আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সব সূচকে বড় ধাক্কা

প্রকাশিতঃ অক্টোবর ১০, ২০২৩ | ৮:৫০ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

দেশের নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় নজিরবিহীন লুটপাটের প্রভাব বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। সার্বিকভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় সব ধরনের সূচকে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। এগুলো নিম্নমুখী হওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা এখন প্রকট হয়ে উঠেছে। বিনিয়োগের বিপরীতে আয় কমেছে, বেড়েছে ব্যয়। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসানে পড়েছে। এর মধ্যে বড় ধরনের লোকসান হয়েছে গত বছর। আর খেলাপি ঋণ ও প্রভিশন ঘাটতি বাড়ায় মূলধন কমেছে। পাশাপাশি আস্থাহীনতায় সার্বিকভাবে কমে গেছে আমানত। এক্ষেত্রে ছোট গ্রাহকদের আমানত তুলে নেওয়ার প্রবণতা বেশি। তবে বড় ও প্রাতিষ্ঠানিক গ্রাহকদের আমানত বেড়েছে। নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক পরিস্থিতির ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, দেশে ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ৬টির অবস্থা খুবই খারাপ। এগুলোর খেলাপি ঋণ ৯০ শতাংশের কাছাকাছি। এর মধ্যে চারটি প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের আমানতের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। ফলে আমানতকারীদের আস্থায় চিড় ধরেছে। এতে ছোট আমানতকারীরা টাকা তুলে নিচ্ছে। এক বছরে প্রায় ১ লাখ ১১ হাজার ছোট আমানতকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছেড়েছেন। তবে কোটিপতি আমানতকারী বেড়েছে ৪৬২ জন। তাদের কারণে আমানতের পালে কিছুটা হাওয়া লেগেছে। তবে বড় আমানতে ঝুঁকি বেশি। কারণ, একসঙ্গে একাধিক আমানতকারী অর্থ তুলে নিলে আমনত কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বেশ ভালো চলছে। বাজারে তাদের সুনামও রয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগের অবস্থাই খারাপ। ৬টি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা লুট করা হয়েছে। এর মধ্যে পরিচালকরাই নিয়েছেন সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। লুটপাটের কারণে ওইসব অর্থ ফিরে আসছে না। ফলে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, নন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়ের বড় অংশই আসে ঋণ বা লিজের মাধ্যমে বিনিয়োগের বিপরীতে সুদ থেকে। লুটপাটের কারণে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় সার্বিকভাবে ঋণ বা লিজের সুদ থেকে নিট আয় কমছে। ২০১৮ সালে সুদ থেকে আয় হয়েছিল ২ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। ২০২০ সালে তা আরও কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ৫২২ কোটি টাকা। ২০২১ সালে সুদ থেকে আয় সামান্য বেড়ে ১ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা হয়। কিন্তু ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৭ কোটি টাকায়। তবে গত জুন পর্যন্ত এ খাতে আয় আনুপাতিক হারে কিছুটা বেড়ে ৫২৭ কোটি টাকা হয়েছে। এদিকে আয় কমলেও প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালন ব্যয় বেড়েছে। ২০২১ সালে ব্যয় হয়েছিল ১ হাজার ৫০ কোটি টাকা। ২০২২ সালে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে আয় কমেছে, বেড়েছে ব্যয়। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা কমে গেছে। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান লোকসানের খাতায় চলে গেছে। এতে গড় হিসাবে প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসানে পড়েছে। ২০১৮ সালে নিট মুনাফা হয়েছিল ৮৩০ কোটি টাকা। এরপর থেকে প্রতিবছর লোকসান হচ্ছে। ২০১৯ সালে লোকসান হয়েছিল ২ হাজার ২২০ কোটি টাকা। ২০২০ সালে লোকসান কিছুটা কমে ১৭২ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ২০২১ সালে লোকসান আবার কিছুটা বেড়ে ২০০ কোটি টাকা হয়। ২০২২ সালে তা আরও বেড়ে ১ হাজার ১৭১ কোটি টাকা লোকসান হয়। তবে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত লোকসান কিছুটা কমেছে। তবে পুঞ্জীভূত লোকসান রয়েই গেছে। প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, সম্পদ বা ঋণ থেকে সর্বশেষ আয় হয়েছিল ২০১৯ সালে ১ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপর থেকে এ খাতে আয় নেতিবাচক বা লোকসান হচ্ছে। ২০২০ সালে লোকসান হয়েছিল দশমিক ১৯ শতাংশ, ২০২০ সালে হয় দশমিক ২৩ শতাংশ। ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ দশমিক ২৭ শতাংশ। একইভাবে মূলধন থেকেও আয় ২০১৯ সালে হয়েছিল ১০ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০২০ সালে লোকসান হয় ১ দশমিক ৯৯ শতাংশ, ২০২১ সালে ২ দশমিক ৭৯ শতাংশ, ২০২২ সালে ১৯ দশমিক ২৬ শতাংশ। লুটপাটের কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যেসব অর্থ বেরিয়ে গেছে, সেগুলো আর ফেরত আসছে না। এতে ওইসব ঋণ বা লিজ একটি পর্যায়ে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণ। শুধু লুটপাটের কারণেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। যে কারণে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে খেলাপি ঋণ এক লাফে প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যায়। ২০১৮ সালে এসব প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণ ছিল ৫ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে তা আরও বেড়ে হয় ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ২০২০ সালে তা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ১০ হাজার ৫০ কোটি টাকায়। ২০২১ সালে তা আরও বেড়ে ১৩ হাজার ২০ কোটি, ২০২২ সালে আরও বেড়ে ১৬ হাজার ৮২১ কোটি টাকা হয়। এখন তা আরও বেড়ে ১৭ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা হয়েছে, যা মোট ঋণের ২৫ শতাংশ। খেলাপি ঋণ বাড়ায় এবং মুনাফা কমে যাওয়ায় প্রভিশন খাতে চাহিদা অনুযায়ী অর্থ জমা রাখতে পারছে না আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে প্রভিশন ঘাটতিও বেড়ে যাচ্ছে। ২০২১ সালে এ ঘাটতি ছিল ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ২০২২ সালে তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ৫৩ কোটি টাকায়। এখন তা বেড়ে ১ হাজার ২১০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। খেলাপি ঋণ ও প্রভিশন ঘাটতি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলোর মূলধন কমে যাচ্ছে। এদিকে মুনাফা কমায় মূলধন বাড়ানো যাচ্ছে না। ২০১৯ সালে মূলধন ছিল ১২ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। ২০২০ সালে তা কমে ১০ হাজার ৪০ কোটি টাকা হয়। ২০২১ সালে তা আরও কমে ৯ হাজার ২০৬ কোটি টাকা হয়। ২০২২ সালে তা আরও কমে ৮ হাজার ৯২৬ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। এখন তা আরও কমেছে। খেলাপি ঋণ ও প্রভিশন ঘাটতি বৃদ্ধি এবং মূলধন কমায় প্রতিষ্ঠানগুলো ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদর বিপরীতে যথাযথ মূলধন রাখতে পারছে না। ফলে তাদের মূলধন পর্যাপ্ততা কমে গেছে। ২০২৯ সালে মূলধন পর্যাপ্ততা ছিল ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ, ২০২০ সালে তা আরও কমে ১৪ দশমিক ১৭ শতাংশে নামে। ২০২১ সালে আরও কমে ১২ দশমিক ৯০ শতাংশ এবং ২০২২ সালে আরও কমে ৮ দশমিক ১০ শতাংশে নামে। এখন তা আরও কমে ৮ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, আর্থিক প্রতিষ্ঠাগুলোর আমানত কমার প্রবণতা কয়েক বছর ধরেই চলছিল। তবে গত ছয় মাসে আমানত কিছুটা বেড়েছে। ২০১৮ সালে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় আমানত কমে দাঁড়ায় ৪৬ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা এবং ২০১৯ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৪৪ হাজার ৯৭০ কোটি টাকায়। ২০২০ সালে কিছুটা বেড়ে ৪৫ হাজার ৩২১ কোটি টাকা হয়। কিন্তু ২০২১ সালেই তা আবার কমে ৪৪ হাজার ৪২০ কোটি টাকায় নেমে যায়। ২০২২ সালে তা আরও কিছুটা কমে ৪৪ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকায় হয়। ২০২৩ সালের জুনে তা কিছুটা বেড়ে ৪৪ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা হয়। তবে ২০১৮ সালের সমান উচ্চতায় আমানত এখন যেতে পারেনি।