লাগামহীন হয়ে পড়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। উপগ্রুপগুলোর অন্তর্কলহের কারণে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। চাঁদাবাজি, হলের কক্ষ দখল, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মারধরের মতো ঘটনায় অস্থিতিশীল হচ্ছে ক্যাম্পাস। বিঘ্নিত হচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ। অপকর্মের কারণে ছাত্রলীগের চবি শাখা কমিটি বিলুপ্ত করা হলেও সংঘাত-সংঘর্ষ থামছে না। তাদের কর্মকাণ্ডে সাধারণ শিক্ষার্থীরা রয়েছেন চরম আতঙ্কে। প্রশাসনের ব্যর্থতা ও রাজনীতির নামে ছাত্রলীগ নেতাদের গ্রুপিং এবং উচ্ছৃঙ্খল আচরণকেই দায়ী করা হচ্ছে। আওয়ামী-বামপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন হলুদ দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক সেকান্দর চৌধুরী বলেন, যে ঘটনাগুলো ঘটছে বা যারা ঘটাচ্ছে, তাদের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ নেই বলে মনে করি। ৭ সেপ্টেম্বর ভাঙচুরের ঘটনার পর যত ঘটনা ঘটেছে, এগুলোর জন্য সিন্ডিকেট সভা না ডাকায় আশ্চর্য হয়েছি। আগে এর চেয়ে ছোট ঘটনায়ও জরুরি অথবা সাধারণ সিন্ডিকেট ডেকে সিদ্ধান্ত নিতে দেখেছি। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের রাজনীতি মূলত দুই গ্রুপে বিভক্ত। একটি গ্রুপ শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের এবং আরেকটি সাবেক সিটি মেয়র ও চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসাবে পরিচিত। এ দুপক্ষের আবার দশের বেশি উপগ্রুপ রয়েছে। গত এক মাসে পাঁচ উপগ্রুপের মধ্যে অন্তত ছয়বার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ২৩ ও ২৪ অক্টোবর তিন হলে পাঁচবার তল্লাশি চালিয়ে বেশকিছু রামদা ও লাঠিসোঁটা জব্দ করে প্রশাসন। সর্বশেষ শুক্রবার খাবার নিয়ে তর্কাতর্কির জেরে দুই গ্রুপ সংঘর্ষে জড়ায়। এছাড়া আধিপত্য বিস্তার, কক্ষ দখল, চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে চলতি বছর অন্তত ১৩ বার নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ এবং বেশ কয়েকবার বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে তালা ঝুলিয়েছে বিভিন্ন উপগ্রুপ। এসব ঘটনায় দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। তবে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ ও সমালোচনার মুখে জড়িতদের বিরুদ্ধে ‘লোক দেখানো’ ব্যবস্থা নিতে দেখা গেছে কর্তৃপক্ষকে। ২০২১ সালের অক্টোবরে দুই উপগ্রুপের ১২ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছিল। পরে ‘মানবিক’ দিক বিবেচনা করে তা প্রত্যাহার করা হয়। এছাড়া ১০ জানুয়ারি বিভিন্ন অপকর্মে ১৭ ছাত্রলীগ কর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করা হয়। জুলাইয়ে মানবিক কারণে ৯ জনের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া বহিষ্কারাদেশ অমান্য করে হলে অবস্থান ও ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিলেও নির্বিকার ভূমিকায় থাকে প্রশাসন। চলতি বছর ছাত্রলীগের মারধর ও হেনস্তার শিকার হয়েছেন অন্তত তিন সাংবাদিক। সবশেষ ২৪ সেপ্টেম্বর সকালে সাংবাদিক মোশাররফ শাহকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এ ঘটনার পর চবি ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে কেন্দ্র। এছাড়া ১৯ জুন এক সাংবাদিককে মারধর এবং গায়ে চা ঢেলে নির্যাতন করেন দুই ছাত্রলীগ নেতা। তাদেরকে ছয় মাসের বহিষ্কারাদেশ দিলেও তা বাস্তবায়নে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। চাঁদার দাবিতে ছাত্রলীগের এক নেতা ২৮ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলীকে মারধর করলে প্রকৌশল দপ্তরের কর্মকর্তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির সরবরাহ বন্ধ করে দেন। এ ঘটনাকে ‘নজিরবিহীন অব্যবস্থাপনা’ বলেন চবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল হক। ৭ সেপ্টেম্বর রাতে উপাচার্যের বাসভবন ও পরিবহণ দপ্তরে ভাঙচুরের ঘটনায় ৯ সেপ্টেম্বর হাটহাজারী থানায় দুটি মামলা করে কর্তৃপক্ষ। মামলায় নাম উল্লেখ করা ১৪ আসামির ১২ জনই ছাত্রলীগের বিভিন্ন উপগ্রুপের নেতাকর্মী। ২৪ সেপ্টেম্বর বিকালে চবি ছাত্রলীগের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণার পর সন্ধ্যায় এক বিজ্ঞপ্তিতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অছাত্র-বহিষ্কৃতদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। বিজ্ঞপ্তিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হল ও ক্যাম্পাস দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন অছাত্র ছাত্রলীগ নেতারা। হলগুলোকে বহিরাগতমুক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে চবি প্রশাসন। সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সিরাজ উদ দৌল্লাহ বলেন, তাদের ভয় পেলে বিশ্ববিদ্যালয় চালানো যাবে না। এ নেতাদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে প্রশাসনের লোকজন বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে অযোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। চবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল হক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা এবং যদি কেউ এসবে বিঘ্ন ঘটায় তাকে শক্ত হাতে দমন করা। এ দায়িত্ব পালনে প্রশাসন পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। প্রক্টর ড. নুরুল আজিম শিকদার বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা আছেন, তারা সবাই দায়িত্বশীল। এতকিছুর পরও আমরা ক্লাস-পরীক্ষা স্বাভাবিক রাখতে সক্ষম হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে আমাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। ছাত্র সংগঠনগুলোই অনেক সময় অস্থির হয়ে যায়। তাদের বোঝানোও আমাদের জন্য মুশকিল হয়ে পড়ে। যেহেতু তারা ছাত্র, তাদের বোঝানোর মাধ্যমেই সংঘাত প্রশমিত করতে হয়। সার্বিক বিষয়ে জানতে উপাচার্য অধ্যাপক শিরীণ আখতারকে মোবাইল ফোনে কল দিলে তিনি তা কেটে দেন।