বিয়ের নামে ফেসবুকে ভয়ংকর ফাঁদ

প্রকাশিতঃ সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৩ | ৯:০৭ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

কখনো কাশফিয়া চৌধুরী পূর্ণ, কখনো জান্নাতুল ফেরদৌস (কনা)। আবার কখনো কাজী কনা হক নামে পরিচয় দেন। প্রকৃত নাম শিউলি আক্তার কনা। ফেসবুক প্রোফাইলে পরিপাটি চেহারার ছবি দিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলেন। ফেসবুকে পরিচয়ের সূত্র ধরে সখ্য তৈরি করেন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক এবং ব্যবসায়ীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে। পরে বিয়েও করেন। এরপরই বেরিয়ে আসে কনার আসল চেহারা। নানা বাহানায় সংসার ভাঙার চেষ্টা চালান। একপর্যায়ে স্বামীকে তালাকনামায় সই করতে বাধ্য করেন। পরে কাবিনের মোটা অঙ্কের টাকা ও মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে সটকে পড়েন। কখনো কখনো বিয়ে না করে পুরুষদের ব্ল্যাকমেইল করেও হাতিয়ে নেন টাকা-পয়সা। পুলিশের একাধিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এই চক্রে কনার সঙ্গে রয়েছেন কয়েকজন পুরুষ সদস্যও। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সজল এবং ইব্রাহিম। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই প্রতারক চক্রের সিন্ডিকেট অনেক শক্তিশালী। সিন্ডিকেট সদস্যদের বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে এই চক্রের সদস্যদের খপ্পরে পড়েন এক সাংবাদিক। ওই সাংবাদিকের বিরুদ্ধেও ধর্ষণের মামলা করা হয়। ধর্ষণের মিথ্যা মামলা করেই থেমে থাকেনি চক্র। বিয়ের ভুয়া কাবিননামাও তৈরি করে। এতে পাঁচ লাখ টাকা কাবিনের কথা উল্লেখ করা হয়। লালমাটিয়া কাজী অফিসের কাবিননামা দেখানো হলেও কাজী অফিসের বালাম বইয়ে এ ধরনের কোনো বিয়ের কথা উল্লেখ নেই বলে প্রত্যয়নপত্র দিয়েছে সংশ্লিষ্ট কাজী অফিস। পরে জানা যায়, কাবিনের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য বিয়ের নাটক সাজানো হয়। আর ধর্ষণের অভিযোগও মিথ্যা বলে প্রামণিত হয়। পুলিশ জানায়, অসৎ উদ্দেশ্যে চক্রের সদস্যরা গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ইমদাদুল হক মিলন, সাংবাদিক কাজী ফয়সাল, সাবেক স্বামী সোহেল মিয়া এবং যুবলীগ নেতা এমদাদুল হকসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ভুয়া মামলা করেছেন। সুমন দত্ত এবং তুষারসহ বিভিন্ন যুবককে ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা। ভুক্তভোগী গণমাধ্যমকর্মী কাজী ফয়সাল বলেন, ‘ইমদাদুল হক মিলন নামে এক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে করা ধর্ষণ মামলায় চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। চার্জশিটের প্রেক্ষিতে ওয়ারেন্ট জারি করেছেন আদালত। কিন্তু পুলিশ মিলনকে গ্রেফতার করছে না-এমন অভিযোগ নিয়ে রিপোর্ট করানোর কথা বলে আমার কাছে আসেন ওই নারী। পরে আমাকে ফাঁদে ফেলেন।’ যাত্রাবাড়ী এলাকার এক ভুক্তভোগী জানান, টাকা হাতিয়ে নিতে কনা চক্রের সদস্যরা প্রথমে তাকে ধর্ষণ মামলার হুমকি দেন। এতে কাজ না হওয়ায় তার পুরো পরিবারকে ধর্ষণ মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়। ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ভুয়া নিকাহনামা তৈরি করে দেনমোহরের টাকা দাবি করা হয়। ওই টাকা উদ্ধারের জন্য একের পর এক মামলা ও জিডি করে কনার নেতৃত্বাধীন চক্রের সদস্যরা। যুবলীগ নেতা এমদাদুল হক বলেন, ২০২১ সালে শিউলি আকতার কনা তার অফিসে এসে জানায়, ‘যাত্রাবাড়ী এলাকার কিছু লোক তাকে ডিস্টার্ব করে। তিনি খুবই অসহায়।’ এরপর থেকে বিভিন্ন সমস্যার কথা বলে কনা আমার সহায়তা নেয়। একদিন সে বাচ্চার জন্মদিনের কথা বলে এক রেস্টুরেন্টে আমাকে দাওয়াত করে। এরপর থেকে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে। বলে, ‘তুমি আমাকে বিয়ে করো, না হলে পার্টি অফিসসহ বিভিন্ন দপ্তরে তোমার নামে অভিযোগ দেব।’ একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে আমি তাকে বিয়ে করি। এরপর তার প্রতারণার নানা কাহিনী আমি জানতে পারি। পরে তাকে তালাক দিই। কনাকে কাবিননামার টাকা দিতে চাইলে সে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে বলে, ‘চাহিদা অনুযায়ী টাকা না দিলে রাজনীতি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেব।’ পরে আমার নামে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরসহ রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা অভিযোগ দেয়। আমার বিরুদ্ধে ২০ লাখ টাকা যৌতুক দাবির মামলা করা হয়। পুলিশের তদন্তে এসবের সত্যতা মেলেনি। যুবলীগ নেতা এমদাদের বিরুদ্ধে কনার করা একটি মামলায় ২০ জুলাই ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক আরিফুল ইসলাম। এতে বলা হয়, কনাকে এমদাদুল হক বিয়ে করেন ২০২২ সালের ১০ জুন। এমদাদ তালাকের চূড়ান্ত নোটিশ দেন চলতি বছরের ২৩ মার্চ। তালাকের নোটিশ পাঠাতে এমদাদকে বাধ্য করেন কনা। দুইজনের ৫-৬ মাসের দাম্পত্য জীবন মোটেই সুখের ছিল না। এমদাদ তালাক না দেওয়ায় কনা আত্মহত্যার হুমকি দেন। নিজের হাত কেটে মোবাইল ফোনে এমদাদকে জানান। কনা তার প্রথম স্বামীর কাছ থেকে তালাক নেওয়ার সময়ও একই ধরনের আচরণ করেন। পরে এমদাদুল হকের সঙ্গেও একই ধরনের কাণ্ড ঘটান। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, এমদাদের বিরুদ্ধে ২০ লাখ টাকা যৌতুক দাবির যে অভিযোগ কনার পক্ষ থেকে করা হয়েছে, তা সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি। ২০২৩ সালের ৯ মার্চ এমদাদের বিরুদ্ধে করা মামলায় কনা নিজের বয়স ৪০ বছর বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু এর সাড়ে তিন বছর আগে ২০১৯ সালের ৯ আগস্ট সাংবাদিক কাজী ফয়সালের বিরুদ্ধে করা মামলায় নিজের বয়স ৩০ বছর উল্লেখ করেন। ২০২০ সালের ৭ মার্চ পিবিআইয়ের এসআই আখতার হোসেন স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত আদালতে দাখিল করা প্রতিবেদনে বলেন, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের অভিযোগে কাজী ফয়সালের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল। মামলাটির তদন্তভার তার হাতে ন্যস্ত হওয়ার আগে একে একে কদমতলী থানার এসআই লালবুর রহমান, এসআই প্রদীপ কুমার, ডিবি ডেমরা জোনাল টিমের পরিদর্শক মঈনুল কবীর এবং ডিএমপির নারী সহায়তা ও তদন্ত বিভাগের পুরদর্শন কুইন আক্তার তদন্ত করেন। কোনো তদন্তেই অভিযোগের সত্যতা মেলেনি। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, সোহেল মিয়ার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে থাকা অবস্থায় কনা নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন। ২০০৮ সালের ৫ মার্চ সোহেলকে ঘরে রেখে সুমন দত্ত নামের এক হিন্দু যুবকের সঙ্গে পালিয়ে যান কনা। এ ঘটনায় ওইদিনই তার মা ফিরোজা বেগম বাদী হয়ে কনার বিরুদ্ধে রাজধানীর শ্যামপুর (বর্তমান কদমতলী) থানায় জিডি করেন। প্রেমের প্রস্তাব ও বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের অভিযোগে ব্যবসায়ী ইমদাদুল হক মিলনের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের ৫ মে জিডি করেন কনা। একই অভিযোগে ২০১৯ সালের ১৬ জুন মিলনের বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা করেন চক্রের সদস্যরা। ২০১৯ সালের ৯ জুন কদমতলী থানায় মামলা করা হয় মিলনের বিরুদ্ধে। অভিযোগের সত্যতা না পেয়ে তদন্ত কর্মকর্তা কদমতলী থানার এসআই ইমরুল হাসান অভিযোগ থেকে মিলনকে অব্যাহতি দিয়ে ওই বছরের ২৯ জুলাই আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। পিবিআই কর্মকর্তা আখতার হোসেন দাখিলকৃত চূড়ান্ত প্রতিবেদনে চক্রের সদস্যদের করা বেশ কয়েকটি মামলা ও জিডির রেফারেন্স দিয়ে বলা হয়, ওইসব অভিযোগের কোনো সত্যতা মেলেনি।