দুপুর দেড়টা। পুড়ে যাওয়া দোকান থেকে তখনও ধোঁয়া উড়ছে। পাশে দাঁড়িয়ে কিশলয় স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী মারুফা ইয়াসমিন মালিহা। তার দুচোখে অশ্রুর বন্যা। অদূরে দাঁড়িয়ে বাবা ওয়ালিউল্লাহ। বাকরুদ্ধ তিনি। ছোট্ট মেয়েটাকে কীভাবে সান্ত্বনা দিতে হয় তার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছেন। ওয়ালিউল্লাহ কৃষি মার্কেটে ব্যবসা করেন ২০ বছরেরও বেশি সময়। দোকানের নাম লিজা এন্টারপ্রাইজ। স্ত্রীর নামে দোকান। কৃষি মার্কেটে সবচেয়ে বড় মুদি দোকান ছিল এটি। কিন্তু এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। নিমিষেই শেষ তার উপার্জনের একমাত্র সম্বল। চাঁদপুরের বাসিন্দা ওয়ালিউল্লাহ বলেন, এ-টু-জেড সব ছিল আমার দোকানে। বলতে পারেন মিনি সুপারশপ। হোটেল-রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে আশপাশের কমিউনিটি সেন্টার-সবাই এক নামে ‘লিজা ট্রেডিং’ চেনে। এ এলাকার বড় সাপ্লায়ার আমি। সকালে দোকান খুললেই কাস্টমারের ভিড় লেগে যায়। ওয়ালিউল্লাহ আগুন লাগার খবর পান রাত ৩টা ৪০ মিনিটে। তড়িঘড়ি মার্কেটে এসে দেখেন তার দোকানের ওপর দিয়ে কালো ধোঁয়া উড়ছে। কিন্তু ভেতরে ঢোকার মতো অবস্থা ছিল না। আগুনের লেলিহান শিখা এমন যে ঢুকলে মরণ ছাড়া উপায় নেই। ওয়ালিউল্লাহ বলেন, ফায়ার সার্ভিস তখনও আসেনি। বেশ কিছুক্ষণ পর ফায়ার সার্ভিসের দুটো গাড়ি আসে। কিন্তু একটু পানি দেওয়ার পরই ওদের আর পানি নেই। ‘আপনারা খোঁজ নিলে জানতে পারবেন কৃষি মার্কেটে আমার দোকানটা সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে সুন্দর। মালামালে ভরপুর ছিল দোকান। সব সময় দোকানেই মালামাল স্টক থাকত ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকার। ৩টা ফ্রিজে ভর্তি থাকত চাইনিজ রেস্টুরেন্টের সব আইটেম।’ দোকান পুড়ে যাওয়ার আগে পরের কয়েকটি ছবি মোবাইল থেকে বের করে দেখিয়ে বলেন, এই দেখেন কত সুন্দর ছিল আমার দোকান। কিন্তু এখন সব কয়লা। ওই দেখেন ফ্রিজটা পুড়ে কি হয়েছে। একশ টাকার জিনিসও উদ্ধার হয়নি। এমনকি দোকানের লোহার শাটার পর্যন্ত দুমড়ে-মুচড়ে খসে পড়েছে। যৌথ পরিবার ওয়ালিউল্লাহর। স্ত্রী ও দুই মেয়ে নিয়ে নিজের পরিবারের সদস্য চারজন। সঙ্গে থাকেন দুই ভাই। ছোট ভাই জলিল মিয়ার এক ছেলে। তার ছোট আলামিনের পরিবারের সদস্য ৩ জন। তিন ভাই পালা করে দোকানে বসতেন। এছাড়া দোকানে কাজ করেন আরও ৮-১০ জন কর্মচারী। ওয়ালিউল্লাহ বলেন, বড় মেয়েটার নাম মারুফা ইয়াসমিন মালিহা। পাশেই কিশলয় স্কুলে পড়ে। আর ছোটটার নাম আফরা ইসলাম নূর। ওর বয়স মাত্র আড়াই বছর। এছাড়া ব্যাংকে লোন আছে প্রায় কোটি টাকার মতো। জানি না এ টাকা কীভাবে শোধ করব। সংসারই বা কীভাবে চলবে! সরকারি সহায়তা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দোকানটা দাউ দাউ করে পুড়ে চোখের সামনে শেষ হয়ে গেল। কেউ তো এখনো এলো না। অথচ প্রায় ১৫ বছর ধরে ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়ে ব্যবসা করি। লাখ লাখ টাকা সরকারি ঘরে জমা দিয়েছি। কিন্তু এখন আমাদের দুর্দিনে সরকার যদি আগায়া না আসে তো কী বলব।’ তিনি বলেন, কৃষি মার্কেটের সব ব্যবসায়ী আসলে এখন নিঃস্ব। এখানে শুধু বড়সড় মুদি দোকানই ছিল ৪০-৫০টার মতো। এছাড়া চাল, জুতা, কাপড়, স্বর্ণালংকারসহ আরও অনেক দোকান। একটা দোকানও অবশিষ্ট নেই। পুরো মার্কেট শেষ। ওয়ালিউল্লাহর সঙ্গে কথা বলার সময় সেখানে এগিয়ে আসেন আশপাশের কয়েকজন দোকান কর্মচারী। শহিদুল্লাহ নামের এক কর্মচারী বলেন, এতদিন বিভিন্ন মার্কেটে আগুন লাগার খবর শুনে খারাপ লাগত। কিন্তু আজ নিজের চোখেই সব দেখলাম। আমাদের পাশেই সংসদ ভবন, গণভবন। এদিকে বড় আবাসিক এলাকা। আসাদ গেটে ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন। এখান থেকেই ফায়ারের গাড়ি আসতে যদি এক-দেড় ঘণ্টা লাগে, তাহলে কী বলা যায়। মার্কেট পুড়ে শেষ হয়ে গেলে ফায়ার সার্ভিস এসে লাভ কি? মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ ছিল কিনা জানতে চাইলে ব্যবসায়ীরা এর প্রতিবাদ করেন। বলেন, না না। এমন কথা কে বলছে? এই মার্কেট মোটেও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল না। এইতো কিছুদিন আগে চালের টিন বদল করা হলো। কয়েক বছর আগে মার্কেটের মেঝে টাইলস করা হয়। দোকানের চারপাশের রাস্তাটাও নতুন। ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়নি। কারণ মার্কেটের বিদ্যুৎ তো রাতে বন্ধ থাকে। লাইটও জ্বলে না। তাহলে শর্টসার্কিট কীভাবে হলো? বিসমিল্লাহ ভান্ডারের পুড়ে যাওয়া দোকানে নির্বাক বসে ছিলেন কর্মচারী মো. শহীদুল্লাহ। তার আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পোড়া দোকানের মালামাল। পিঁয়াজ, আলু, রসুনের বস্তা। পুড়ে মুড়ি হয়ে যাওয়া চালের স্তূপ। ক্ষয়ক্ষতি কেমন জানতে চাইলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শহীদুল্লাহ বলেন, সব শেষ। কিছুই নেই।