মার্কিন ভিসানীতির প্রয়োগ নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। গণতান্ত্রিক নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় বাধা দিলে ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। এরই মধ্যে ভিসানীতির প্রয়োগ শুরু হয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের তরফে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এমন ঘোষণার পরপরই দুই বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যে শুরু হয়েছে বিতর্ক। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে, বিএনপি ও তাদের জোটভুক্ত দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে। তারা সংবিধানের আওতায় বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে দেবে না। নির্বাচন প্রতিহত করার লক্ষ্যে বিএনপি সহিংসতার আশ্রয় নিতে পারে। ফলে ভিসানীতি তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ হওয়া উচিত। অপরদিকে, বিএনপি নেতারা বলছেন, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা বিগত দিনে সুষ্ঠু ভোটে বাধা দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আমলাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বাধা সৃষ্টি করে। তাই তাদের বিরুদ্ধে ভিসানীতির প্রয়োগ হলে আওয়ামী লীগের ওপর প্রভাব পড়বে বেশি। এছাড়াও, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে বাধা দিলে কিংবা ভয়-ভীতি সৃষ্টি করলে ভিসা নিষেধাজ্ঞায় পড়বে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতিতে ভিসানীতি এখন নতুন ইস্যু হয়ে উঠেছে। দুই দলই এই ইস্যুতে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য রাখছে। ভিসানীতি প্রয়োগ হলেও সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর আওয়ামী লীগ। ভিসানীতির কারণে বিএনপি কিছুটা উল্লসিত। বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে না। ভিসানীতির কারণে সরকার চাপে পড়বে বলে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন। তাদের মতে, রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক চলাচলে বাধার সৃষ্টি করা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, জানমালের ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধেও এই নীতি কার্যকর হবে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটতে থাকবে। জনগণের স্বাভাবিক চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়ার দায় নিতে হবে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে। আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবে। এতেও এক ধরনের বাধার আবহ তৈরি হবে। যার দায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা সরকারের ওপর বর্তাবে। এ কারণে মার্কিন ভিসানীতি এদেরও ছেড়ে কথা বলবে না। এ বিষয়গুলো ঘিরেই রাজনৈতিক পর্যায়ে চলছে বিতর্ক। একই সঙ্গে বিষয়টি ঘিরে সাধারণ মানুষের মাঝেও জোর আলোচনা চলছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই ভিসানীতির কারণে উভয়পক্ষ সাবধান হলে জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হওয়ার জোর সম্ভাবনা আছে। এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমেরিকায় বসে সাক্ষাৎকার দিয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। দেশের গণতন্ত্রকে রক্ষার দায়িত্ব জনগণ সাংবিধানিকভাবেই আওয়ামী লীগকে দিয়েছে। অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন করার সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে। শাসনতন্ত্র রক্ষা করা, গণতন্ত্র রক্ষা করা মৌলিক বিষয়। কোনো দেশের পরামর্শে ভুল পথে আমরা পরিচালিত হতে পারি না। আমাদের গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য আমরাই যথেষ্ট। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার নামে অগণতান্ত্রিক শক্তিকে এগিয়ে আনা, বিরাজনীতিকরণ বাংলাদেশের জনগণ মেনে নেবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভিসানীতির কারণে বিএনপি-জামায়াত আনন্দিত, উল্লসিত, উৎফুল্ল। দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডে তোষণ করা বিএনপির নীতি। বিএনপি-জামায়াত নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করায় বিশ্বাসী। বাংলাদেশের অসম্মানকে তারা সমর্থন করে। বিএনপির অতীত অপকর্ম, দুর্নীতি, জঙ্গিবাদে ভরপুর। নির্বাচন বানচাল করার কোনো প্রচেষ্টাকে বাংলাদেশের জনগণ সমর্থন করবে না।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘ভিসানীতি কেন করা হয়েছে সেটা শেখ হাসিনা তো বলেই দিয়েছেন। এটার প্রভাব কী সেটাও তিনি বলেছেন। এটা লজ্জার ব্যাপার। কিন্তু যাদের জন্যে লজ্জার ব্যাপার; তারা নির্লজ্জ। যাদের কারণে এই লজ্জাজনক ঘটনা ঘটেছে তারা লজ্জা পাচ্ছেন না। দেশকে এই অবস্থায় তারাই নিয়ে গেছেন। আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডের কারণেই ভিসানীতি এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাসযোগ্য, সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচনের কথা বলছে। শুধু তত্ত্বাবধায়ক শব্দ তারা ব্যবহার করছে না। তারা বাইরের মানুষ তাই এই শব্দ ব্যবহার করছে না। কিন্তু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশের জন্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রয়োজন এটা যুক্তরাষ্ট্র বোঝে।’ ভিসানীতি রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর সমানভাবে প্রযোজ্য বলছে যুক্তরাষ্ট্র। এ সম্পর্কে মতামত জানতে চাইলে এই বিএনপি নেতা বলেন, ‘সরকার নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়ায় তার বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করছি। এটা আমাদের অধিকার। যুক্তরাষ্ট্র যা চাইছে একই জিনিসের জন্য আমরা লড়াই করছি। বর্তমান আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে না। তার জন্য আমরা আন্দোলন করছি।’ যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যাদের বিরুদ্ধে ভিসানীতির প্রয়োগ হয়েছে, তাদের ব্যক্তিগতভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে যাদের বিরুদ্ধে ভিসানীতির প্রয়োগ হচ্ছে, তাদের মধ্যে সরকার ও বিরোধী পক্ষের কারও কারও নাম আছে বলে জানা গেছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন ২৪ মে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তার লক্ষ্যে নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেন। গণতান্ত্রিক নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এমন বর্তমান ও সাবেক বাংলাদেশি কর্মকর্তা, সরকার ও বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, বিচার বিভাগের সদস্য, নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে এ পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে। গণতান্ত্রিক নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার অর্থ হলো-ভোট কারচুপি, ভোটারকে ভয়ভীতি দেখানো, শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশে বাধা দান, রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ, মিডিয়াকে মতপ্রকাশে বাধা দেওয়া। এসব কর্মকাণ্ডের জন্য ভিসানীতির প্রয়োগ হতে পারে।