ঘড়ির কাঁটা ধরে ছুটলে জি-২০ সম্মেলন আর মাত্র ২৪ ঘণ্টা দূরে। অপেক্ষার জংশন থেকে কাছে আসতে আসতে একেবারেই হাতের নাগালে। আজকের সূর্যটা ডুবে কালকের দিনমান উঠতে যতটুকু দেরি, তারপরেই শুরু হয়ে যাবে বিশ্বনেতাদের মহামিলনের ডামাডোল। পূবাকাশে ডানা মেলবে ভারতের নতুন ইতিহাসের পাখি। শুধুই কি ভারত? দেশ-দলের সীমানা ছাড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উঠানেও ‘বসন্তের রোদ’ হয়ে ঝিকিমিক করছে স্বপ্নপূরণের সেই সূর্যতোরণ। মোদির উত্তরীয়তে এখন নতুন হাওয়া, অলিগলি থেকে রাজপথ সবখানেই নতুন নাম; বিশ্বগুরু। সমালোচনার ফোসকাও নেহায়েত কম পড়ছে না গায়ে। বিরোধী, বিশেষজ্ঞ, সুশীল পশ্চিমা গণমাধ্যম সবার টেবিলেই ঘুরেফিরে একই পেয়ালা এক ঢিলে তিন পাখি মারছেন মোদি। প্রথমত, জি-২০ সম্মেলনের ঢাকঢোলে মূলত নির্বাচন সামনে রেখে ভোটের প্রচার করছেন। দ্বিতীয়ত, বিশ্বনেতৃত্বে নিজেকে নতুন করে তুলে ধরছেন। তৃতীয়ত, সৌন্দর্যবর্ধন, জমকালো আয়োজন ও চোখ ধাঁধানো নিরাপত্তা দেখিয়ে ভারতের সক্ষমতা প্রচার করছেন। এপি, ব্লুমবার্গ, টাইমস অব ইন্ডিয়া, গার্ডিয়ান, আলজাজিরা। রাজধানী দিল্লির আনাচে-কানাচে চোখ ঘোরালেই বিজেপির পোস্টার। রাস্তাঘাট, বিলবোর্ড, ফুটপাথ, ব্রিজ, রিকশা বা বাস, নরেন্দ্র মোদির মুখ না দেখে দিল্লিতে দু-পা পাড়ি দেওয়াও এখন কঠিন। দেশের টাকায় চলছে দলের প্রচার। দেশটির নামিদামি গণমাধ্যমগুলোর প্রথম সারিতেই উঠে আসছে মোদির এই নতুন ‘অবয়ব’। জি-২০ আয়োজনের এ ক’মাসেই আরেকটি নতুন তকমা পেয়েছেন ‘বিশ্বগুরু’ হিসাবে। দলীয় ক্ষমতাকে আরও এক দশক প্রসারের লক্ষ্যে আগামী বছরের নির্বাচনের অনানুষ্ঠানিক প্রচারণারই যেন শুরু হলো। খবরপাড়ার খবর, ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে, নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য মোদি অত্যন্ত ব্যক্তিগত প্রচারণা চালিয়েছেন। প্রচারণামূলক বক্তৃতা দিয়েই, একজন চা বিক্রেতার ছেলে থেকে হয়ে উঠেছেন আজকের নরেন্দ্র মোদি। ওয়াশিংটর পোস্ট, নিউইয়র্ক টাইমস। ব্রিকস সম্মেলনের মতো এবারে জি-২০ সম্মেলনের প্রতীকেও রয়েছে তার এই ভোট প্রচারের সুস্পষ্ট প্রমাণই। জি-২০’র ভূগোলোকে বসিয়েছেন নিজের দলীয় প্রতীক বিজেপির ‘পদ্মফুল’। গত বছরের ৮ নভেম্বর পদ্মকে সম্মেলনের প্রতীক হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছিল। একটি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে লোগোটি উন্মোচন করেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দলের প্রচারের বাড়তি আকর্ষণেই এটি যোগ করেন তিনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঘোষ বলেছেন, ‘জি-২০ প্রচার মোদির অধীনে ভারত আরও গভীর সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। যেমন, গণতন্ত্রের পিছিয়ে পড়া, মানবাধিকার কর্মীদের ওপর বিধিনিষেধ, ভিন্নমতকে কারাগারে বন্দি এবং মিডিয়ার মুখ বন্ধ করা। তবুও, শীর্ষ সম্মেলন মোদির জন্য উপকারী হবে।’ ঘোষ আরও বলছিলেন, ‘তিনি রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ ঘষবেন। অন্যান্য বিশ্বনেতাদের সঙ্গে থাকবেন। আমি মনে করি এটি তাকে ২০২৪ সালের নির্বাচনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।’ বেশ কয়েকটি এ ২০ শীর্ষ সম্মেলনে ভারতীয় কথোপকথন হিসাবে কাজ করা আলোক শীল বলেছেন, ‘আমি প্রথম সাতটি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলাম তবে আমি এত প্রচার দেখিনি। ভারতের রাষ্ট্রপতির সাফল্য নিয়ে বর্তমানে একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন রয়েছে কারণ এটিই হতে পারে প্রথম শীর্ষ সম্মেলন যেখানে কোনো চুক্তি নেই।’ দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের পররাষ্ট্রনীতির অধ্যাপক হ্যাপিমন জ্যাকব বলেন, ২০২৪ সালের নির্বাচনে, মি. মোদি নিজেকে একজন বিশ্ব রাজনীতিবিদ হিসাবে, এমন একটি দেশের নেতা হিসেবে তুলে ধরতে চান যাকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আরও সম্মানিত এবং গুরত্ব সহকারে নেবে।’ তবে জি-২০ ইস্যুতে মোদির বিরুদ্ধে ছড়িয়ে পড়া সমালোচনা প্রসঙ্গে পার্টির সিনিয়র নেতা এবং ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনের সভাপতি বিনয় সহস্রবুদ্ধে বলেছেন, ‘বিজেপির রাজনৈতিক এজেন্ডার সঙ্গে জি-২০র কোনো সম্পর্ক নেই, যদিও একটি জিনিস অন্যটিকে প্রভাবিত করতে পারে। সমালোচকরা বারবার চেষ্টা করেছেন বৈশ্বিক নেতা হিসাবে তার ভাবমূর্তি নষ্ট করতে কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন।’ ১৯৮০ সালে সাবেক জনসংঘ পার্টির সদস্যরাই বিভক্ত হয়ে ‘বিজেপি’ গঠন করেন। দলটি পরপর দু’বার জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ইন্ডিয়া টুডের করা সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও দলটি নিয়ে সাধারণ জনগণের রয়েছে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। জরিপে প্রায় ৫২ শতাংশ জনতাই মোদিকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেখতে চান। ক্রমাগত রাজবংশীয় রাজনীতি এবং ভারতের বুদ্ধিজীবী অভিজাতদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং জনসাধারণের রান্নার গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং টয়লেটের মতো মৌলিক জিনিসগুলোতে সহজীকরণের মাধ্যমেই ক্ষমতায় এসেছেন মোদি সরকার। ভারতের ৮০ শতাংশ হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করছেন। তবে মুসলিম এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বৈষম্য এবং সহিংসতা স্পষ্ট দেশটিতে। বিষয়টি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্যকে কলুষিত করে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের বিষয়টিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। ইয়েল ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের সিনিয়র ফেলো এবং গেস্ট লেকচারার সুশান্ত সিং বলেছেন, ‘মোদি ভারতের পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে আরও প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন এবং কোনো না কোনোভাবে দেখাতে চেয়েছেন যে তিনি দেশের জন্য সব দুর্দান্ত জিনিসগুলো অর্জন করেছেন।’ তার সমর্থকরা তাদের নেতা সম্পর্কে ভালো বোধ করেন এবং বলেন, ‘দেখুন এই লোকটি দেশের জন্য কী করেছে, যা আগে কেউ করতে পারেনি।’