সরকার নির্ধারিত দামে বাজারে ইউরিয়া সার পাচ্ছে না কৃষক। বরং প্রতিকেজি সার গড়ে ৩ টাকা বেশি দিয়ে ক্রয় করতে হচ্ছে। ডিলারদের কারসাজির কারণে কৃষককে বাড়তি এ অর্থ দিতে হচ্ছে সারের পেছনে। এতে করে কৃষি উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে ভোক্তার ওপর। গত ৩ এপ্রিল সব ধরনের সারের দাম ৫ টাকা করে বাড়ায় সরকার। ফলে বাড়তি দর ৫ টাকার সঙ্গে আরও প্রায় ৩ টাকা যোগ করে ৮ টাকা বেশি দামে সার কিনতে হচ্ছে কৃষকদের। এর মধ্য দিয়ে ডিলাররা কৃষকদের পকেট থেকে বেআইনিভাবে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার রাস্তা তৈরি করেছে। তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের তরফ থেকে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এতে কৃষকদের উৎপাদন ব্যয় অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এবার বেশি হবে। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, বর্তমানে সারের মজুত কম। কিন্তু চাহিদা অনেক। কারণ দেশে এখন কৃষকের আমনখেতে শেষবারের মতো সার দিতে হচ্ছে। গ্যাসের অভাবে দেশের তিনটি সার কারখানা বন্ধ এবং আমদানির ক্ষেত্রে ডলার সংকট প্রকট-সুযোগটিই কাজে লাগাচ্ছে ডিলাররা। আমাগী জানুয়ারি থেকে শুরু হচ্ছে বোরো ধান আবাদের মৌসুম। এছাড়া চলতি মাসের শেষদিকে শুরু হচ্ছে শীতকালীন সব ধরনের সবজি ও পেঁয়াজের আবাদ। নির্ধারিত দরের চেয়ে বাড়তি দাম গুনতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন কৃষকরা। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, অতীতের ধারাবাহিকতায় সংকট হলেই কৃষক পর্যায়ে দাম বেড়ে যায়। মূল্য বৃদ্ধির করে মাঠ পর্যায়ে ডিলাররা। তারা সংকটকে পুঁজি করে কৃষকদের পকেট থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়। সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, সারের সংকট আছে। তবে সরকার তা স্বীকার করতে চায় না। যদিও সরকার বলছে সারের মজুত পর্যাপ্ত। কিন্তু কত মজুত আছে তা খোলাসা করা হয় না। এটা কৃষি মন্ত্রণালয় ছাড়া কারও জানারও সুযোগ নেই। বাড়তি দামে কৃষক সার ক্রয় করছে জানিয়ে তিনি বলেন, চাহিদার তুলনায় সারের সরবরাহ কম। সে কারণে ডিলাররা সংকট দেখিয়ে কৃষকের কাছ থেকে বাড়তি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। তাছাড়া সরবরাহ চেইনে সমস্যা আছে। সরকারকে সরবরাহ চেইনের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। সাবেক এই কৃষি সচিব মনে করেন, সামনে জাতীয় নির্বাচন, ডিলাররা মনে করছেন কর্মকর্তারা নানা কাজ নিয়ে ব্যস্ত। এই সুযোগে তারা সারের বাজার নিয়ে কারসাজি করার পাঁয়তারা করছে। আমি সরকারকে পরামর্শ দেব, সারের ঋণপত্র বা (এলসি) যেন দ্রুত খোলার ব্যবস্থা করে। সারের সমস্যা হলে উৎপাদন ব্যাহত হবে। উৎপাদন ব্যাহত হলে দেশে খাদ্যের জন্য হাহাকার লেগে যাবে। বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প করপোরেশনের (বিসিআইসি) সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকার সারকে একটি সংবেদনশীল পণ্য হিসাবে গণ্য করে সব সময় যথেষ্ট মজুত নিশ্চিত করে। তবে বর্তমান সংকট চলছে প্রায় বছরখানেক ধরে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে যাওয়ায় সার আমদানিতে সমস্যা হচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ সাজ্জাদ অবশ্য বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, টিএসপি, ডিএপি এবং এমওপি সারটা আমরা দেখি। এই তিন প্রকারের সারের কোনো সংকট এই মুহূর্তে নেই। সারের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই তিন প্রকারের সারের কোনো সংকট হবে না। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি করপোরেশনের (বিসিআইসি) চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমানও বলেন, দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ সার মজুত আছে। কোনো ধরনের কমতি নেই। বাড়তি দামে সার কেনার বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। সার কারখানা বন্ধ তাহলে কীভাবে ঘাটতি পূরণ করা হলো-এমন প্রশ্নের জবাবে সাইদুর রহমান বলেন, আমদানি করেছি। বিসিআইসির চেয়ারম্যান জানান, দেশে বর্তমানে ৬ লাখ টন ইউরিয়া সার মজুত আছে। চলতি মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু হচ্ছে শীতকালীন সবজি এবং পেঁয়াজের আবাদ। জানুয়ারি মাসে শুরু হচ্ছে বোরো আবাদের মৌসুম। সেক্ষেত্রে আগামী মার্চ পর্যন্ত প্রায় ১৬ লাখ টন সার দরকার। এর জন্য কী ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার-এমন প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, সব প্রস্তুতি রয়েছে। সারের কোনো সমস্যা হবে না এটা নিশ্চিত। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ) ড. শাহ মো. হেলাল উদ্দীন বলেন, ইউরিয়া সারের দাম বেশি রাখা হচ্ছে এমন সংবাদ কখনোই পাইনি। তিনি বলেন, লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা ব্যবস্থা নেব। সারের দাম কেজিতে ৩ টাকা বাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে বিষয়টি কি কৃষি মন্ত্রণালয়ের নজরদারিতে নেই-এমন প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত সচিব বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রতিনিধি রয়েছে। তারা তো বলছে না কৃষককে সার বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। অতিরিক্ত সচিবের কক্ষেই বসা ছিলেন সার ব্যবস্থপানা অনুবিভাগের আরেক কর্মকর্তা। তিনি জানান, অধিকাংশ কৃষক বাকিতে সার কেনেন। যে কারণে ডিলাররা সারের দাম বেশি রাখেন। তবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, মাঠ পর্যায়ের ব্লক সুপারভাইজারদের অনেকেই ডিলারের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে তথ্য গোপন করেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সারের চাহিদা ধরা হয়েছে ৬৮ লাখ টনের কিছু বেশি। এর মধ্যে প্রায় ৪০ লাখ টন সার আমদানি করতে হবে। বাকি সার দেশের কারখানায় উৎপাদিত হওয়ার কথা। কিন্তু আমদানির বড় সমস্যা হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। রিজার্ভের যে পরিস্থিতি, তাতে আমদানি দাবি মেটানোও কষ্টসাধ্য। এসব বিষয় সামনে রেখে দেশের আপামর কৃষকদের স্বার্থে সরকার নতুন করে সার নিয়ে ভাববে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।