভবান হচ্ছে। জানতে চাইলে সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, আমাদের কাঁচামাল নিয়ে ইন্ডিয়া রাইস ব্রান তেল উৎপাদন করে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করে। আর আমরা ভোজ্যতেল আমদানি করি। আমদানিতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়। অথচ মিল স্থাপন করে উৎপাদনে গেলে তেলের স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি সম্ভব। এছাড়া হাজারো বেকারের কর্মসংস্থান হবে এ খাতে। সম্ভাবনার নতুন দরজা উন্মুক্ত হবে। আনোয়ার ফারুক বলেন, বিশ্বব্যাপী অলিভ অয়েলের পরই রাইস ব্রান তেলের স্থান। সরিষার তেল তৃতীয় স্থানে। রাইস ব্রান তেল জনস্বাস্থ্য ও স্বার্থের অনুকূলে। বিষয়টি সরকারকেই বেশি চিন্তা করতে হবে। তিনি সতর্ক করে বলেন, বিশ্বের অধিকাংশ দেশ এখন নিজেদের খাদ্য মজুতে তৎপর। আগামী দিনে ডলার থাকলেও খাদ্যদ্রব্য পাওয়া যাবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং আমদানির মানসিকতা পরিহার করে উৎপাদনে মনোযোগী হতে হবে। চাহিদা স্থানীয় উৎপাদন থেকে মেটাতে হবে। অবহেলা করলেই বিপড় বাড়বে বৈ কমবে না। তিনি আরও বলেন, সয়াবিনের পরিবর্তে রাইস ব্রান তেলের মিল স্থাপন করতে গেলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। প্রাথমিকভাবে ব্যাংক ঋণ ও প্রণোদনা দিয়ে উদ্যোক্তাদের সরকারকে সহায়তা করতে হবে। এক প্রশ্নের উত্তরে সাবেক কৃষি সচিব বলেন, আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানিকে ঋণ দিয়ে সহায়তা করে। বলতে পারেন এ খাতে তারা মনোপলি বাণিজ্য করছে। কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার বলেন, রাইস ব্রান তেল উৎকৃষ্টমানের। অলিভ অয়েলের পরই এই তেলের স্থান। যা জনস্বাস্থ্যের জন্য উত্তম। কিন্তু পর্যাপ্ত সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও আমরা উৎপাদন বাড়াতে পারছি না। হাতেগোনা কয়েকটি মিল হয়েছে। যা চাহিদার তুলনায় খুবই নগণ্য। তিনি আরও বলেন, রাইস ব্রান তেলের চাহিদাও কম। তাই এর কাঁচামাল ভারতে চলে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, কতটুকু পারব জানি না, তবে আমাদের ভালো কিছু করার পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি এর চেয়ে বেশিকিছু মন্তব্য করতে চাননি। এদিকে বাংলাদেশ কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের চালের কুঁড়া থেকে ভোজ্যতেল উৎপাদনের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও করণীয় শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে বার্ষিক ভোজ্যতেলের চাহিদা ১৪ লাখ টন। উৎপাদন হয় গড়ে ৩ লাখ টন। অবশিষ্ট তেল আমদানি করা হয়। ধানের কুঁড়া থেকে তেল উৎপাদনের উদ্যোগ নিলে বছরে সাড়ে সাত লাখ টন তেল দেশেই উৎপাদন করা সম্ভব। এতে বলা হয়, সয়াবিন তেলের পাশাপাশি মানুষ এখন রাইস ব্রান অয়েলের দিকে ঝুঁকছে। কারণ এ তেল সয়াবিনের চেয়ে বেশি স্বাস্থ্যকর। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১৭ হাজারের বেশি রাইস মিল রয়েছে। এর মধ্যে ৬০০টি অটোরাইস মিল এবং ৪০০টি সেমি অটোরাইস মিল। বাকিগুলো ম্যানুয়াল পদ্ধতির রাইস মিল। প্রতিটি অটোরাইস মিল থেকে প্রতিদিন গড়ে ছয় টন ধানের কুঁড়া উৎপন্ন হয়। সে হিসাবে ৬০০ অটোরাইস মিল থেকে দিনে তিন হাজার ৬০০ টন ধানের কুঁড়া উৎপন্ন হয়। এ হিসাবে বছরে অটোরাইস মিল থেকে ১৩ লাখ ১৪ হাজার টন ধানের কুঁড়া উৎপন্ন হয়। অন্যদিকে প্রতিটি সেমি অটোরাইস মিলে প্রতিদিন গড়ে ৩ দশমিক ৮০ টন চালের কুঁড়া উৎপন্ন হয়। সে হিসাবে ৪০০টি সেমি অটোরাইস মিল থেকে বছরে পাঁচ লাখ ৫৪ হাজার ৪০০ টন ধানের কুঁড়া উৎপন্ন হয়। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ১৬ হাজার সাধারণ রাইস মিল। প্রতিটি সাধারণ রাইস মিল থেকে প্রতিদিন গড়ে এক টন ধানের কুঁড়া উৎপন্ন হয়। সে হিসাবে প্রতিদিন এসব সাধারণ রাইস মিল থেকে ১৬ হাজার টন ধানের কুঁড়া উৎপন্ন হচ্ছে। সে হিসাবে বছরে ২৮ লাখ ৮০ হাজার টন কুঁড়া উৎপন্ন হচ্ছে। আর সবমিলে দেশে বছরে কুঁড়া ৪৭ লাখ ৪৮ হাজার ৪০০ টন উৎপন্ন হচ্ছে। ধানের কুঁড়াকে তেলের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে-পলিশ, সেমি অটো পলিশ, নোটিং পলিশ ও চাকি। পলিশে শতকরা ২৫-২৬ শতাংশ, সেমি অটো পলিশে ১৬-১৮ শতাংশ, নোটিং পলিশে ১৪-১৫ শতাংশ এবং চাকিতে ৮-১০ শতাংশ তেল পাওয়া যায়। এ হিসাবে ধানের কুঁড়া থেকে বছরে সাত লাখ ১০ হাজার ৮১৬ টন ভোজ্যতেল উৎপাদন করা সম্ভব। উৎপাদিত এ তেল দিয়ে দেশের চাহিদার ৫০ শতাংশ মেটানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ৬-৭ লাখ টন ভোজ্যতেল আমদানির প্রয়োজন হবে না। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশে স্থাপিত প্রায় ১৭ হাজার রাইস মিলকে সরকারি ও বেসরকারি উপায়ে ধানের কুঁড়া দিয়ে তেল উৎপাদনে উপযোগী করা গেলে বছরে প্রায় ২২ লাখ টন ভোজ্যতেল উৎপাদন করা সম্ভব। তখন দেশের ধানের কুঁড়াকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা যাবে। তখন এ তেল থেকে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করাও সম্ভব হবে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের পুষ্টি উন্নয়ন কর্মকর্তা প্রণব কুমার সাহা বলেন, আমি চাকরিতে যোগদানের আগে চালের কুঁড়া থেকে ভোজ্যতেল উৎপাদনের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও করণীয় শীর্ষক একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। যিনি প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন তিনি অবসরে গেছেন। বর্তমানে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরে এ সংক্রান্ত কোনো কাজ নেই। তবে সংস্থাটির একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, বাড়তি দামের সয়াবিন তেলের বিকল্প হতে পারে রাইস ব্রান তেল। প্রতি লিটার রাইস ব্রান অয়েল উৎপাদনে ১৪০-১৫০ টাকা খরচ পড়ে। এটা খুচরা বাজারে কোম্পানি ভেদে ১৬০-১৬৫ টাকায় বিক্রি করা হয়। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, ভোজ্যতেলে যেসব খাদ্যগুণ থাকা উচিত তা অলিভ অয়েলের পর সবচেয়ে বেশি রয়েছে রাইস ব্রান অয়েলে। এ তেল শরীরের কোলস্টেরলের মাত্রা কমায়। এ তেল নানা ধরনের রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী শক্তি গড়ে তোলে । শারীরিক শরীর সুস্থ রাখতে সরিষার চেয়ে এ তেল কার্যকর ভূমিকা রাখে। রাইস ব্রান হচ্ছে ধানের ওপরের শক্ত আবরণের নিচে চালের ওপরের পাতলা মেমব্রেন যা আমাদের দেশে চালের কুঁড়া নামে পরিচিত। অর্থাৎ ধান ভাঙলে ধানের ওপরের শক্ত আবরণ থেকে বের হয় ভূষি এবং মেমব্রেন থেকে বের হয় কুঁড়া। রাইস ব্রান থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংগৃহীত ও পরিশোধিত ভোজ্যতেলই হচ্ছে রাইস ব্রান অয়েল। তবে ভিন্ন তথ্য দিলেন, ওয়েস্ট্রার্ন অ্যাগ্রো প্রডাক্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আব্দুল আজিজ বলেন, দেশে রাইস ব্রান তেলের কাঁচামালের অভাবে ইতোমধ্যে স্থাপিত মিলগুলো বন্ধ হতে বসেছে। লাভও আগের মতো নেই। আমরা শ্রমিকদের বেতন ও ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে পারছি না। তার এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন যারা ব্যবসা শুরু করেছেন তারা চাচ্ছেন না আর কেউ রাইস ব্রান তেল উৎপাদনে যুক্ত হউক। এটা এক ধরনের মনোপলি মানসিকতা। তাদের কারণে রাইস ব্রান তেল ব্যাপকভাবে উৎপাদন বিপণন করা যাচ্ছে না। ফলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ভোজ্যতেল আমদানিতে চলে যাচ্ছে। এসিআই অ্যাগ্রো বিজিনেস লিমিটেডের প্রেসিডেন্ট ড. এফএইচ আনসারী বলেন, দেশে রাইস ব্রান তেলের কাঁচামালের কোনো সংকট নেই। তেলের মান নিয়েও কোনো প্রশ্ন নেই। সমস্যা হচ্ছে আমাদের দেশের মানুষ রাইস ব্রান তেল খেয়ে অভ্যস্ত নন। দেশের বাজারে এ তেলের চাহিদা কম। এর ফলে যা উৎপাদন হয় তার সিংহভাগ চলে যায় ভারতে। তাছাড়া অপরিশোধিত তেলও ভারতে চলে যায়। তিনি আরও বলেন, যে পরিমাণ কাঁচামাল দেশে রয়েছে তা সঠিক ব্যবহার করলে বছরে ২০ থেকে ২২ লাখ টন ভোজ্যতেল উৎপাদন সম্ভব। তখন আমরা রপ্তানিও করতে পারবে।