বৈশ্বিক করোনা মহামারির পর বাংলাদেশে ডেঙ্গু জাতীয় জনস্বাস্থ্য দুর্যোগ হিসাবে দেখা দিয়েছে। এডিস মশাবাহিত রোগটিতে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত ও মারা যাচ্ছেন। দেশে প্রায় দুই যুগ ধরে ডেঙ্গু চোখ রাঙালেও যেন দেখার কেউ নেই। এবার অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল নতুন ইতিহাস গড়েছে। গত আট মাসে এ রোগে প্রায় দেড় লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যু ছাড়িয়েছে ৭০০। এরপরও সরকার ও স্বাস্থ্য বিভাগের দায়সারা কার্যক্রমে ডেঙ্গু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। জনস্বাস্থ্যবিদরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছেন, দুর্বল জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় ডেঙ্গুতে প্রাণহানি, চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে অর্থনৈতিক ক্ষতি ছাড়াও মানসিক চাপ বাড়ছে। এতে দেশের মানুষ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেন, ডেঙ্গু শহর ছেড়ে গ্রামেও ছড়িয়ে গেছে। দুর্বল জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার কারণেই রোগটিতে প্রতিদিন অংসখ্য মানুষের আক্রান্ত ও মৃত্যুর খবর আসছে। পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এমন বাস্তবতায় কারও পরিবারে ডেঙ্গু শনাক্ত হলেই আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ডেঙ্গুসহ যে কোনো রোগের চিকিৎসা নেওয়া একশ্রেণির মানুষের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৩ আগস্ট মারা যান আট বছর বয়সি শিশু মুসাব আল ওমর। শিশুটির মামা আমিরুল ইসলাম শুক্রবার বলেন, ভাগ্নের ডেঙ্গু শনাক্তের পর প্রথমে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করি। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় দ্রুত মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। মারাত্মক শক সিনড্রোমের কারণে আইসিইউতে নেওয়ার পরদিনই তার মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, পরিবারের ছোট সন্তান ছিল মুসয়াব। ডেঙ্গু পজিটিভ হওয়ার পর সাত দিন বেঁচে ছিল। চিকিৎসা ব্যয় হয়েছিল ৭০ হাজার টাকার মতো। অর্থ গেছে তাতে দুঃখ নেই। ছেলেকে হারানোর পর এখন পর্যন্ত তার বাবা-মা মানসিক ট্রমায় ভুগছেন। সারাক্ষণ বাড়ি-ঘরে ছেলের স্মৃতি হাতড়ে চলছেন। কোনোভাবেই ছেলের এই অকাল মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না তারা। অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেন, সরকারি হাসপাতালে চাহিদা অনুযায়ী শয্যা, চিকিৎসা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে না পেরে অনেক ডেঙ্গু রোগী বেসরকারি হাসপাতালে ছুটছেন। সেখানে উচ্চমূল্যের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। ডেঙ্গুতে যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের পরিবার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ছাড়াও মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন। ডেঙ্গুর এই ভয়াল থাবা থেকে মুক্তি পেতে হলে শহর-নগর-গ্রাম সবখানে কার্যকরভাবে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি উপযোগী সব রোগীকে সরকারি হাসপাতালে বিছানা, প্রয়োজন অনুযায়ী স্যালাইন, সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, আইসিইউ, প্লাটিলেটসহ সব ধরনের সেবা নিশ্চিত করতে হবে। মশা নিধনে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে যুক্ত করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশে প্রাণঘাতী ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের চক্রাকার প্রকৃতি হলো-পরিবেশগত, আর্থসামাজিক এবং জনস্বাস্থ্যবিষয়ক বিষয়গুলোর মধ্যে জটিল মিথস্ক্রিয়ার ফল। জলবায়ু পরিবর্তন, দ্রুত নগরায়ণ এবং দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণে মশাবাহিত রোগটি স্থানীয়ভাবে প্রকট হয়ে উঠেছে। যা জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোর দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ। জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ড. গোলাম ছারোয়ার বলেন, এডিস মশাকে আমরা সব দিক থেকেই হৃষ্টপুষ্ট করে ডেঙ্গুর ভাইরাস বহন করতে পারদর্শী করে তুলছি। পরিবেশের প্রতিটি উপাদান যেমন-বায়ু, পানি, আলো, মাটি প্রভৃতি আমরা মারাত্মকভাবে দূষিত করে মশার প্রজননের হার ও গতি উভয়ই বাড়িয়ে তুলছি। আবার মশার লার্ভা ও পূর্ণাঙ্গ মশা নিধনে বহুদিন ধরে একই মুড অব অ্যাকশনের কীটনাশক প্রয়োগে প্রতিরোধী করে মশার আক্রমণের গতি বাড়িয়ে দিয়েছি। তাতে ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়ানোর জন্য তীব্রতা ও ক্ষিপ্রতার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। ২৪ ঘণ্টায় আরও ১৫ মৃত্যু, হাসপাতালে ১৮৭৬ : এদিকে গত একদিনে ডেঙ্গুতে সারা দেশে আরও ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭০৬ জনে। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৮৭৬ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৮৪২ জন ও ঢাকার বাইরের এক হাজার ৩৪ জন। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ৪২ হাজার ৫৮৭ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৬৫ হাজার ১৪ জন। ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন ৭৭ হাজার ৫৭৩ জন। ডেঙ্গুতে ভিকারুননিসার আরও এক ছাত্রীর মৃত্যু : ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের জাহিন আনাম আঁচল নামে আরও এক ছাত্রী মারা গেছে। বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় নিজ বাসায় তার মৃত্যু হয়। জাহিন ভিকারুননিসা স্কুলের প্রধান শাখার (দিবা) বাংলা মাধ্যমের দশম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। কয়েকদিন আগে সে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়। বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছিল জাহিন। এর মধ্যে তার মৃত্যু হয়। এ নিয়ে গত দুই মাসে ডেঙ্গুতে প্রাণ গেল ভিকারুননিসার তিন ছাত্রীর। তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী।