গত শনিবার সকালে হামাস পাঁচ হাজার রকেট নিক্ষেপের সঙ্গে বুলডোজার, গ্লাইডার এবং মোটরবাইক নিয়ে ইসরাইলে ঢুকে পড়ে। এটি নিঃসন্দেহে ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর ইসরাইলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় আঘাত। ৫০ বছর আগে সিরিয়া ও মিসর ইসরায়েলে আকস্মিক হামলা চালিয়ে পুরো প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছিল। সেই স্মৃতিই যেন ফিরিয়ে আনল হামাস। হামাসের একটি সূত্র বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছে, হামাসের ঘনিষ্ঠ সূত্রটি বলেছে, হামাস কয়েক মাস ধরে ইসরাইলকে বিভ্রান্ত করার জন্য একটি অভূতপূর্ব গোয়েন্দা কৌশল ব্যবহার করেছে। হামাস ইসরাইলকে ধারণা দিয়েছিল, তারা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত নয়। কিন্তু তারা ব্যাপক অভিযানের প্রস্তুতি ঠিকই নিয়েছে। এমনকি এই দুই বছর ইসরায়েলের পক্ষ থেকে সামরিক নিপীড়ন ঠিকই চলেছে। এরপরও হামাসের পক্ষ থেকে কাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়া আসেনি। ইসরাইল স্বীকার করেছে যে ইহুদিদের পবিত্র দিন সাবাথ ও ধর্মীয় ছুটির মধ্যে এমন হামলা সত্যিই তাদের অবাক করেছে। হামাস যোদ্ধারা ইসরাইলের শহরগুলোতে ঝাঁপিয়ে পড়ে অন্তত ৭০০ ইসরাইলিকে হত্যা করেছে। বহু ইসরাইলি ও বিদেশিকে জিম্মি করেছে। এরপর প্রতিশোধ নিতে ইসরাইল গাজায় ব্যাপক বোমা বর্ষণ শুরু করেছে। এ পর্যন্ত ৪০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর মুখপাত্র মেজর নির দিনার বলেছেন, ‘এটি আমাদের ৯/১১। তারা আমাদের গুঁড়িয়ে দিয়েছে। জল, স্থল ও আকাশপথে আক্রমণ চালিয়ে তারা আমাদের হতবাক করেছে।’ লেবাননে হামাসের প্রতিনিধি ওসামা হামদান রয়টার্সকে বলেছেন, ‘এই হামলায় ফিলিস্তিনিরা দেখিয়ে দিয়েছে লক্ষ্য অর্জনে তারা কিছুতেই পিছপা হবে না। ইসরাইলের যত বড়ই সামরিক শক্তি ও সক্ষমতা থাকুক না কেন।’ হামলার কিছুদিন আগে হামাস গাজায় একটি অবৈধ ইসরাইলি বসতির অনুকরণে একটি এলাকা তৈরি করেছিল। এরপর সেটি ধ্বংসের মহড়া দেওয়া হয়। সেটিরও ভিডিও তৈরি করে তারা। ইসরাইল তাদের কার্যক্রম দেখেছে ঠিকই কিন্তু গুরুত্ব দেয়নি। তারা ভেবেছিল, হামাস কোনো সংঘর্ষে জড়াতে আগ্রহী নয়। একই সময়ে হামাস ইসরাইলকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে তারা গাজার বেকার মানুষদের কর্মসংস্থান চায়। সীমান্তের ওপারে কীভাবে কাজ জোটাবে সে নিয়েই ব্যস্ত হামাস। হামাসের সঙ্গে ২০২১ সালের যুদ্ধের পর থেকে হাজার হাজার গাজাবাসীকে ইসরাইলে ও পশ্চিম তীরে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে তেল আবিব। যেখানে নির্মাণ, কৃষি বা সেবা খাতের চাকরিগুলোতে গাজার চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। ইসরাইলি সেনাবাহিনীর আরেক মুখপাত্র বলেছেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম তারা উপার্জনের টাকায় গাজায় শান্তিপূর্ণভাবে বাস করবে। কিন্তু আমরা ভুল ছিলাম।’ ইসরাইলের নিরাপত্তা বিভাগের সূত্র স্বীকার করেছে, ‘ইসরাইলের গোয়েন্দা বিভাগ হামাসের দ্বারা প্রতারিত হয়েছে। আমাদের তারা বুঝিয়েছিল, তারা শুধু টাকা চায়। কিন্তু সর্বদা তারা সেই টাকা ব্যবহার করে হামলার প্রস্তুতি নিয়েছে।’ গত দুই বছরে হামাস নিষ্ক্রিয় থাকলেও গাজাভিত্তিক আরেকটি ইসলামপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী ইসলামিক জিহাদের উত্থান ঘটে। তারা বেশ কয়েকটি আক্রমণ ও সিরিজ রকেট হামলাও চালায়। হামাসের এই দীর্ঘ সংযম অনেকের সন্দেহের জন্ম দিয়েছে, সেই সঙ্গে অনাস্থা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। খোদ প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগাইনাইজেশনের (পিএলও) নেতারাও হামাসের সমালোচনা করেছে। যুদ্ধ ছেড়ে হামাস অর্থনৈতিক বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছে—এমনটিও বলা হয়েছে। হামাসের সূত্রটি জানায়, ইসরাইল দীর্ঘদিন ধরে ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর অনুপ্রবেশ ও তাদের কার্যকলাপ নিরীক্ষণের সক্ষমতা নিয়ে দম্ভ করেছে। এই আত্মবিশ্বাসই ইসরাইলের কাল হয়েছে। শুরু থেকেই হামাস পরিকল্পনার তথ্য ফাঁস এড়াতে সতর্ক ছিল। অনেক হামাস নেতাও পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতেন না। হামলায় অংশ নেওয়া ১ হাজার যোদ্ধাও টের পায়নি কেন তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল। হামলার দিন শনিবার হামাস মুক্তিসেনাদের চার ভাগে বিভক্ত করা হয়। সেদিনই তাদের মিশনের কথা বিস্তারিত জানানো হয়। প্রথম পদক্ষেপটি ছিল গাজা থেকে ছোড়া তিন হাজার রকেটের সঙ্গে গ্লাইডার বা মোটরচালিত প্যারাগ্লাইডার দিয়ে হামাস যোদ্ধাদের ইসরাইলের মাটিতে অবতরণ। হ্যাং গ্লাইডারের যোদ্ধারা মাটিতে নামার পর বেশ কয়েকটি এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফেলেন। যোদ্ধারা বোমা বর্ষণ করে সব বাধা গুঁড়িয়ে দেন এবং মোটরবাইকে করে সীমানা অতিক্রম করেন। বুলডোজার দিয়ে প্রবেশপথগুলো আরও প্রসারিত করেন। হামাসের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, হামাসের একটি কমান্ডো ইউনিট ইসরাইলি সেনাবাহিনীর দক্ষিণ গাজা সদর দপ্তরে আক্রমণ করে এবং এর যোগাযোগব্যবস্থা বিকল করে দেয়। এরপর জিম্মিদের গাজায় স্থানান্তর করা হয়। এসবের বেশির ভাগই আক্রমণের প্রথম দিকে করা হয়েছিল।