খেলাপি ঋণের বোঝা ছিল মাথায়। টাকার অঙ্কে তা ৪ কোটি ৭৮ লাখ। ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার টিকিটই যেন হাবিবর রহমানের কাছে হয়ে ওঠে ‘জাদুর চেরাগ’। ঋণের বোঝা মাথা থেকে নামাতে সময় বেশি নেননি। টানা তিন মেয়াদে এমপি থাকায় তিনিসহ পরিবারের সদস্যরা ১৫ বছরে সম্পদের চূড়ায় উঠে বসেছেন। নির্বাচনী হলফনামায় দেওয়া সম্পদের তথ্যই বলছে, এ কয়েক বছরে এমপি হাবিব ও তাঁর পরিবারের সম্পদ বেড়েছে ৩০০ গুণ। তবে একাদশ সংসদ নির্বাচনে তাঁর বিরুদ্ধে সম্পদের হিসাব বিবরণীতে তথ্য গোপন করারও অভিযোগ উঠেছিল। ২০১৮ সালের ১৯ এপ্রিল দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয় থেকে এমপি হাবিবর রহমান, স্ত্রী খাদিজা হাবিব, ছেলে আসিফ ইকবাল সনি, মেয়ে ফারজানা দিবার জ্ঞাত আয়বর্হিভূত সম্পদের হিসাব চাওয়া হয়। দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক নুরুল ইসলাম এ ব্যাপারে বিভিন্ন দপ্তরে সম্পদের বিবরণীর তথ্য চেয়ে চিঠি দেন। পরে এই বিষয়টি আর এগোয়নি। নবম সংসদ নির্বাচনে হাবিবর রহমান নিজ নামে ৫০ হাজার টাকা মূল্যে ১০ বিঘা কৃষিজমি ও ৫ লাখ ৫৪ হাজার ৫০০ টাকা মূল্যের (ঢাকার দক্ষিণ নিকুঞ্জতে ব্লক ৩সি, ৮ নম্বর প্লট) অকৃষি জমি দেখিয়েছিলেন। এ সময় তাঁর ব্যাংকে জমা ছিল ২ লাখ ৭৭ হাজার ৪৭৫ টাকা। আর ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার বন্ড ও ২৫ লাখ টাকার শেয়ার সঞ্চয় দেখিয়েছিলেন। খেলাপি ঋণ ছিল ৪ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। স্ত্রীর নামে একটি মাইক্রোবাস ও প্রাইভেটকার ছাড়া কোনো নগদ অর্থই ছিল না। এরপর তৃতীয় মেয়াদে এসে তিনি ও পরিবারের সদস্যরা ‘টাকাওয়ালা’ হয়ে যান। একাদশ সংসদ নির্বাচনে হলফনামার নিজ নামে নগদ টাকা দেখিয়েছেন ১ কোটি ৫১ লাখ ৫৭ হাজার ৬১১ টাকা। ব্যাংকে জমা ৬০ লাখ ২৯ হাজার ৭০৪ টাকা। শেয়ার দেখিয়েছেন ৪০ লাখ টাকার। স্ত্রীর নামে ৯ লাখ ৯৪ হাজার ৪৬৮ টাকা মূল্যের সাড়ে তিন বিঘা কৃষিজমি। নগদ টাকা ছিল ২৫ লাখ ৮১ হাজার টাকা। এ ছাড়া ব্যাংকে জমা ২ লাখ ২১ হাজার ৭৫৭ টাকা। শেয়ার সঞ্চয় ছিল ১০ লাখ টাকা। হলফনামায় এমপি হাবিব ঢাকার নিকুঞ্জতে ৯৩ লাখ ৩৫ হাজার ৬৩৩ টাকার একটি বিলাসবহুল বাড়ি দেখান। আদতে ওই বাড়ির বাজারদর ১৫ কোটি টাকার ওপরে। এ ছাড়া ঢাকার মোহাম্মদপুরে তাঁর একটি ফ্ল্যাট থাকলেও সেটি সম্পদ বিবরণীতে ছিল না। স্ত্রীর পাশাপাশি একমাত্র ছেলে আসিফ ইকবাল সনি অঢেল সম্পদের মালিক। অথচ তাঁর সম্পদের হিসাব কোনো হলফনামাতেই উল্লেখ নেই। শেরপুর উপজেলায় ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের পাশে খোদ্দর মৌজায় ১৮৬.১৮২ দাগসহ অন্যান্য দাগে সনি ২২ বিঘা জমি কিনে সেখানে এবি ব্রিক ফিল্ড (ইটভাটা) স্থাপন করেন। ধুনট উপজেলা সদরে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোর পূর্ব পাশে ধুনট মৌজায় ২০ শতক জমি ২০১৫ সালে ৩৪৫৪ নম্বর রেজিস্ট্রি দলিলের মাধ্যমে কেনেন। ওই জমির বর্তমান বাজারদর প্রায় ২ কোটি টাকা (২০ লাখ টাকা শতাংশ হিসেবে)। সেখানে রয়েছে কয়েক কোটি টাকার তিনতলা একটি ভবন। এ ছাড়া ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের পাশে শেরুয়া মৌজার ৭২৭ নম্বর দাগে ৩ কোটি টাকা মূল্যে ৫৮ শতক জমি এমপির ছেলে একটি ভুয়া দলিলের মাধ্যমে দখল করে নিয়েছেন। জমির প্রকৃত মালিক মনসুর বেপারি অভিযোগ করেন, ক্ষমতার জোরে ওই জমি থেকে তাঁকে উচ্ছেদ করে এইচ আর ফিলিং স্টেশন নির্মাণ করার পরিকল্পনা করা হয়। সে অনুযায়ী সীমানাপ্রাচীর ও যমুনা অয়েল কোম্পানিতে আবেদনও করা হয়েছে। এমপির পাশাপাশি তাঁর পরিবারের সদস্যরা ব্যবহার করছেন কোটি টাকা মূল্যের একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি। হলফনামায় স্ত্রীর নামে একটি মাইক্রোবাস ও কার দেখানো হলেও এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর শুল্কমুক্ত একটি জিপ গাড়ি ছাড়াও স্ত্রী, ছেলেসহ পরিবারের সদস্যদের কয়েক কোটি টাকা মূল্যের একাধিক প্রাইভেটকার গাড়িবহরে যোগ হয়েছে। এ ছাড়া এমপি পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে আরও অনেক সম্পত্তি থাকার অভিযোগ থাকলেও সেসব সম্পদের তথ্য নিশ্চিত হতে পারেনি।