বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ বৈঠক শুরু কাল ডেল্টা প্ল্যান উত্থাপন করবে বাংলাদেশ

প্রকাশিতঃ অক্টোবর ৮, ২০২৩ | ৮:৩৪ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

গত তিন বছরে (২০২০-২০২৩) বাংলাদেশসহ বিশ্বের অর্থনৈতিক ক্ষতির অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। কোভিড-১৯, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মন্দাসহ বৈশ্বিক সংকটের ক্রমাগত ধাক্কায় বিপুল অঙ্কের এ ক্ষতি হয়েছে। এর প্রভাবে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির গতি বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। এতে বর্তমান প্রবৃদ্ধি গড়ে ৩.৮ শতাংশের নিচে অবস্থান করছে। একই সঙ্গে চলছে মূল্যস্ফীতির ঝড়ো হাওয়া। কিছু দেশ কমিয়ে আনতে পারলেও ২০২৫ সাল পর্যন্ত অনেক দেশেই মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকবে। বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পথ খুঁজতে সোমবার মরক্কোতে শুরু হচ্ছে অর্থনৈতিক জোটের সবচেয়ে বড় আসর আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভা। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৯০টি দেশের অর্থমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর সেখানে যোগ দেবেন। আইএমএফ সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। সূত্রমতে, এ বছর আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ‘ডেল্টা প্ল্যান-২১০০’ উপস্থাপন করা হবে। বিশ্বব্যাংকের আগ্রহের ফলে এটি উপস্থাপনের সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী। এ প্ল্যানের মাধ্যমে প্রায় তিন লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ আহ্বান করা হবে দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম জানান, ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নে প্রচুর বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রয়োজন। বিশ্বব্যাংকের বৈঠকে এর উপস্থাপনা ও সক্ষমতা তুলে ধরলে বিশ্বব্যাংক আকৃষ্ট হবে। আর বিশ্বব্যাংক এগিয়ে এলে অন্য সহযোগী সংস্থাগুলো আরও বেশি আকৃষ্ট হবে। বিশ্বব্যাংকের আগ্রহ আছে বলেই সংস্থাটি তাদের বৈঠকে এটি উপস্থাপন করতে বলেছেন। সংস্থাটি ডেল্টা প্ল্যান প্রসঙ্গে আরও বেশি জানতে চায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মরক্কোতে অনুষ্ঠেয় এই বৈঠক চলবে ৯ থেকে ১৫ অক্টোবর। সেখানে মূল্যস্ফীতিকে প্রধান অগ্রাধিকারে রাখা হয়েছে। কারণ, ২০২২ সালে বিশ্বজুড়ে মুদ্রাস্ফীতি বহু দশকের চেয়ে উচ্চতায় নিয়ে গেছে। গত দুই বছরের উচ্চ মূল্যস্ফীতির অভিজ্ঞতা ক্রমাগত উচ্চ মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা বাড়িয়ে দিতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মূল্যস্ফীতিকে তাদের লক্ষ্যে ফিরিয়ে আনার পথকে জটিল করে তুলতে পারে-এমন আশঙ্কাও করা হচ্ছে। এছাড়া বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ডিজিটাল অবকাঠামো তৈরি, জলবায়ু পরিবর্তনে পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা হবে। এছাড়া দারিদ্র্য বিমোচনে প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে মোকাবিলা করা, বিনিয়োগ ও সংকটের মুখে স্বল্প-আয়ের দেশগুলোকে অর্থায়ন নিয়েও আলোচনা হবে। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতিকে এক নম্বর অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে সেখানে। এজন্য দেশে দেশে নীতির সংস্কার, মানবিক উন্নয়নে বেশি মাত্রায় বিনিয়োগ ও শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি অর্জনের কৌশল নির্ধারণ করা হবে আইএমএফ বলেছে, বর্তমান প্রবৃদ্ধির গতিশীলতার মধ্যে তীব্র পার্থক্য রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে গতি ফিরছে। ভারতসহ উদীয়মান অন্য দেশগুলোর অর্থনীতিও চাঙা হচ্ছে। কিন্তু বেশির ভাগ উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর গতি এখনো কম। চীনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রত্যাশার চেয়েও গতি কম। অনেক দেশ এ নিয়ে লড়াই করছে। তবে বিশ্বব্যাপী তারল্য এবং রিজার্ভ সংকট মোকাবিলায় আইএমএফ এক লাখ কোটি ডলালের ঋণ দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। এর মধ্যে ৯৬টি দেশে ৩২ হাজার কোটি ডলারের ঋণ দেওয়া হয়েছে; যার মধ্যে ৫৬টি হচ্ছে নিম্ন-আয়ের দেশে। এসব দেশে সুদমুক্ত অর্থায়ন পাঁচগুণ বাড়ানো হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর বার্ষিক সভায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারসহ একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল ওই বৈঠকে অংশ নিচ্ছে। এবার বৈঠকে আফ্রিকার সমৃদ্ধ অর্থনীতিকে বেশি প্রধান্য দেওয়া হচ্ছে। বৈঠকের আগে আইএমএফ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বলেছেন, ২১ শতকের একটি সমৃদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতির জন্য সমৃদ্ধ আফ্রিকার প্রয়োজন। কারণ, উন্নত দেশগুলোয় প্রচুর পুঁজি রয়েছে। সেগুলোকে এখন ব্যবহার করে বর্তমান অ্যানিমিক বৈশ্বিক বৃদ্ধিকে আরও গতিশীল করতে হবে। ডেল্টা প্ল্যান : ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসাবে প্রণয়ন করা হয়েছে ডেল্টা প্ল্যান-২১০০। শতবর্ষের এ মহাপরিকল্পনার প্রথম ধাপ ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে। এ সময়ে ৮০টি প্রকল্পের আওতায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে বিনিয়োগের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ২ লাখ ৯৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। কাজ চলছে ডেল্টা ‘নলেজ ব্যাংক’ ও ‘ডিজিটাল তথ্যভান্ডার’ স্থাপনের। আর সার্বিক কর্মকাণ্ডের আর্থিক বিষয়টি নিশ্চিত করতে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ডেল্টা তহবিল গঠনের। ইউরোপের দেশ নেদারল্যান্ডসের আদলে গ্রহণ করা শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যান তথা ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনাক-২১০০’-কে দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসাবে দেখছে সরকার। বন্যা, নদীভাঙন, নদী ব্যবস্থাপনা, নগর ও গ্রামে পানি সরবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার মতো দীর্ঘমেয়াদি ৬টি কৌশল রয়েছে প্ল্যান-২১০০-এ। ডেল্টা প্ল্যানের প্রথম ধাপের ৮০টি প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ৬৫টি ভৌত অবকাঠামো এবং ১৫টি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, দক্ষতা ও গবেষণাসংক্রান্ত। এর মধ্যে বন্যা নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে ২ হাজার ৭৯৮ কোটি এবং নদী ব্যবস্থাপনায় ব্যয় করা হবে ৪৮ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। এছাড়া নগর ও গ্রামে পানি সরবরাহে ৬৭ হাজার ১৫২ কোটি, নদীভাঙন রোধে ৬৮ হাজার ৮৭৯ কোটি, চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলের জন্য ৫ হাজার ৯৮৬ কোটি এবং খরাপ্রবণ অঞ্চলের জন্য প্রকল্পে বরাদ্দ হচ্ছে ১৬ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা। অন্যান্য প্রকল্পে বিনিয়োগ করার লক্ষ্য রয়েছে অবশিষ্ট ৮৮ হাজার ৪১০ কোটি টাকা। সূত্রমতে, মোটা অঙ্কের এ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ ও সহায়তার জন্য বিশ্বব্যাংক, নেদারল্যান্ডস এডিবি, জাইকাসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিনিয়োগের ধরন : ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নে ৮০টি প্রকল্প ব্যয়ের অর্থের জোগান নিশ্চিত করতে প্রথম ধাপে ২০৩১ সালের জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশের সমান বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে। এর আওতায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে সরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ১ দশমিক ৫ শতাংশ, বেসরকারি বিনিয়োগ শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ এবং রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ স্থির করা হয়েছে। ২০৩১ সালেও উল্লিখিত হারে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।