একের পর এক আধুনিক ব্যবস্থা আসছে বাংলাদেশ রেলে। এবার পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ঢাকা-ভাঙ্গা সরাসরি ট্রেন সার্ভিস চালু হচ্ছে। নতুন এই রেলপথে ১২০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার গতি নিয়ে ট্রেন চলবে। প্রায় ১৭ কিলোমিটার উড়াল রেলপথ ধরে পদ্মা সেতু পাড় হবে এই ট্রেন। ঢাকা-ভাঙ্গা ৮২ কিলোমিটার রেলপথ। আজ এ পথে পরীক্ষামূলক চূড়ান্তভাবে ৫ শতাধিক যাত্রী নিয়ে ট্রেনে চড়বেন রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজনও। ১০ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নতুন এ রেলপথের শুভ উদ্বোধনের কথা রয়েছে। এদিকে নতুন পথে যাত্রীবাহী ট্রেন পরিচালনায় সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করছেন রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ দুটি ভাগে হচ্ছে। প্রথমটি ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ১০ অক্টোবর উদ্বোধনের কথা। দ্বিতীয়টি আগামী বছরের জুনের মধ্যে উদ্বোধন হবে। এ পথে যাত্রীবাহী ট্রেন চালাতে সংগ্রহ করা হয়েছে অত্যাধুনিক ইঞ্জিন ও যাত্রীবাহী কোচ। চলমান যাত্রী ভাড়া অপরিবর্তিত রেখেই নতুন এ পথে অত্যাধুনিক ছয়টি ট্রেন চালানোর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। তবে ভাড়া না বাড়ালেও নিয়ম অনুযায়ী পদ্মা সেতুর নিচে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার রেলপথ পাড় হলে যাত্রীপ্রতি যোগ হবে ১২০ কিলোমিটারের ভাড়া। ট্রেন ও সিটের ধরন অনুযায়ী প্রতি কিলোমিটারের জন্য ৩৯ পয়সা থেকে ১ টাকা ১৭ পয়সা টিকিটের প্রকৃত ভাড়ার সঙ্গে অতিরিক্ত যোগ হবে। যমুনা সেতুসহ আরও অন্তত তিনটি সেতু হয়ে চলা ট্রেন যাত্রী ভাড়ার সঙ্গে অতিরিক্ত ভাড়া যুক্ত হচ্ছে। রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন জানান, রেলে বর্তমান সরকার ব্যাপক উন্নয়ন করছে। অত্যাধুনিক ইঞ্জিন-কোচ রেলবহরে যুক্ত হচ্ছে। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত নতুন এ প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ প্রকল্প। নতুন এ পথে ১২০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার গতি নিয়ে ট্রেন চলবে। বৃহস্পতিবার এ পথে চূড়ান্তভাবে পরীক্ষামূলক যাত্রীবাহী ট্রেন চালানো হবে। এর আগেও বেশ কয়েকবার ট্রেন ট্রায়াল রান করা হয়েছে। দেশবাসীর জন্য নতুন এ রেলপথটিও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপহার। ১০ অক্টোবর স্বপ্নের এ রেলপথ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন-এমনটা আমরা আশা করছি। দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথটিও প্রধানমন্ত্রীর ১০টি বিশেষ প্রকল্পের একটি। এ প্রকল্পটিও তিনি দ্রুত উদ্বোধন করবেন। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নজরে রেলে আমূল পরিবর্তন আসছে। রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলী মঙ্গলবার বলেন, ‘ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত নতুন এ ডুয়েলগেজ লাইন রেলে সবচেয়ে লাভবান হবে। এ পথেই ভারতীয় যাত্রী ও মালামালবাহী ট্রেন চলবে। গতি উঠবে ১৩০ কিলোমিটার। সময়ও বাঁচবে, সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। আমরা প্রস্তুত, নির্দেশনা অনুযায়ী যাত্রীবাহী ট্রেন চালাতে নতুন ট্রেনও প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এ পথে তিন জোড়া যাত্রীবাহী ট্রেন চালানো হবে।’ বিভিন্ন ট্রেনের ভাড়া অপরিবর্তিত থাকবে কি না-এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ভাড়া বাড়ানো হবে না। তবে নিয়ম অনুযায়ী কোনো সেতু হয়ে ট্রেন চলাচল করলে যাত্রীপ্রতি অতিরিক্ত ভাড়া যুক্ত হয়। একই সঙ্গে নির্ধারিত দূরত্বের পর অতিরিক্ত ভাড়া কমেও যায়।’ এদিকে মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আজ চূড়ান্তভাবে ট্রায়ালে যাওয়া বিশেষ ট্রেনটি সকাল ৯টায় কমলাপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে রাজধানীর শ্যামপুর হয়ে ১৭ কিলোমিটার উড়াল রেলপথ পাড় হয়ে পদ্মা সেতু অতিক্রম করবে। আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর পর থেকে কমলাপুর থেকে পর্যায়ক্রমে ছয়টি ট্রেন ভাঙ্গা হয়ে পুনরায় ঢাকায় আসবে। আধুনিক ট্রেনগুলোয় যাত্রীদের বিনোদন-তথ্য প্রদানে মাল্টিমিডিয়া মনিটর থাকছে। বলা হচ্ছে বর্তমান সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় পদক্ষেপগুলোর মধ্যে আধুনিক লাইনে অত্যাধুনিক ট্রেন পরিচালনাও অন্যতম। জানা যায়, বাংলাদেশ রেল দেশজুড়ে বিস্তৃত হচ্ছে। বর্তমানে ৩৪টি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা-যশোর প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ৩ মে অনুমোদন হয়। পুরো প্রকল্পটি আগামী বছরের জুনে শেষ হচ্ছে। এদিকে পদ্মা সেতু দিয়ে রেলপথ স্থাপন করায় ট্রেন চলাচলে টোল চাচ্ছে সেতু কর্তৃপক্ষ। ৩৫ বছরে রেলওয়ের পক্ষ থেকে সেতু কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে ছয় হাজার ২৫২ কোটি টাকারও বেশি। আর সেতু চালুর প্রথম বছরেই দিতে হবে ১০৬ কোটি টাকা। এ প্রসঙ্গে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী জানান, প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার বঙ্গবন্ধু রেলসেতু হয়ে ট্রেন চলাচল করছে। ওই সেতু হয়ে প্রতিদিন প্রায় ২৪টি ট্রেন চলছে। টোল হিসাবে রেলপ্রতি বছরে এক কোটি টাকা প্রদান করছে। পদ্মা সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল করলে সেতু বিভাগ ৩৫ বছরে ৬২৫২ কোটি টাকা চেয়েছে। এমন দাবি করা প্রস্তাবটি যুক্তিসংগত ও বাস্তবধর্মী নয়। পদ্মা সেতুর নিচে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। সেই অনুযায়ী বছরে দেড় কোটি টাকা নিতে পারে। কিন্তু তাদের দাবি অনুযায়ী বছরে ১৭৮.৬৭ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. আফজাল হোসেন জানান, এর আগে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা-মাওয়া-ঢাকা পর্যন্ত বেশ কয়েকবার যাত্রীবাহী ট্রেনের ট্রায়াল রান হয়েছে। দেশে উড়াল রেলপথ স্থাপন এই প্রথম সম্পন্ন করা হয়েছে। উড়াল পথ ধরে ট্রেনটি ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পৌঁছাবে। বৃহস্পতিবার রেলপথমন্ত্রীসহ সংসদীয় কমিটির সদস্য এবং সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা চূড়ান্ত ট্রায়ালে নতুন রেলপথটি পরিদর্শন করবেন। আমরা এ পথে ১২০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার গতি নিয়ে ট্রেন চালাব। নতুন ইঞ্জিন-কোচ অত্যাধুনিক। এ পথে অন্তত ১২ জোড়া ট্রেন অনায়াসে চালানো যাবে। আন্তর্দেশীয় যাত্রীবাহী ও মালবাহী ট্রেনও চলবে এ পথে। রেলওয়ে মহাপরিচালক প্রকৌশলী কামরুল আহসান বলেন, যাত্রীসেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে নতুন এ রেলপথে বেশ কয়েকবার ট্রেনের ট্রায়াল রান করা হয়েছে। আমরা প্রস্তুত আছি। সেতু বিভাগের দাবি, নিশ্চয় আলোচনা করে সমাধান করা হবে। আমাদের আনন্দের বিষয় হচ্ছে, আগামী মাসে স্বপ্নের এ রেলপথে আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রেন চালাতে পারব। ভাঙ্গা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে কমলাপুর গেল ট্রায়াল ট্রেন : ভাঙ্গা (ফরিদপুর) প্রতিনিধি জানান, বুধবার বেলা ১টায় ফরিদপুর থেকে ভাঙ্গা হয়ে পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকা কমলাপুর পর্যন্ত গেল নতুন একটি ট্রায়াল ট্রেন । ট্রেন চলাচলকে ঘিরে সবার মধ্যে চলছে উৎসবের আমেজ। ফরিদপুর রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মো. তাকদির হোসেন জানান, বুধবার পৌনে ১২টার দিকে রাজবাড়ী থেকে ফরিদপুর এসে পৌঁছায়। এখানে ১ মিনিট বিরতি শেষে ফরিদপুর থেকে ভাঙ্গা হয়ে ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনের উদ্দেশে ছেড়ে যায় ট্রেনটি। এর আগে মঙ্গলবার সকাল পৌনে ১০টার সময় ঈশ্বরদী থেকে ট্রায়াল ট্রেনটি রাজবাড়ী এসে পৌঁছায়। সেখানে রাত্রিযাপন শেষে রাজবাড়ী থেকে বেলা ১১টায় ফরিদপুরের উদ্দেশে ছেড়ে আসে। ট্রেনটির চালক হিসাবে রয়েছেন আবুল কাশেম; আর পরিচালনার দায়িত্বে আছেন মো. সানাউল্লাহ। ভাঙ্গা স্টেশন মাস্টার মো. শাহজাহান মিয়া জানান, ট্রেনটিতে ৮টি কোচ ও ১টি ইঞ্জিন রয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার সময় রেলপথমন্ত্রীসহ রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঢাকা কমলাপুর থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গায় আসবেন। পরে বামনকান্দা রেলস্টেশন থেকে আবার ঢাকা ফিরে যাবেন।