দেশ ত্যাগ করার নিরভ বিপ্লব শুরু হয়েছে অনেকের কাছে বিদেশে যাওয়া-ই একমাত্র সমাধান । বেশির ভাগ তরুণদের স্বপ্ন এখন দেশ ত্যাগ করা যেন দেশ ত্যাগ করতে পারলেই বাঁচে। ইদানীং তরুণদের কোনো আড্ডায় যোগ দিলে সব বিষয় ছাপিয়ে আলোচনা যেন একবিন্দুতে এসে দাঁড়ায়। শুধু কি আড্ডায়? আত্মীয়স্বজন, নিকটজন, বন্ধুদের সাধারণ আলোচনায়ও বিষয়টি চলে আসে। আর তা হলো, বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে কার কী পরিকল্পনা। কে আইইএলটিএস দিয়েছে,ফুল স্কলারশিপ পেতে কত স্কোর লাগবে, কার ক্লাস কবে শুরু, ইউরোপ ভালো হবে নাকি আমেরিকা, নাকি অস্ট্রেলিয়া, ইতালি বা কানাডা। চারদিকে কেবল এই আলাপই শুনছি না, ঢের দেখাও যাচ্ছে। আমাদের মেধাবী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছেলেমেয়েরা বিদেশে পাড়ি জমাতে হন্যে হয়ে চেষ্টা করছেন। পড়াশোনা শেষে আবার ফিরে আসবেন কি না, এমন প্রশ্ন করা হলে, অনেকের উত্তর, আগে তো যাই, তারপর দেখা যাবে। তরুণদের এই প্রবণতাকে কোনোভাবেই নেতিবাচক বলতে পারি না। তবে এর আগে বলা দরকার, বিদেশে উচ্চশিক্ষায় গমনের ক্ষেত্রে একটা নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে। একটা সময় ছিল, কেবল ধনী পরিবার, বড় ব্যবসায়ী, মন্ত্রী-মিনিস্টার আর আমলা-পুত্রকন্যারাই এ সুযোগ পেতেন বা নিতেন। সমাজের ক্ষমতাশালীরা অবশ্য সব সময় নিজের সন্তানসন্ততিদের বিদেশে নিরাপদে রাখার নীতিতে বিশ্বাসী। যা-ই হোক, এখন মধ্যবিত্ত তো বটেই, সাধারণ গরিব ঘরের, এমনকি কৃষক পরিবারের সন্তানেরাও উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় যাচ্ছেন। ওয়েবসাইটে ঢুকে আবেদন করে, বৃত্তি অর্জন করে, প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে, ধারকর্জ করে টিকিট কিনে, ব্যাগপত্র গুছিয়ে বিমানে উঠে বসছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমিটরিতে থাকছেন, ক্লাস করছেন, লেখাপড়ার ফাঁকে যতটুকু কাজের সুযোগ আছে, তা গ্রহণ করছেন। কেউ টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট বা টিএ হিসেবে আগেই মনোনীত হচ্ছেন। সবকিছুই একধরনের শৃঙ্খলার মধ্যে সেখানে চলছে বলে প্রতীয়মান হয়। আরেকটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা-মায়েরাও তাঁদের মেয়েকে পর্যন্ত উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ পাঠাচ্ছেন। আগে সাধারণত বিয়ের পর মেয়েদের বিদেশ পাঠানোর অনুমতি দিতেন বাবা-মায়েরা। এখন বিয়ের আগেই মেয়েরা যেতে পারছে। চিন্তার এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানাতে হয়। সাম্প্রতিক আমাদের পাশের গ্রামের একজন কানাডার গিয়েছে এক বছরের মতো হলো পড়াশোনার ফাঁকে কাজ করে বাড়িতে পাঠিয়েছেন ৩২ লাখের মতো টাকা। ১। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশও অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্ট এগিয়েছে ও এগোচ্ছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ দৃষ্টিনন্দন সব অবকাঠামো তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির যন্ত্রণা সত্ত্বেও জীবনমান বেড়েছে, মাথাপিছু আয়, গড় আয়ু সার্বিকভাবে বেড়েছে। তারপরও এটা হয়তো তরুণদের বিদেশমুখিনতা আটকানোর জন্য যথেষ্ট নয়। অথবা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির ধারা আর তরুণদের বাইরের দুনিয়ার প্রতি আগ্রহ—দুটি ভিন্ন বিষয়। এ বিষয়ে বোধ করি সমাজ-গবেষকেরা ভালো ব্যাখ্যা করতে পারবেন। তরুণদের অনেকের মধ্যে এ রকম ধারণা আছে, ঠিকমতো পড়াশোনা করলেও ফলাফলে তা প্রতিফলিত হবে না। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চাকরি জুটবে না। কোনো না কোনোভাবে বৈষম্যের স্বীকার হওয়ার ঝুঁকি তাঁর জীবনে আসতে পারে। আর চলমান বাস্তবতা তো এটা অস্বীকার করে না যে আমাদের শিক্ষাঙ্গন কলুষিত। ছাত্ররাজনীতি একেবারেই ঠিক পথে নেই। আজ থেকে দুই-আড়াই দশক আগে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন ছাত্ররাজনীতি দেখেছি। অনেক কিছু বদলেছে, আবার অনেক কিছু বদলায়নি। লাঠালাঠি, কোপাকুপি থেকে গেছে এখনো। সাধারণ শিক্ষার্থীরা আজও নির্যাতিত। এমন অবস্থায় একজন সাধারণ মেধাবী তরুণ বা তরুণী বিদেশমুখী হয়ে স্বাভাবিক জীবন বেছে নেবে না কেন? তারপরও বিচলিত বোধ করি, যখন ভাবি, যারা মেধাবী, তারা যদি এভাবে শয়ে শয়ে দেশ ছাড়তে থাকেন, তাহলে দেশটাকে কারা এগিয়ে নেবে? ভবিষ্যতে কারা নেতৃত্ব দেবে?ঠেকার কাজ চালানোর মতো লোক দিয়ে একটি দেশ কীভাবে সামনের দিনগুলোতে কঠিন, কঠোর প্রতিযোগিতায় নাম লেখাবে? দেশে মেধাবী তরুণদের ধরে রাখার কি কোনো উপায় নেই ২। যাঁরা পড়তে যান বা পড়া শেষে সেখানে কাজ জুটিয়ে নেন, স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য অনুমতি পান, সবার খবর শুনে, ছবি দেখে ভালো লাগে। তাঁদের কেউ কেউ বলেন, তাঁরা যেখানে গেছেন, সে দেশে বা সে শহরে একটা লাইফ (জীবন) আছে। লেখাপড়া, কাজ, আড্ডা, বেড়ানো—সবই চলছে। অবশ্য লাইফের ধারণা সব সময়ই ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। একজন মানুষ কীভাবে তাঁর জীবন গোছাবেন, এটা একান্তই তাঁর নিজস্ব ব্যাপার। তারপরও আমাদের বিশেষ করে ২ কোটি ১১ লাখ মানুষের ঢাকা শহরে যতটা বায়ুদূষণ, যতটা শব্দদূষণ, এই যন্ত্রণা থেকে তো তাঁরা আপাতত মুক্তি পেয়েছেন, এটা ভেবে আমার ভালোই লাগে। ৩। তারপরও তরুণদের এই বিদেশমুখিতাকে নেতিবাচক হিসেবে দেখি না, ইতিবাচকই বলতে হবে। কিন্তু জরুরি প্রশ্ন হলো, উন্নত রাষ্ট্রে পড়াশোনা করে দক্ষতা অর্জন শেষে তাঁরা কি দেশে ফিরে আসতে পারবেন? আসা দরকার। আমরা দেখছি, অনেক ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলার পুত্রকন্যারা লেখাপড়া শেষে দেশে ফিরে আসছেন। এসে অনেকেই পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরছেন। আবার কেউ কেউ যাওয়া-আসার মধ্যে আছেন। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা তুলনামূলক কম ফিরছেন বলে মনে হয়। তাঁরা বলছেন, তাঁদের দক্ষতা অনুযায়ী দেশে কাজের সুযোগ নেই। তার চেয়ে উন্নত বিশ্বের দেশে, যেখানে তাঁরা আছেন, চাকরি করার সুযোগ, বসবাসের পরিবেশ ভালো। অর্থ আয়ই সব সময় উন্নত জীবনযাপন বা ভালো থাকার একমাত্র নির্ণায়ক হয় না। সরকারি সেবা, নিরাপত্তা, স্বাধীনতা, মর্যাদা অনেক কিছুই এর সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু আমরা কি আমাদের মেধাবী তরুণদের হেলায় হারাব? তাঁদের দেশের কাজে লাগাব না? দেশের কাজে তাঁদের লাগাতেই হবে। এ জন্য সব সময় যে দেশে এসেই কাজ করতে হবে, এমন নয়। বিদেশে বসেও দেশের জন্য কাজ করা যায়। কেবল বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বিদেশে খেলতে গেলে তাদের সমর্থন করার মধ্যে দেশপ্রেম সীমাবদ্ধ রাখলে চলে না। আমাদের যেসব তরুণ বিদেশে পড়তে গিয়ে আর ফিরে আসেননি, সেখানে চাকরি, ব্যবসা বা গবেষণা করছেন, তাঁদের দেশের কাজে কীভাবে ব্যবহার করা যায়, এ বিষয়ে জোরেশোরে আলোচনা শুরুর দরকার আছে। যে দেশে মানুষের জন্ম, যেখানে দীর্ঘসময় বসবাস, সে দেশ ছেড়ে মানুষ কখন যান? চেনা-জানার গণ্ডি পেরিয়ে, কেউ যখন দূর দেশে উপস্থিত হন, তখন কি তার জন্য শুধু সুখ আর সুখ অপেক্ষা করে? অন্য ভাষা, অন্য মানুষ ও বিচিত্র ভৌগোলিকতা ভেদে জীবনের সে অধ্যায়ের পাতায় ভাগ্য কতটা সুপ্রসন্ন থাকে? কথিত আছে, জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর চীন দেশে যেতে হলে যাও। বাংলাদেশী তরুণদের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা দেখে বলা যায়, এ কথার মর্ম তারা ভালোই বুঝতে পেরেছেন। শুধু চীন নয়, উচ্চশিক্ষার জন্য তারা এখন বিশ্বের সব প্রান্তে ছুটছেন। যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত বিদেশী শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রকাশিত ‘ওপেন ডোরস-২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া বিশ্বের ২৫ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৩তম। বর্তমানে দেশটিতে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০ হাজার ৫৯৭। সাকলাইন মোস্তাক নামে এক শিক্ষার্থী লুইজিয়ানা ইউনিভার্সিটিতে ক্যান্সার ফার্মাকোলজি বিষয়ে পিএইচডি করছেন। তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যাওয়ার আগে একজন শিক্ষার্থীর তিন-পাঁচ বছরের প্রস্তুতি ও ৩-৪ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। জিআরই বা টোফেলে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আবেদন ও ফাইল পাঠাতে, সেভিস ফি, ভিসা ফি এবং অন্যান্য খরচে এসব অর্থ ও সময় ব্যয় হয়। এটা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের চিত্র। বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, চীন, মালয়েশিয়া, জার্মানিসহ অন্য ইউরোপীয় দেশগুলো পছন্দের তালিকায় রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও এখন শিক্ষার্থীরা যাচ্ছেন। তারা যে শুধু বৃত্তি নিয়ে যাচ্ছেন তা নয়, বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে যাওয়া অনেক শিক্ষার্থীর পরিবারকে সম্পত্তি বন্ধক কিংবা জমানো সঞ্চয় খরচ করতে হয়। কানাডা সরকারের ইমিগ্রেশন, রিফিউজিস অ্যান্ড সিটিজেনশিপ (আইআরসিসি) বিভাগের তথ্যানুসারে, দেশটিতে অধ্যয়নে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের আবেদন ২০১৬-১৯ সালের মধ্যে ২৭০ শতাংশ বেড়েছে। ইউনেস্কোর তথ্যানুযায়ী, ২০১৫ সালে দেশের বাইরে পড়তে গিয়েছিলেন ২৪ হাজার ১১২ শিক্ষার্থী। ২০২০ সালে সে সংখ্যা চার গুণ বেড়েছিল। ইউনেস্কোর তথ্য বলছে, উচ্চশিক্ষার জন্য প্রতি বছর গড়ে ৭০-৮০ হাজার বাংলাদেশী শিক্ষার্থী বিদেশে ভ্রমণ করছেন। যদিও প্রতি বছর বাংলাদেশে যত শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দাঁড়ায়, সে তুলনায় এ সংখ্যা খুব কম। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বিদেশে যারা যাচ্ছেন, মেধা ও দক্ষতার জোরেই যাচ্ছেন। দুঃখজনক হলো, দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েট থেকে প্রতি বছর বড় একটি সংখ্যা বিদেশ চলে যান, সেখান থেকে খুব কমই দেশে ফিরে আসতে চান। শুধু শিক্ষার্থী নন, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর নার্স,ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরাও দেশ ছাড়ছেন। অনেক শিক্ষক বিদেশে এমএস ও পিএইচডি করতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়ে যান। বিদেশে থাকাকালীন তারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়মিত বেতন নেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পাঁচ বছরের বেশি সময় তাদের বেতন দিয়ে যায়। কিন্তু ডিগ্রি শেষে দেশে ফিরতে তারাও অনিচ্ছুক। মূলত শিক্ষা বা ডিগ্রিকে বিদেশে ঠাঁই নেয়ার একটা উপায় হিসেবে ব্যবহার করেন তারা। আবেগী জায়গা থেকে দেশপ্রেমের কথা আসতে পারে, কিন্তু যারা পরদেশে স্থায়ী হতে চান তাদের কতটা দোষারোপ করতে পারবেন? বাস্তবিক অর্থে তাদের কাছে এ দেশে থাকার মতো কোনো কারণ নেই। মানহীন শিক্ষা কারিকুলাম, অপর্যাপ্ত চাকরির বাজার, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে বিদেশের মাটিতেই তারা স্বপ্ন বুনছেন। এ সংকট নিয়ে দেশত্যাগী ও সরকার উভয়কেই ভাবতে হবে। কেউ যদি বসবাসের জন্য উপযোগী বা নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা ভেবে দেশ ছাড়েন, সেটি আরেকবার ভাবতে হবে। কারণ, যে দেশে তারা ভবিষ্যৎ দেখছেন, সেখানকার পরিবেশ যে অনিরাপদ হয়ে উঠবে না, তার নিশ্চয়তা কি? উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ২০১৯ সালে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে গুলিবর্ষণ ও সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক সহিংসতা বেড়ে যাওয়া। শ্রীলংকার অবস্থাও তো একসময় ভালো ছিল। এছাড়া কানাডা সরকার কিছুদিন আগে দেশটিতে বিদেশীদের বাড়ি কেনা বন্ধ করেছে। এতে অনেক প্রবাসী বিপাকে পড়েন। কারণ কানাডায় স্থায়ী ও আবাসন করার জন্য অনেকে সেখানে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। কেউ নিজের সবটুকু সঞ্চয় নিয়ে সেখানে পাড়ি জমিয়েছেন। সরকারকে মনে রাখতে হবে, কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে ভাবলে দেশ সুষ্ঠুভাবে এগোবে না। সরকারকে বুঝতে হবে, তরুণদের ছাড়া দেশ স্মার্ট হবে না। তারা নিজ দেশের মাটি, জল, আলো বাধ্য হয়ে ছাড়ছেন। যে কেউ বা কোনো সংস্থা যদি তরুণদের মাঝে জরিপ চালায়, যদি তরুণদের প্রশ্ন করা হয়, ‘বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছা বা পরিকল্পনা আছে কিনা’ জবাবে ৭০-৮০ শতাংশ উত্তর আসবে হ্যাঁ। এর কারণ হিসেবে উন্নত শিক্ষা, জীবনমান, স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদার কথাই আসবে। উচ্চশিক্ষা অর্জনে বিদেশে যাওয়া অবশ্যই ইতিবাচক, কিন্তু ফিরে না আসাটাই উদ্বেগ ও অর্থহানির। এজন্য সরকারকে শিক্ষার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা ও বিদেশী ডিগ্রিধারীদের দেশে কাজের সুযোগ করে দিতে হবে। বিকল্প হিসেবে সরকার বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাংলাদেশে শাখা খোলার অনুমোদন দিতে পারে। ভারত এরই মধ্যে ইয়েল, অক্সফোর্ড ও স্ট্যানফোর্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাস খোলার অনুমতি দিতে একটি খসড়া তৈরি করেছে। ইউএনএফপিএর তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের বয়স ১৫-৩৫ বছর। এ বয়সে মানুষ দ্রুত শিখতে পারে ও নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারে। অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্ব তাদের নিম্নমুখী জন্মহারের কারণে কর্মী চাহিদা মেটানোর জন্য শিক্ষায় বৃত্তি দিয়ে অভিবাসী নিচ্ছে। আর এ সুযোগ লুফে নিচ্ছেন বাংলাদেশী তরুণরা। পাঁচ বছর আগে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম এক জরিপে দেখেছে, বাংলাদেশ থেকে ১৫-২৯ বছর বয়সী ৮২ শতাংশ মানুষ দেশ ছাড়তে আগ্রহী। দেশে ভালো গবেষণাগার নেই, মানসম্মত পরীক্ষাগার নেই। গবেষণা বাড়ানো ও দক্ষ স্নাতক তৈরির জন্য গবেষণাগার নির্মাণ, ভালো একাডেমিক পরিবেশ নিশ্চিতে সরকারকে মেগা পরিকল্পনা করতে হবে। কারণ দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লেও স্থানীয় চাকরির জন্য স্নাতক তৈরি হচ্ছে। সে চাকরি পেতেও তারা হিমশিম খাচ্ছেন। আবার ভালো ও দক্ষ একাডেমিক রেকর্ডধারী শিক্ষার্থীরা দেশে পছন্দের চাকরি পাচ্ছেন না। মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা একটি চাকরি পেলেও তাদের জীবন এবং পরিবার সহজভাবে চালাতে পারেন না। তবে বিদেশে একটি চাকরি বা কর্ম পেলে তারা কাঙ্ক্ষিত জীবনযাপনের আশা দেখেন। আর্থিক খাত, স্বাস্থ্য, উন্নয়ন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ দেশের প্রতিটি সেক্টরে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা প্রাধান্য পেয়েছে। এসব দেখে হতাশ হয়ে তরুণরা শিক্ষা ও চাকরির জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছেন। সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করছে। এ লক্ষ্যে তরুণদের ধরে রাখতে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের বিকল্প নেই। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একটি সমন্বিত চেষ্টা থাকতে হবে। একই সঙ্গে তরুণদেরও দেশের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতার কথাটি মনে রাখতে হবে। বিদেশে থেকেও দেশ, দেশের মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগ রয়েছে। কারণ, দেশটা আমাদের সবার। প্রত্যেকে যার যার জায়গা থেকে সৎ ও সুন্দরভাবে নিজ দায়িত্ব পালন করলে ২০৪১ সাল লাগবে না, তার আগেই দেশ স্মার্ট হয়ে যাবে। প্রযুক্তি, সামাজিক নিরাপত্তা, জীবনমান, আইনের শাসন আর স্থিতিশীলতায় আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। বিপরীতে দেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতায় সে নিরুৎসাহিত হয়। এ ছাড়া কাজের পরিবেশের অভাব, যোগ্যতার অবমূল্যায়ন সর্বোপরি বিকশিত হওয়ার অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা মূলত মেধাবী তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশকে উন্নত দেশে স্থায়ীভাবে থাকতে বাধ্য করে। মোদ্দাকথা হলো তরুণ প্রজন্মকে দেশের মাটিতে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা থাকলে তাদের বিদেশ যাওয়ার স্রোত হয়তো আরও কমানো যেতো। তাদের মেধা, বুদ্ধি আর কর্মশক্তি দেশের জন্য কাজে লাগানো যেতো। এতে উন্নয়ন অগ্রগতির চাকায় গতি আরও বাড়তো। এখনই তরুণদের নিয়ে এমন পরিকল্পনা না সাজালে ভবিষ্যৎ হয়তো খারাপ কোনো বার্তা বয়ে নিয়ে আসতে পারে।