উপরে পরিচ্ছন্ন ফ্লাইওভার। আর নিচে ময়লা-আবর্জনা, টেম্পো-বাস-ট্রাক-রিকশা-ভ্যান স্ট্যান্ড, থাকার ঘরবাড়ি, দোকানপাট, হাস-মুরগির হাটবাজার সবই আছে। শুধু নেই পথচারীদের চলাচলের রাস্তা আর ফুটপাত-সব দখল হয়ে গেছে। ভুক্তভোগী এলাকাবাসী জানান, ফুটপাত দখল হওয়াতে রাস্তা পারাপারে ঝুঁকি নিয়ে চলতে হয়। এছাড়াও প্রতিদিন রাতের আঁধারে ফ্লাইওভারের নিচের অংশে কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে। কাপ্তানবাজারের মুরগিপট্টি ভেঙে নতুন মার্কেট নির্মাণের কাজ শুরুর পর থেকে বিগত কয়েক বছর ধরে হানিফ ফ্লাইওভারের ঢালে প্রায় কোয়ার্টার কিলোমিটার রাজপথ দখল করে চলছে এ অবৈধ মুরগির হাটবাজার। সরেজমিন দেখা যায়, রাস্তার ওপর মুরগিভরা পিকআপ ভ্যানের সারি। স্তূপ করে রাখা হয়েছে আড়তের বর্জ্য। বাতাসে উড়ছে হাঁস-মুরগির পালকের ক্ষুদ্রাংশ। আড়তের ঝাঁকাগুলো মুরগি, হাঁসে পূর্ণ। ঝাঁকাগুলো তুলে নিয়ে যাচ্ছেন ভ্যানে। পথচারী ও এলাকাবাসী চলাচল করছেন রুমাল দিয়ে নাক চেপে। স্থানীয়রা জানান, মুরগি-ছাগলের এই হাটের কারণে এলাকায় বসবাস করা দায়। জানা গেছে, হানিফ ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ শুরুর পর থেকে প্রায় এক যুগ ধরে চলছে এই অবৈধ হাঁস-মুরগি-ছাগলের পাইকারি বাজার। স্থানীয় কিছু রাজনীতিবিদ ও সিটি করপোরেশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে চলে এ হাটটি। এই হাট থেকে দিনের পর দিন অবৈধ আয় করে যাচ্ছেন তারা। এতে একদিকে সরকার যেমন লাখ লাখ টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে জনস্বাস্থ্য পড়ছে চরম হুমকির মধ্যে। প্রতিদিন রাত ২টা থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কাপ্তানবাজারসংলগ্ন হানিফ ফ্লাইওভারের ঢাল (যাত্রাবাড়ী থেকে গুলিস্তান নামার র্যাম্প) থেকে শুরু করে ফুলবাড়িয়া মার্কেটের সামনে পর্যন্ত রাজপথে আনলোড করা হয় পোলট্রি মুরগি বোঝাই ট্রাক। ভোর পর্যন্ত রাজপথ দখল করে চলে এ মুরগির পাইকারি ব্যবসা। এতে রাস্তার ওপর পড়ে থাকছে মরা মুরগি, মুরগির বিষ্টাসহ নানা আবর্জনা। ওই এলাকার বাতাসে ছড়াচ্ছে ইনফ্লুয়েঞ্জার জীবাণু। বাসযাত্রী থেকে শুরু করে পথচারীরা সারা দিন এগুলো মাড়িয়ে এ সড়ক দিয়ে হেঁটে কেউ যাচ্ছেন বাড়ি, আবার কেউ যাচ্ছেন অফিসে। ফলে অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের ভাইরাসজনিত রোগে। নিজের অজান্তেই আবার অনেকে এসব জীবাণু ছড়াচ্ছেন বিভিন্ন স্থানে। সারা দিনই সড়কটিতে মরা মুরগি ও কুকুরের ফেলে যাওয়া মুরগির হাড়গোড় পড়ে থাকতে দেখা যায়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের মাঝেমধ্যে নামকাওয়াস্তে ঝাড়ু দিতে দেখা গেলেও সড়কে লেপ্টে থাকা মুরগির বিষ্টা ও আবর্জনা এতে পরিষ্কার হয় না। পানি দিয়ে পরিষ্কার না করায় সারা দিন দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে এগুলো থেকে। সিটি করপোরেশনের নামে একটি গ্রুপ প্রতিদিন গাড়িপ্রতি চাঁদা নিয়ে গেলেও এসব টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হচ্ছে কিনা এ ব্যাপারে কোনো নজরদারি নেই। এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী বলেন এ বিষয়ে আমার জানা নেই। আমরা এসটিএসের (ময়লার জন্য নির্ধারিত স্থানান্তর কেন্দ্র) বাইরে শুধু রাস্তা এবং ড্রেনের ময়লা সরিয়ে থাকি এর বাইরে ফ্লাইওভারের নিচের ময়লার বিষয়টি জানি না। এ বিষয়ে আপনি প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা চিকিৎসক সহকারী অধ্যাপক ডা. আ জ ম দৌলত আল মামুন বলেন, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বার্ডফ্লুতে আক্রান্ত মুরগির বিষ্টা থেকে ছড়ায় নানা ভাইরাসজনিত রোগ। এতে শ্বাসকষ্টসহ ফ্লুর ভাইরাস ছড়ানোর মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে। এমনিতেই বিশ্বের দূষিত বাতাসের নগরীর তালিকায় প্রায়শই শীর্ষে অবস্থান করছে রাজধানী ঢাকা। তার ওপর এভাবে রাজপথে মুরগির বিষ্টাসহ আবর্জনা ফেলে রাখলে তা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কাপ্তানবাজার মুরগি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. বাচ্চু মিয়া বলেন, এখানে হাটের বিষয়ে আমরা বলতে পারি না। বলতে পারবে ৩৮নং ওয়ার্ড কমিশনার আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফী গৌরব। পরে তাকে জিজ্ঞাসা করা হয় আপনারা কি তাকে এই হাটের জন্য চাঁদা প্রদান করেন তখন তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, দেখেন আমি ফোনে কোনো কথা বলতে চাই না আর আমি এখন একটা মিটিংয়ে আছি পরে কথা বলব। একজন জানান, এখানে কমিশনারের লোকজন চাঁদা উঠায়। অভিযোগের বিষয়ে ৩৮নং ওয়ার্ড কমিশনার আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফী গৌরব বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। বাচ্চু নামের কেউ সভাপতি আছে সেটাই আমার জানা নেই। একটা পক্ষ আমার বিরুদ্ধে এসব মিথ্যা তথ্য প্রদান করছে। ডেঙ্গুর প্রকোপ কমানোর জন্য আমি দিনরাত আমার ওয়ার্ডের আনাচে-কানাচে কাজ করছি। আর এই ধরনের হাট বসাব আমি! এগুলো সবই অপপ্রচার। ২০১৩ সালের অক্টোবরে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হয় মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার। চার লেনের এই উড়ালসড়ক শনির আখড়া থেকে বকশীবাজার মোড় পর্যন্ত বিস্তৃত। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে এটি নির্মাণে বিনিয়োগকারী ছিল একটি প্রতিষ্ঠান। আর সার্বিক তত্ত্ববধান করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। মূল নকশায় ফ্লাইওভারের নিচে উঁচু বিভাজকে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ফুল গাছের চারা রোপণের পরিকল্পনা থাকলেও নেই কোনো সৌন্দর্যবর্ধনের ছিটেফোঁটা। এখানে রীতিমতো ব্যবসা খুলে বসেছেন স্থানীয় কমিশনারের বিভিন্ন লোকজন। অস্থায়ী ভিত্তিতে দৈনিক চাঁদার ভিত্তিতে এসব দোকান চলছে। সঠিক নজরদারি ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অবৈধভাবে দখল হয়ে আছে এসব জায়গা। বেশিরভাগ জায়গায় টেম্পো স্ট্যান্ড থেকে শুরু করে ঘর তুলে বসবাস করছেন সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। এসব দখলদারিত্বকে অবৈধ বললেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি নগর কর্তৃপক্ষ। এসব অংশের রাস্তা দখল করে আছে বিভিন্ন দোকানপাট। টিকাটুলী ফ্লাইওভারের নিচের অংশে ছিন্নমূল মানুষের বসবাস। ফুলবাড়িয়া অংশে ঘোড়ার আস্তাবল ও ময়লার ভাগাড়। ঘোড়ার বিষ্ঠা আর পাশের মুরগির বাজারের বর্জ্যরে দুর্গন্ধে রাস্তায় চলা দায়। রাজনৈতিক নেতাদের নাম ভাঙিয়ে উড়ালসড়কের নিচে ইটের দেওয়াল দিয়ে বানানো হয়েছে গোডাউন ও মুরগির দোকান। গুলিস্তানের অংশে নিয়মিত বসে জুতার দোকানের পসরা। ডিএসসিসির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, ফ্লাইওভারের নিচের জায়গাগুলো দখলে থাকার বিষয়টি তার জানা নেই। যদি কেউ দখল করে থাকে তবে দ্রুত সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। তিনি আরও জানান, মেয়র মহোদয় উক্ত জায়গা একাধিকবার পরিদর্শন করে নতুন ভাবে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। সেই আলোকে সব ডিজাইন কমপ্লিট হয়েছে। অচিরেই সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ শুরু হয়ে যাবে এবং অন্য কোনো ব্যক্তি বা বস্তু নিয়ে কেউ বসতে পারবে না এবং শুধু সৌন্দর্যবর্ধনই হবে।