নিষেধাজ্ঞা একটি ভোঁতা অস্ত্র

প্রকাশিতঃ সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৩ | ৯:৩৫ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

প্রায় সপ্তাহেই পশ্চিমা শহরগুলো থেকে নতুন নতুন সব নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা আসে। এটি একটি জনপ্রিয় কূটনৈতিক হাতিয়ার। শুধু মার্কিন সরকারই নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ মিত্রই এর পেছনে থাকে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও মানুষকে শায়েস্তা করার জন্য নিষেধাজ্ঞার এ ধারা জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। কারণ এ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এড়ানোর জন্য তারাও নানা কৌশল ও ফাঁকফোকর খুঁজে বের করে পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখে। রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেওয়া নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিই দেখা যাক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য দেশ রাশিয়ার বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির ওপর এক হাজারেরও বেশি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কিন্তু এসব নিষেধাজ্ঞা কি সত্যিই কাজে দিয়েছে? এর ফলে কি পশ্চিমের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন হয়েছে? নিষেধাজ্ঞায় পড়া দেশগুলো এর ফলে প্রভাবিত হয়ে কি আদৌ নিজেদের শুধরেছে? এসব নিষেধাজ্ঞার ফলাফল কি খতিয়ে দেখা হয়েছে, বিশেষ করে মানবিকতার বিচারে? এসব নিষেধাজ্ঞা কি আন্তর্জাতিক কূটনীতির একটি অলস হাতিয়ার হয়ে উঠেছে? হাতিয়ার হিসাবে নিষেধাজ্ঞা নতুন নয়। এমন অশোভনীয় অবরোধ এবং অবরোধের মাধ্যমে অর্থনৈতিক যুদ্ধ আগেও পরিচালিত হয়েছে। ক্যাথলিক চার্চ বহু শতাব্দী ধরে বহিষ্কারের এমন শাস্তিমূলক পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। অবশ্য সেসব মধ্যযুগীয় বর্বরতার কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন নিষিদ্ধ। ২০২১ সালে জার্মানির এক সমীক্ষায় দেখা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন দেশের ওপর এক হাজার চার শতাধিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে বা তাদের এ ধরনের হুমকি দেওয়া হয়েছে। এ নিষেধাজ্ঞাগুলোর অধিকাংশেরই ফলাফল খতিয়ে দেখা হয়েছে। কার্যকারিতার ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো ব্যতিক্রম ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ শাসনের বিরুদ্ধে দেওয়া নিষেধাজ্ঞা, যা ব্যাপকভাবে সফল বলে বিবেচিত হয়েছিল। জাতিসংঘের আরোপিত সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক নিষেধাজ্ঞাগুলো কেবল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সম্ভব হয়েছিল, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একমাত্র আধিপত্যের দেশ হয়ে ওঠে। জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা হঠাৎ করেই ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। ১৯৯০ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ইরাকের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলো একটি জাতিরাষ্ট্রের ওপর আরোপিত সবচেয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল। তারা ইরাকের সামাজিক কাঠামো গুঁড়িয়ে দিয়েছে। অবশ্য ইরান ও লিবিয়া সরকারের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাব প্রভাব নিয়ে বিতর্ক আছে। চল্লিশ বছর ধরে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তেহরান সরকারকে খুব কমই প্রভাবিত করেছে বা বিপাকে ফেলেছে। ইরান কি নিষেধাজ্ঞা কাটানোর আশায় ২০১৫ সালে পারমাণবিক চুক্তিতে প্রবেশ করেছিল? বিষয়টা প্রশ্নবিদ্ধ। কিউবার ওপর নিষেধাজ্ঞার ৬০ বছর পর যুক্তরাষ্ট্র আদতে কী অর্জন করেছে? কিউবার অর্থনীতি ভেঙে পড়লেও এবং দারিদ্র্য ছড়িয়ে পড়লেও এর ফলে শাসনব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। নিষেধাজ্ঞা সহ্য করা উত্তর কোরিয়ার রাজনীতিতেও এর কোনো প্রভাবই পড়েনি। দুঃখের বিষয়, ইরাকে যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়, তা থেকে কিছুই শিখিনি আমরা। নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্য অবশ্যই পরিষ্কার হতে হবে। যারা নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়ে, তাদের জানতে হবে কেন তারা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ল এবং কী করলে তা প্রত্যাহার করা হবে। নিষেধাজ্ঞায় পড়া অনেক দেশ ও নেতারা দ্রুতই হিসাব করে নেয় যে, যারা নিষেধাজ্ঞা দেয় তাদের তা শিথিল করার কিংবা উঠানোর কোনো ইচ্ছাই আসলে নেই। এটি অবশ্যই সাদ্দাম হোসেনের ক্ষেত্রে এবং সম্ভবত বাশার আল আসাদের ক্ষেত্রে হয়েছিল। সিরিয়ার সরকারকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ ঠিক কী চেয়েছিল, সে ব্যাপারে কেউ কি নিশ্চিত করে বলতে পারবে? এসব রাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্য ছিল-এ ধরনের কোনো যুক্তিই ধোপে টেকে না। ইরাক ও সিরিয়া যেসব অপরাধ করেছে, তার সবই তো নথিভুক্ত রয়েছে। বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রভাবের দিকে তাকালে আসল প্রশ্নটি ওঠে; কিন্তু কোথায় এর সঠিক মূল্যায়ন? শাসকরা এটিকে মানিয়ে নেয় এবং আয়ের নতুন পথ বের করে নিতে পারলেও তারাই পারে না, যারা অভিজাত শ্রেণিতে পড়ে না, অর্থাৎ সাধারণ মানুষ। কোন পর্যায়ে নিষেধাজ্ঞাগুলো শাসনের স্বার্থে কাজ করা শুরু করে এবং সাধারণের ওপর দমন-পীড়ন বাড়ানোর হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার হয়? ইরাকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর সাদ্দাম প্রশাসন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাড়তি ব্যবস্থা হিসাবে রেশন কার্ডের প্রচলন করেন। ইরাকিরা যদি তাতে স্বাভাবিক আচরণ না করত, তাহলে তাদের রেশন কার্ড বাজেয়াপ্ত করা হতো এবং তাতে তারা গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য সহায়তা হারাত। আজ সিরিয়ার জনগণ আন্তর্জাতিক সাহায্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, যার বেশিরভাগই জাতিসংঘের মাধ্যমে দামেস্কে আসছে। সিরিয়ার সরকার নিশ্চিত করেছে যে, জাতিসংঘকে অফিসিয়াল এক্সচেঞ্জ রেট ব্যবহার করতে হবে, এর ফলে এটি হার্ড কারেন্সির সবচেয়ে লাভজনক উৎসগুলোর মধ্যে একটি হয়ে উঠেছে। উদ্দেশ্যপূর্ণ নিষেধাজ্ঞাগুলোর ব্যাপারে বোঝানো হয়, এতে সমস্যার নিরসন ঘটে। তারা আরও বোঝায়, এর ফলে বিশেষ অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হয় এবং তাদের শাস্তি দেওয়া হয়। যেমন সিরিয়ার অনেক কর্মকর্তা ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারেন না। অনেক রুশ কর্মকর্তা চাইলেও তাদের পছন্দের হট স্পটগুলোতে ছুটি কাটাতে যেতে পারেন না। ব্যাংকিং সেবাতেও নিষেধাজ্ঞা থাকে। নিষেধাজ্ঞার ধারা বজায় রাখতে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কিছু শক্তিশালী মামলাও তৈরি করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এতে কি কাজ হয়? কারণ যাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসে তারা বোঝে যে এটা প্রত্যাহারের কোনো পথ নেই এবং সে অনুযায়ীই তারা নিজেদের মানিয়ে নেয়। নিষেধাজ্ঞার অগণিত অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি রয়েছে। নিষেধাজ্ঞা পাওয়া দেশগুলো অন্য শক্তির অস্ত্রে চালিত হতে পারে। যেমন, সিরিয়া ও ইরান রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ হয়েছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পর চীনের ঋণদাতারা রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে বিলিয়ন ডলার দিয়েছে। রাশিয়াও ডলার কিংবা ইউরোর ওপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে রেনমিনবিকে (চীনের মুদ্রা) তার রিজার্ভ মুদ্রা হিসাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। যখন মার্কিন অর্থনীতি দুর্বল হয় আর চীন ও ভারতের মতো শক্তির উত্থান ঘটে, তখন মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মতো হুমকি তর্কাতীতভাবেই হ্রাস পায়। লক্ষ্যবস্তুকে এভাবে টার্গেট করার রেওয়াজকে নিষেধাজ্ঞায় পড়া দেশগুলো অত্যাধুনিক সব উপায়ে এড়িয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছে। সাধারণত, নিষেধাজ্ঞায় পড়া এসব দেশ চোরাচালান এবং যুদ্ধ অর্থনীতির মতো লাভজনক দিককে উন্মুক্ত করেছে। সিরিয়ার সরকার জাল ডকুমেন্টেশন তৈরি করেও লাভবান হয়েছে। সর্বোপরি, সিরিয়ার ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞা দেশটিকে স্বল্প পরিসরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ করতে বাধ্য করেছে। ক্যাপ্টাগন (এক ধরনের মাদক) বিশ্বের রাজধানী হয়ে উঠেছে সিরিয়া। অবৈধ পন্থায় মাদক পরিবহণ ও বিক্রিতে পরিচিত হয়ে ওঠা রাষ্ট্রটি বিলিয়ন ডলার মূল্যের আসক্তিযুক্ত অ্যামফিটামিন বিক্রি করে থাকে, যা বিশেষ করে সৌদি আরব এবং তার উপসাগরীয় প্রতিবেশীদের আক্রান্ত করেছে। যদিও সিরিয়ার সরকার এ বিপজ্জনক বাণিজ্য বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তবে শাসনের মূল কর্তাব্যক্তিদের জড়িত থাকার বিষয়টি বিবেচনা করে এটি কতটা কাজে দেবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা সন্দিহান। রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে বিতর্ক আরও জোরালো হচ্ছে। প্রত্যেকেই তাদের প্রভাবের বিষয়ে চিন্তা করে থাকে। তাদের কি রুশ নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের ওপর কোনো প্রভাব আছে? আর কে টার্গেট হতে পারে? রাশিয়ার বেসামরিক নাগরিকদের ওপর প্রভাব ফেলতে আরও কিছু করা যেতে পারে, যাদের যুদ্ধের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই। সিরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বিতর্ক কোথায়? মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে সিরিয়া নিয়ে কমই আলোচনা হয়। ইউরোপ ও মার্কিন কর্তৃপক্ষের কি তাদের নিষেধাজ্ঞার ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত নয়? এ নিষেধাজ্ঞাগুলো কি সিরিয়ায় মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের আঘাত করছে, নাকি জনগণকে? নিষেধাজ্ঞাগুলো সরকারকে আঘাত করেছে এমন প্রমাণ খুবই কম। শাসকদের বন্ধুদের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টগুলো থেকে বোঝা যায়, তাদের জীবনধারা এখনো বিলাসবহুল। তবুও কোনো সিরীয় বেসামরিক নাগরিকের সঙ্গে কথা বলুন, তাদের বর্ণনায় দেখবেন ব্যাপক হতাশা এবং তারা কী পরিমাণ অর্থনৈতিক মন্দার ভেতরে রয়েছে সে দিকটিও পরিষ্কার হবে। নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে বড় পরিসরে গবেষণা করে দেখা গেছে, এসব নিষেধাজ্ঞা আদতে দুর্বলকেই আক্রান্ত করে। ইরাক ও সিরিয়ার ক্ষেত্রে তেমনটাই ঘটেছে। নিষেধাজ্ঞার শক্তির মূল্যায়ন করতে গেলে মানবিকতার বিষয়টি অবশ্যই আমলে নিতে হবে। কেননা নিষেধাজ্ঞার এ শক্তি অবশ্যই মানবিকতার ওপর প্রভাব ফেলে এবং জনসাধারণের ওপরই এর বিরূপ প্রভাব খুব দ্রুত পড়ে। বস্তুত, যারা অপরাধ করে তাদের ওপরই কঠোর দৃষ্টি দিতে হবে; যারা নিরীহ ও ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের ওপর নয়। এসব কারণেই নিষেধাজ্ঞার মতো অস্ত্র কদাচিৎ কার্যকর ভূমিকা রাখলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা ব্যর্থ হয়। আরব নিউজ থেকে ভাষান্তর : খালিদ বিন আনিস ক্রিস ডয়েল : লন্ডনভিত্তিক ‘কাউন্সিল ফর আরব-ব্রিটিশ আন্ডারস্ট্যান্ডিং’-এর পরিচালক