ডেঙ্গু পরিস্থিতির চরম অবনতি, সেপ্টেম্বরের ২৩ দিনেই প্রাণ গেল ৩০০ জনের

প্রকাশিতঃ সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২৩ | ১০:১০ অপরাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

চলতি বছরের ৯ মাসের মধ্যে সেপ্টেম্বরের ২৩ দিনেই ডেঙ্গুতে রেকর্ড মৃত্যু দেখল বাংলাদেশ। এ সময় ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৩০০ জন। আক্রান্ত হয়েছেন ৬০ হাজার ৯০৯ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৪ জনের মৃত্যু ও ২৮৬৫ জন আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগীও এর মধ্যে রয়েছে। বিপজ্জনক তথ্য হলো, বাংলাদেশে ডেঙ্গুর ইতিহাসে এ বছরের ন্যায় এত বড় মৃত্যুর মিছিল ছিল না। চলতি বছরের মধ্যে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ সময়ে আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান শুধু ঊর্ধ্বমুখীই। সংশ্লিষ্টরা জানান, ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর ২৩ বছরের রেকর্ডও ভেঙেছে। পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। এবার ধারণা করা হচ্ছিল জুন থেকে আগস্ট- এই তিন মাস বর্ষার মৌসুম হওয়ায় এ সময়টায় ডেঙ্গুর ভয়াবহতা চূড়ায় ঠেকবে। এরপর ধীরে ধীরে সহনীয় হয়ে আসবে পরিস্থিতি। বিশেষজ্ঞরা তখন এমন আভাসই দিয়েছিলেন। কিন্তু না। পরিস্থিতির কোনো ভালো লক্ষণ নেই। বিগত বছরের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যায়, বছরজুড়েই চলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। কিন্তু মৃত্যু কিংবা আক্রান্ত আশঙ্কাজনক হারে এভাবে বাড়েনি। এ বছর সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। সেপ্টেম্বরের ২৩ দিনে এত সংখ্যক মৃত্যু সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। আগামী দিনগুলোর পরিস্থিতি ঠিক কোথায় গিয়ে পৌঁছে, তা নিয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মনে। জনস্বাস্থ্যবিদরাও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, শুক্রবার সকাল থেকে শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ২ হাজার ৮৬৫ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৮১৪ জন। ঢাকার বাইরে ২ হাজার ৫১ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ১৪ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ছয়জন এবং ঢাকার বাইরের আটজন। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন মোট ১ লাখ ৮৪ হাজার ৭১৭ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৭৮ হাজার ১০৩ জন। আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন ১ লাখ ৬ হাজার ৬১৪ জন। সরকারের রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন শনিবার বলেন, মশক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা সঠিকভাবে না হওয়ায় পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছে। এই চেষ্টা নিয়মিত চললেও সফলতা দেখতে অন্তত আরও এক বছর লাগবে। আর ডেঙ্গুতে ধারাবাহিক মৃত্যু বাড়ার কারণ এখনো স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংস্কার হয়নি। এখনো প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্তকরণ, ল্যাবরেটরি টেস্ট, ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের মাধ্যমিক স্তরের হাসপাতালে রাখার ব্যবস্থাও হয়নি। রোগী বাড়তে থাকলেও মৃত্যুর সংখ্যাও এই হারে থাকার আশঙ্কা রয়েছে। রোগী কমলে মৃত্যু কমবে। তিনি আরও বলেন, এই ধারা কতদিন চলবে তা রোগতত্ত্ববিদরা একা বলতে পারবেন না, আবহাওয়াবিদদের পরামর্শ লাগবে। আবহাওয়াবিদরা বৃষ্টিপাতের বিষয় বলতে পারবেন। কারণ মশা বংশবিস্তারের সঙ্গে বৃষ্টির সম্পর্ক রয়েছে। থেমে থেমে বৃষ্টি হলে আগামী মাসেও মশার প্রকোপ থাকবে। তখন ডেঙ্গুতেও আক্রান্ত হবে। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, ডেঙ্গু রোগীর সেবায় গ্রামাঞ্চলে কাঠামো আছে কিন্তু চিকিৎসা ও ল্যাবরেটরি ব্যবস্থা নেই। শহরে সব সেবা থাকলেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্বাস্থ্যসেবা নেই। অথচ ডেঙ্গুর এই অনিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতি সহনীয় করতে হলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার স্তরভিত্তিক সেবা নিশ্চিত করতে হবে। অস্থায়ীভাবে হলেও শহরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চালু করে ডেঙ্গু শনাক্তকরণ নিশ্চিত করতে হবে। যাদের আইসিইউ দরকার হবে না, তাদের সিটি করপোরেশনের হাসপাতালগুলোতে রাখতে হবে। অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলে ডেঙ্গু টেস্টের ব্যবস্থা করতে হবে। জটিল রোগীদের স্থানীয় হাসপাতাল ও জেলা হাসপাতালে নিতে হবে। এভাবে রোগী শনাক্ত হলে মৃত্যু কমে যাবে। এই ধরনের শৃঙ্খলাভিত্তিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল, মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড সব জায়গাতেই আছে। তারা এই পদ্ধতিতে সফল হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এ বছরের জুন থেকে প্রতিদিন ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। মাসের হিসাবে জুনে যেখানে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৫ হাজার ৯৫৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, জুলাইয়ে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩ হাজার ৮৫৪ জনে। আগস্টে ৭১ হাজার ৯৭৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। এর আগে বছরের শুরুতে জানুয়ারি মাসে এই সংখ্যা ছিল ৫৬৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন, মার্চে ১১১ জন, এপ্রিলে ১৪৩ জন, মে মাসে ১ হাজার ৩৬ জন এবং জুন ৫ হাজার ৯৫৬ জন। এদিকে, আক্রান্তের পাশাপাশি মৃত্যুর মিছিলও একইভাবে বেড়ে চলেছে। চলতি বছরের মাঝামাঝিতে এসে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। জুনে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়। জুলাইয়ে মৃত্যুর এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২০৪ জনে। জুলাইয়ের রেকর্ডও ভেঙে যায় আগস্টে। এ মাসে মারা যান ৩৪২ জন। আগস্টের মৃত্যুর পরিসংখ্যানও অতীতের যে কোনো সময়ের মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়ে যায়। বছরের প্রথম ভাগে জানুয়ারিতে ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩ জন, এপ্রিলে ২ জন ও মে মাসে ২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর মোট চারটি ধরন রয়েছে। এবার ডেঙ্গুর ডেন-২ এবং ডেন-৩ এর প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যাচ্ছে। ডেঙ্গুর সংকট নিরসনে ব্যক্তির চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যেন ডেঙ্গুঝুঁকি তৈরি করতে না পারে সেটি নিশ্চিত করা দরকার। বর্তমানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আমদানিকৃত বিটিআই এডিস মশা নিধনে ৯২ শতাংশ কার্যকর। লার্ভা নিধনে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে।