এপিএস আজিজুলের দায় খুঁজছে পুলিশ

প্রকাশিতঃ সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২৩ | ৯:৪৩ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

ছাত্রলীগের দুই নেতাকে থানায় নিয়ে নির্যাতনের ঘটনায় রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) আজিজুল হক মামুনের দায় খুঁজছে পুলিশ। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতির এপিএস ও ছাত্রলীগ নেতারাই প্রথমে এডিসি হারুনকে মারধর করেছিলেন। এপিএস মামুনের দায় বের করতে যেখান থেকে ঘটনার সূত্রপাত হয়, সেই বারডেম হাসপাতালে কী ঘটেছিল, সেটি তদন্ত করে বের করা উচিত বলে মনে করেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন-অর রশীদ। তিনি বলেন, এপিএস মামুন এবং ছাত্রলীগ নেতারাই বারডেম হাসপাতালে আগে এডিসি হারুনকে মারধর করেছেন। একই ধরনের তথ্য তুলে ধরে এডিসি হারুনের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন এপিএস’র স্ত্রী পুলিশের এডিসি সানজিদা আফরিনও। নির্যাতনের ঘটনার পর সাময়িক বরখাস্ত হওয়া এডিসি হারুনকে রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। মঙ্গলবার এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এডিসি সানজিদা আফরিনকে রংপুর পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে (পিটিসি) বদলি করা হতে পারে। আজ এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে। পুলিশের নির্যাতনে আহত ছাত্রলীগ নেতা নাঈমের চিকিৎসার খোঁজ নিতে মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক মঙ্গলবার তাকে দেখতে হাসপাতালে যান। এদিন রাতে তিনি জানান, ঘটনা তদন্তে পুলিশের পক্ষ থেকে যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়, সেই কমিটি বেঁধে দেওয়া দুদিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি। মঙ্গলবার প্রতিবেদন দাখিলের সময় নির্ধারিত থাকলেও কমিটি তদন্ত শেষ করতে আরও পাঁচ দিন সময় চেয়েছে। যথাযথভাবে তদন্ত শেষে করতে আমরা কমিটিকে আরও পাঁচ দিন সময় দিয়েছি। তিনি আরও বলেন, এডিসি হারুনকে এপিএস মামুন এবং ছাত্রলীগ নেতারা মারধর করেছেন বলেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন-অর রশীদ যে তথ্য দিয়েছেন, তা তিনি কোথায় পেয়েছেন, সে বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। আর এ বিষয়ে এডিসি সানজিদার বক্তব্য দেওয়া ঠিক হয়নি। কমিশনারের অনুমতি ছাড়া তিনি এভাবে স্টেটমেন্ট দিতে পারেন না। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যাকে ঘিরে ঘটনার সূত্রপাত সেই নারী এডিসি সানজিদার বিভিন্ন বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে। সর্বশেষ হারুনের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কে জড়ান বলে অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি বেশ কয়েক মাস ধরে তার স্বামী ও রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল গোপনে নজরদারি করছিলেন। ঘটনার পর ডিএমপি সদর দপ্তরে কর্মরত এডিসি সানজিদা অন্তরালেও থাকলেও মঙ্গলবার মুখ খুলেছেন গণমাধ্যমে। এডিসি সানজিদা বলেন, ‘কিছুদিন ধরেই আমার কার্ডিয়াক সমস্যা হচ্ছিল। ২০১৯ সাল থেকেই আমি হাইপার টেনশনের ওষুধ খাচ্ছিলাম। গত ৪-৫ মাস ধরে সমস্যাটা বেড়ে যায়। দু-তিন সপ্তাহ ধরে বুকে ব্যথা বেড়ে যাচ্ছিল। শনিবার ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে যাই। এডিসি হারুন স্যারকে বিষয়টা জানালে তিনি ওসির মাধ্যমে একটি সিরিয়াল ম্যানেজ করে দেন। সন্ধ্যা ৬টার পর সিরিয়াল পাই। একটু পর স্যার (এডিসি হারুন) আসেন। আমি ওই সময় ইটিটি করাচ্ছিলাম। ইটিটির শেষ পর্যায়ে আমি রুমের বাইরে হট্টগোল চিৎকার-চ্যাঁচামেচির শব্দ শুনতে পাই। প্রথমে স্যারের শব্দ শুনতে পাই। তিনি বলছিলেন, আপনি আমার গায়ে হাত তুলছেন কেন? কিছুক্ষণ পর আমি বাইরে বের হয়ে দেখি, আমার হ্যাজবেন্ড অস্বাভাবিক অবস্থায় এবং তার সঙ্গে কয়েকজন ছেলে মিলে স্যারকে (এডিসি হারুনকে) মারতে মারতে একটা রুমের ভেতরে নিয়ে যায়। তখন আমাকে চড়-থাপ্পড় দেয় আমার হ্যাজবেন্ড। এ সময় আমার স্বামী খুবই উত্তেজিত অবস্থায় ছিলেন। তিনি তখন সেখানে কেন গিয়েছিলেন তা আমি জানি না।’ সানজিদা আরও বলেন, ‘তারা স্যারকে মারতে মারতে টেনে-হিঁচড়ে রুমের ভেতর নিয়ে আসেন। তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য স্যার ইটিটি রুমের ভেতর এক কোণায় গিয়ে দাঁড়ান। এ সময় আমার স্বামী দুজন ছেলেকে ঘটনাস্থলের ভিডিও করতে বলেন। আমি তখন ইটিটি ড্রেসে ছিলাম। আমি চিৎকার করে আমার স্বামীকে বলছিলাম, এ রুমে কোনো ছেলে মানুষ ঢোকার কথা নয়। আপনি এত লোক কেন ঢুকিয়েছেন? ভিডিও করতে বলছেন কেন? এ সময় আমার স্বামী আমাকে থাপ্পড় মারেন। তখন আমার গাড়িচালক ঘটনাস্থলে এসে আমার এবং স্বামীর মাঝখানে দাঁড়ান। ড্রাইভারের গায়ের ওপর দিয়ে এসে আমাকে মারধর করা হয়। দু-তিনজন ছেলে যখন ভিডিও করছিলেন তখন একজনের কাছ থেকে আমি ফোনটা নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। ওই ছেলের সঙ্গেও আমার হাতাহাতি অবস্থা হয়। তাদের উদ্দেশ্যে ছিল আমাকে এবং স্যারকে (এডিসি হারুন) একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে ভিডিও করা। অসৎ লক্ষ্যেই এটা করানোর চেষ্টা হচ্ছিল। স্যারকে মারার সময় তারা আমাকেও মারধর করেছে। আমার বডিগার্ডকেও মারধর করেছে। একপর্যায়ে তারা স্যারকে রুম থেকে বের হতে বলছিলেন। তখন স্যার বলছিলেন, আমি এখান থেকে বের হলে তো আমাকে মেরে ফেলবেন। আমি থানার ফোর্সদের আসতে বলেছি। তারা এলে আমি এখান থেকে বের হব। পরে থানা থেকে ফোর্স আসে। এরপর সবাই নিচে নেমে যায়।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন নাঈমকে মঙ্গলবার দুপুরে দেখতে যান ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। এ সময় ডিএমপি কমিশনার গণমাধ্যমকে জানান, শাহবাগ থানার ঘটনায় ছাত্রলীগের একাধিক নেতা আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির কাজ শেষ হওয়ার আগেই দুজন অফিসারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এডিসি হারুনকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। শাহবাগ থানার পরিদর্শক (অপারেশনস) মোস্তফাকেও থানা থেকে সরানো হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর আমরা তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয়সহ অন্যান্য ব্যবস্থা নেব। আমরা আপাত দৃষ্টিতে দেখছি, একজন ছাত্রকে থানার ভেতরে মারধর করা বেআইনি। তাৎক্ষণিকভাবে আমরা ওইটুকু অ্যাকশন নিয়েছি। এরমধ্যে যদি তদন্তে আরও অন্য কোনো বিষয় আসে সেসব বিষয় দেখা হবে। নিজ কার্যালয়ে মঙ্গলবার ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন-অর রশীদ বলেন, উনি (এপিএস মামুন) একজন সরকারি কর্মকর্তা। পুলিশের ওপর প্রথম হামলাটা তিনিই করেছিলেন। তিনি ইচ্ছা করলে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারতেন। কিন্তু উনি তা না করে হাসপাতালের ভেতরে অসুস্থ মানুষের সামনে একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে ধাওয়া করেন। তার চশমা ভেঙে ফেলেন, তার ওপর আঘাত করেন। এটা সঠিক করেছেন কিনা তা আমি জানি না, তবে এর তদন্ত হওয়া উচিত। থানায় নিয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের নির্যাতনের ঘটনার সূত্রপাত বারডেম হাসপাতাল থেকে বলে জানান তিনি। ডিএমপির এই অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, পুলিশ বাহিনী কখনো ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের দায় নেয় না। আমি মনে করি এ ঘটনায় স্বাধীনভাবে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেবেন তদন্ত কর্মকর্তা। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি সঠিকভাবে ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে তদন্ত করছে। এডিসি হারুন-অর-রশীদ মঙ্গলবার গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘শনিবার আমি আমার বাবা-মাকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসক পবিত্র কুমারের কাছে যাই। বেলা ২টার দিকে আমাদের এডিসি ক্রাইম-১ ফোন করে বলেন, তার বুকে ব্যথা। সেজন্য বারডেম হাসপাতালের চিকিৎসক অধ্যাপক রশিদ স্যারের সিরিয়াল (অ্যাপয়েন্টমেন্ট) চান। আমি রমনা থানার ওসির মাধ্যমে সন্ধ্যা ৬টায় সিরিয়ালের ব্যবস্থা করি। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে চিকিৎসক নির্ধারিত সময়ে এডিসিকে সময় দিতে পারছিলেন না। বিষয়টি আমাকে জানানোর পর আমি চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলার জন্য সেখানে যাই। আমি যাওয়ার পর চিকিৎসক তাকে (এডিসি সানজিদা) দেখেন। আমি বাইরে অপেক্ষা করছিলাম। এ সময় তখন ডিসি সানজিদার স্বামী মামুন এবং তার সঙ্গে আরও চার-পাঁচজন এসে পেশেন্টের রুমে যান। পরে বাইরে এসে কোনো কথা ছাড়াই মামুন আমার বাম চোখের ওপর একটা ঘুসি মারেন। তখন তার সঙ্গে থাকা অন্য শিক্ষার্থীরাও আমার ওপর চড়াও হন। তারা আমাকে জোর করে ইটিটি রুমের ভেতরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যান। ওখানেও আমাকে মারধর করেন। পরে আমি আত্মরক্ষার্থে শাহবাগ থানা-পুলিশকে কল করি। শাহবাগ থানা-পুলিশ এসে সবাইকে থানায় নিয়ে যায়।’ শনিবার রাতে তুলে নিয়ে শাহবাগ থানা হেফাজতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের দুই নেতাকে নির্যাতন করেন এডিসি হারুন-অর-রশীদ। আহতরা হলেন- ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও ফজলুল হক হলের সভাপতি আনোয়ার হোসেন নাঈম এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাবির শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ মুনিম। ভুক্তভোগী ও তাদের সহপাঠীদের অভিযোগ, পুলিশের রমনা বিভাগের এডিসি হারুন-অর-রশীদ তাদের থানায় নিয়ে বেদমভাবে পিটিয়েছেন। ছাত্রলীগের নেতা পরিচয় দেওয়ার পরও হারুনের সঙ্গে ১০-১৫ জন পুলিশ সদস্য মিলে তাদের পেটান। মানবাধিকার কমিশনের উদ্বেগ : এডিসি হারুনকাণ্ডে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদের স্বাক্ষর করা এক বিবৃতিতে বলা হয়, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় একজন পুলিশ কর্মকর্তার এমন আচরণ আইন ও নীতিবিরুদ্ধ। ব্যক্তিগত আক্রোশকে কেন্দ্র করে থানায় নিয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের নির্যাতন একজন পুলিশ কর্মকর্তার ক্ষমতার অপব্যবহার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র ফুটে উঠেছে। তদন্তসাপেক্ষে ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া সমীচীন। এদিকে এ ঘটনায় জড়িত পুলিশের অতিরিক্ত এডিসি হারুন-অর-রশীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। বিষয়টি কমিশনকে অবহিত করার জন্য সিনিয়র সচিব, জননিরাপত্তা বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে। এডিসি সানজিদার স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে: ডিএমপির রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশীদ ও এডিসি সানজিদার ওপর রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক মামুন যদি আগে আক্রমণ করে থাকে, এ বিষয়ে অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজারবাগে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ইউনাইটেড ল’ইয়ার্স ফ্রন্টের আইনজীবীদের হামলায় আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে এসে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন আইজিপি। রাষ্ট্রপতির এপিএস আগে এডিসি হারুনের ওপর আক্রমণ করেন, তখনই ঘটনাটি বড় হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে—এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আইজিপি বলেন, ‘তাদের এই অভিযোগের বিষয়টা যদি তারা আমাদের অভিযোগ আকারে দেয় তাহলে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দেব। তখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেবে। এ ছাড়া আমরাও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমাদের তদন্তে এ বিষয়টি উঠে এলে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাব।’