দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন আছে বলে জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। তারা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তারা বলেছেন, বড় দলগুলোর অংশগ্রহণ না থাকলে ওই নির্বাচন হয়তো আইনগত বৈধ হবে কিন্তু গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে সেই দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনও এড়াতে পারবে না। আগামী সংসদ নির্বাচন আন্তর্জাতিক মহল গুরুত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে জানিয়ে তারা বলেন, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হলে এর মাশুল গুনতে হবে। বুধবার নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন : প্রত্যাশা ও বাস্তবতা’ শীর্ষক কর্মশালায় তারা এসব কথা বলেন। এতে বক্তারা মাঠ প্রশাসনের যেসব দলীয় কর্মকর্তা আছেন তাদের দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের নির্বাচন কমিশন সরাসরি শাস্তি না দেওয়ায় ইসির সমালোচনাও করেন তারা। এর জবাবে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সরকারের প্রতিশ্রুতিতে আশ্বস্ত হওয়ার কথা তাদের জানান। তবে তিনি স্বীকার করেন, বর্তমানে কঠিন অবস্থার মধ্যে আছেন। নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর যে দূরত্ব তা নিরসনে রাজনীতিবিদদের এগিয়ে আসার আহবান জানান। তিনি বলেন, রাজনীতিবিদরা যদি আমাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে না দেন, তবে আমাদের পক্ষে নির্বাচন করাটা কষ্টসাধ্য হবে। আর পরিবেশ অনুকূল করে দিলে আমাদের জন্য কাজটা সহায়ক হবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এ কর্মশালার আয়োজন করে নির্বাচন কমিশন। এতে বক্তব্য দেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ, সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. হুমায়ূন কবীর, সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খানসহ কয়েকজন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও ছিলেন। চার নির্বাচন কমিশনার ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকলেও তারা বক্তব্য দেননি। কর্মশালা পরিচালনা করেন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান। সমাপনী বক্তব্যে সিইসি আরও বলেন, সরকারের তরফ থেকে ইদানীং বারবার সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর আগে কিন্তু সরকার কখনো এ প্রতিশ্রুতি দেয়নি। এই প্রথমবারের মতো সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এতে আমরা অত্যন্ত আশ্বস্তবোধ করছি। আমি বলব- আস্থা রাখতে চাই। সরকার আশ্বস্ত করলেও নির্বাচন নিয়ে সংকটের কথা স্বীকার করেন সিইসি। তিনি বলেন, আমরা একটা কঠিন অবস্থায় আছি। এটা বিলাতের নির্বাচন হচ্ছে না। অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচন করতে যাচ্ছি না। সংকট আছে, আপনারা বলেছেন, আমরাও অনুধাবন করি। অনেকগুলো সংকট নিরসন করতে হবে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে। নির্বাচন ভালো হবে কিনা-সেটা রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে উল্লেখ করে সিইসি বলেন, আন্তরিক পলিটিক্যাল উইল থাকতে হবে। আলোচকদের মধ্যে শুরুতেই বক্তব্য রাখেন আলী ইমাম মজুমদার। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ ছিল মন্তব্য করে তিনি বলেন, সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন আবার করব কিনা-সেই প্রশ্ন রয়ে গেছে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, আমরা এমন নির্বাচন করতে পারব কিনা-যেই নির্বাচনে সব দল অংশ নিতে পারবে, সব ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। তিনি বলেন, দেশের প্রধান বিরোধী দলসহ বেশ কিছু দল বলছে যে, বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রেখে তারা কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। পাশাপাশি সরকারে যারা আসিন আছেন তারা বলছেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ তারা ক্ষমতায় থাকবেন এবং যে সংসদ আছে, সেই সংসদও বলবৎ থাকবে। এই অবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই জিনিসটা অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। এটা রাজনীতিকদের সমাধান করতে হবে। সাবেক এ মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এখনো আশা করি রাজনৈতিক দলগুলো দূরদর্শিতার পরিচয় দেবে। নির্বাচন কমিশনের যতটা ক্ষমতা দেওয়া আছে, তার পরিপূর্ণ প্রয়োগ দেখতে চাই। তিনি বলেন, আইনকানুন আমাদের তৈরি। ১৯৯১ সালে সংবিধান রেখেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ভোট হয়েছে। মানুষের প্রয়োজনে আইন সংশোধন হতে পারে। আলী ইমাম মজুমদার বলেন. বিদেশি রাষ্ট্রগুলো আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থায় তাদের বক্তব্য, বৈঠক ইত্যাদির মাধ্যমে হস্তক্ষেপ করছে। তাদের আমরাই ডেকে এনেছি। যদি আমরা ঠিক থাকতাম তাহলে এমনটা হতো না। পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্র আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, যদি এবার আমরা ব্যর্থ হই তাহলে এর মাশুল দিতে হবে। নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, গাইবান্ধা-৫ আসনের ভোটগ্রহণ বন্ধ করেছিল। তদন্ত কমিটির মাধ্যমে দায়-দায়িত্ব নির্ধারণও করেছিল। আমরা দুঃখিত নির্বাচন কমিশন তাদের কাছে ক্ষমতা থাকার পরও দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সরকারকে ব্যবস্থা নিতে বলেছে। তিনি বলেন, ইসির সঙ্গে এর আগে আমাদের যে সংলাপ হয়েছিল, ওই সংলাপে উঠে আসা সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে দেখিনি। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, জামালপুরের ডিসি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় আনতে হবে।’ এই খবর সব সংবাদপত্রে দেখলাম। এমন ডিসিদের দিয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনও হবে না। তিনি বলেন, এসব ডিসির বিরুদ্ধে আপনাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে কী করবেন, কীভাবে কাজ করবেন। এক জেলায় চারজন রিটার্নিং কর্মকর্তা দিয়ে নির্বাচন করাতে পারে। একই ডিসিদের রিটার্নিং করতে হবে বিষয়টি এমন নয়। সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, কয়েকদিন আগে মালদ্বীপে নির্বাচন হয়েছে। বড় বড় পর্যবেক্ষক সেখানে ছিলেন। ভোটে কোনো অভিযোগ ওঠেনি। তিনি বলেন, আপনাদের ওপর আস্থা রাখা কঠিন। আপনাদের হাত-পা বেঁধে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আপনারা একা সিদ্ধান্ত নেবেন। কোনো রাজনৈতিক দলের কথা শুনবেন না। অতীত ভুলগুলো শুধরে নেবেন। বড় দল অংশ না নিলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না জানিয়ে ড. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বড় একটি দল যদি নির্বাচনে না আসে, যেই দলটির ৩৩ বা ৩৭ শতাংশ সমর্থক রয়েছে তাহলে সেই নির্বাচন যত ভালো হোক না কেন, তা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। ওই দলটিকে বাদ দিয়ে আরও তিনশ রাজনৈতিক দল নিয়েও নির্বাচন করলে সেটিকে আপনি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বলতে পারবেন না। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হতে হবে মন্তব্য করে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেছেন, বাস্তবতা আপনাদের (নির্বাচন কমিশনারদের) অনুকূলে নেই। ৫২ বছরের ইতিহাস হচ্ছে সরকার না চাইলে কমিশনের পক্ষে ভালো নির্বাচন সম্ভব নয়। সরকার কী চায় তার ওপর আপনাদের পারফরম্যান্স নির্ভর করবে। তিনি বলেন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হলে এর দায়িত্ব আপনাদের ওপরই এসে পড়বে। যদিও টেকিনক্যালি আপনারা বলতে পারেন সব দলকে নির্বাচনে আনার দায়িত্ব আপনাদের নয়। সাবেক সচিব হুমায়ুন কবীর বলেন, আমার ধারণা ভীতিকর ও নিপীড়ক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ঢাকার বাইরের অভিজ্ঞতা বলছি, সরকারি দল বা বিরোধী দল বলেন, সবার মধ্যে একটা অজানা আশঙ্কা কাজ করছে সামনে কী হবে? সামনের নির্বাচন কীভাবে হবে? সর্বস্তরে অনিশ্চয়তা ও আশঙ্কা প্রতীয়মান হয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। আরপিও নিয়ে কেন ক্ষমতা হারালেন তা নিয়ে মানুষের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে। জনগণের ধারণা আরপিও সংশোধনের মাধ্যমে ক্ষমতা কমানো হয়েছে। এ সময় তাকে থামিয়ে সিইসি দাবি করেন, আরপিও সংশোধনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা কমেনি। এটা মোটেও সত্য নয়। ...বলা হচ্ছে এই নির্বাচন কমিশন আগেই পক্ষপাত করে ফেলেছে সরকারের সঙ্গে। দ্যাট ইজ নট ট্রু। আমরা অতটা কাওয়ার্ড নই। এ সময় তিনি অভিযোগ করেন, কমিশনের বক্তব্য খণ্ডিতভাবে উপস্থাপন করা হয়। যদিও মাছরাঙা টেলিভিশনের হেড অব নিউজ রেজোয়ানুল হক রাজা সিইসির ওই বক্তব্যের জবাবে বলেন, সিইসি যেসব বক্তব্য দিয়ে থাকেন তা গণমাধ্যমে হুবহুই প্রকাশিত হয়। ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, আমরা মুখে শুধু বলি নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাবান, কিন্তু বাস্তবে কিছুই নেই। সংকট এত কঠিন যে, সব দায় কমিশনের ওপর দিয়েও লাভ নেই। একের পর এক এমন চলতে থাকলে মানমর্যাদা থাকবে না। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনীর সংশ্লেষ পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করবে। এই পরিবেশ থেকে উত্তরণে আদালতেরও ভূমিকা আছে। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে কোর্টের রায়ের ফলে এই সংকট তৈরি হয়েছে। প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেছেন, নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। নির্বাচনের প্রধান চ্যালেঞ্জ সবাইকে নিয়ে নির্বাচন করা। সরকারকে এমন চাপ দেন যাতে সব দল নির্বাচনে আসে। গণতন্ত্র না থাকলে এমন নির্বাচন অর্থহীন। ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেছেন, বর্তমানে বাস্তবতা হচ্ছে-নির্বাচন ব্যবস্থা বিশ্বাসহীনতায় রয়েছে। একটা ভালো নির্বাচন হলেই যে সব সমস্যা সমাধান হবে তা নয়। তবে ভালো নির্বাচন সমাধানের সূচনা হতে পারে। কর্মশালায় আরও বক্তব্য রাখেন জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদের চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন, দৈনিক সিনিয়র সহকারী সম্পাদক ও কলাম লেখক মাহবুব কামাল, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রধান বার্তা সম্পাদক আশিষ সৈকত, মাছরাঙা টেলিভিশনের হেড অব নিউজ রেজোয়ানুল হক রাজা, সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল প্রমুখ।