আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে একটি টেকসই পথ বের করতে খোলা মনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে এগিয়ে আসতে হবে। নির্বাচনকালীন সংকট নিরসনে স্থায়ী সমাধান খুঁজতে আওয়ামী লীগ-বিএনপিকে বসতে হবে। সমস্যা নিয়ে বিতর্ক না বাড়িয়ে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থার সংকট দূর করতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরপেক্ষ ভূমিকায় থাকার সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। এই কাজগুলো করতে পারলে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ তৈরি হবে, যা গণতন্ত্রের প্রথম ধাপ। এজন্য সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগী হয়ে কাজ করতে হবে। আর যদি এই কাজগুলো করা না যায় তাহলে কেবল বিদেশিদের তৎপরতার মাধ্যমে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রত্যাশা করা অবান্তর হবে। এতে দেশ বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে যেতে পারে। শনিবার রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে আয়োজিত এক সেমিনারে বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক দলের নেতারা এই মতামত দেন। সোসাইটি ফর গ্লোবাল অ্যান্ড বাংলাদেশ স্টাডিজ (এসজিবিএস) এবং এক্সপার্টস একাডেমি লিমিটেড ‘বাংলাদেশ : গণতান্ত্রিক অগ্রগতির পথ’ শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করে। ইউএনবি সম্পাদক ফরিদ হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন এসজিবিএসের নির্বাহী পরিচালক উপস্থাপক মিথিলা ফারজানা। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) ব্যুরো প্রধান জুলহাস আলম। সেমিনারে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, দেশের প্রধান সমস্যা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে না। আমরা বাইরের দেশের হস্তক্ষেপের কথা বলছি। কিন্তু এর পেছনের কারণ কী? আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর একে অপরের প্রতি আস্থা নেই। এ অবস্থায় আমরা গণতন্ত্র পাব কি না তা নিয়ে আলোচনা করছি। এটা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, রাজনীতিবিদরা এখনো গণতন্ত্রের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে পারেননি। যখন যারা ক্ষমতায় আসে তখন তাদের মতো গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা দেয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে বলছে গণতন্ত্র আছে, ক্ষমতার বাইরে গেলেই বলবে গণতন্ত্র নেই। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, রাজনীতিকদের হাতে খুব বেশি কিছু নেই। এখন দেশ চালায় আমলারা। ডিসি-এসপিরা দেশ চালায়। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সাত-আটশ কর্মচারীর একজন পিয়নেরও যে ক্ষমতা আছে, আমাদের (রাজনীতিবিদদের) তা নেই। প্রধানমন্ত্রীর নিম্নমানের একজন সহকারী জেলায় গেলেও ডিসিরা অভ্যর্থনা দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা গেলে তারা খবরও রাখে না। আমলারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। তাদের কখনো অসুবিধা হয় না। সমস্যা হয় রাজনীতিবিদদের। সরকার না থাকলে লাখ লাখ মানুষ মারা যাবে বলা হচ্ছে। কিন্তু আমলাদের কিছু হবে না। কারণ যেই আমলা বঙ্গবন্ধুর সময়ে ছিলেন, তিনি খন্দকার মোশতাকের সময়েও ছিলেন আবার বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার উপদেষ্টা হয়ে সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। মোশতাকের মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগের ২৩ সদস্য ছিলেন। পরে তাদের অনেকেই আওয়ামী লীগে ফিরে এসেছেন। বহাল তবিয়তে বিজয়ের মালা নিয়ে ঘুরেছেন। তিনি বলেন, এই প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করেছি আমরা। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও রাষ্ট্রদূত শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ দায়িত্বশীল প্রতিবেশী, নির্ভরশীল দেশ হিসাবে বিশ্বে স্বীকৃতি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের একটা ভূমিকা রয়েছে। একই সঙ্গে আসিয়ান, ব্রিকস, জি-২০ তে বাংলাদেশের আমন্ত্রণ পাওয়া বাংলাদেশের বিশ্ব ভূ-রাজনীতিতে, আঞ্চলিক রাজনীতিতে যে একটা মতামত রয়েছে এরই বার্তা দেয়। এটা আমাদের জন্য বড় অর্জন। তবে অনেক বেশি পথ বাকি আছে। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। বিভিন্ন নির্বাচনে ভোটের হিসাব অনুযায়ী, উভয় দলই বড় জনসমর্থন নিয়ে নির্বাচিত হয়েছে। এজন্য একটি দল অন্য দলকে নির্মূল করে দেবে, এটা হবে না। একটি দলকে নিশ্চিহ্ন করে অন্য দল দেশ শাসন করবে, এটা সম্ভব নয়। আর এটা করতে গেলে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। তিনি মনে করেন, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে ক্ষমতাসীনদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করা উচিত। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল (অব.) এম আবদুর রশিদ বলেন, কিছু দল বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভর করে আগামী নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা করছে। আমরা আমাদের ভাগ্য নির্ধারণের দায়িত্ব অন্যদের দিয়ে দিচ্ছি। এটা গণতন্ত্র হতে পারে না। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু করতে হলে ভোট গ্রহণের পুরো প্রক্রিয়াটি কারসাজিমুক্ত ও গ্রহণযোগ্য করতে হবে। এটি করবে কতগুলো প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে প্রথম ও প্রধান হলো নির্বাচন কমিশন। তারপর আছে সরকার তথা প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ। এদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষাপাতহীনভাবে কাজ করার ওপর নির্ভর করবে নির্বাচন প্রক্রিয়া সঠিক কি না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এই প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতার অভাব। নির্বাচন কমিশনই আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে করা হয়েছে। প্রশাসন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে ব্যাপক দলীয়করণ হয়েছে। আমরা আইনকে অস্ত্রে পরিণত করে ফেলেছি। পালটাপালটি অভিযোগ না করে আলাপ-আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে। মূল প্রবন্ধে জুলহাস আলম বলেন, বাণিজ্য স্বার্থ আদায়, অবকাঠামো উন্নয়নে প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ আনয়নসহ বহুবিধ কারণে নিজেদের লাভ-লোকসানের হিসাব মিলিয়ে এগোতে না পারলে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে বাংলাদেশকে। সেক্ষেত্রে জাতীয় রাজনীতি ও অর্থনীতিও পড়বে চ্যালেঞ্জের মুখে। জ্বালানি নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ তার মধ্যে অন্যতম। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কৌশলগত অবস্থানের হিসাব-নিকাশে ভুল করলে দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার গতিপথও জটিলতার আবর্তে পড়ে যেতে বাধ্য। তিনি বলেন, দিনশেষে রাজনীতিই ভরসা, রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতেই আস্থা রাখতে হবে। প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, গণতন্ত্রের সংকট দেশে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে বাধা সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো এর জন্য দায়ী। রাজনীতিবিদরা কি বলতে পারবেন, তারা প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিচ্ছেন? এটাই বর্তমান সংকটের মূল কারণ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে এখন দেশের স্বার্থে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। আওয়ামী লীগের সংসদ-সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেন, চিন্তার মতপার্থক্য, বিপরীতমুখী চিন্তা এগুলো থাকবে। এর মধ্যেই একটা সমাধানের জায়গায় আসতে হবে। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন আমাদের নতুন সময় পত্রিকার ইমেরিটাস সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান, ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান, আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ, ক্ষমতাসীন দলের সংসদ-সদস্য নাহিম রাজ্জাক, ফেমা’র সভাপতি মুনিরা খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ পিএসসির সদস্য অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন, সাংবাদিক আজিজুল হক ভূঁইয়া, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলে ফাহিম, এক্সপার্ট একাডেমির উপদেষ্টা সিরাজুল ইসলাম এবং আর্টিকেল ১৯-এর আঞ্চলিক পরিচালক ফারুক ফয়সল প্রমুখ।