অর্থবহ সংলাপের ওপর গুরুত্ব দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলের পাঁচ দফা সুপারিশ রাজনৈতিক অঙ্গনের নতুন রসদ। এই পটভূমিতে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এ সুপারিশকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। আওয়ামী লীগ বলছে, বিএনপি শর্ত বাদ দিতে রাজি হলে সংলাপে বসার বিষয়টি তারা চিন্তাভাবনা করতে পারে। অন্যদিকে বিএনপি বলছে, গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য পাঁচ দফা সুপারিশ বাস্তবায়ন অপরিহার্য। তবে শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতায় রেখে এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন অসম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট পার্টির থিঙ্কট্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত আইআরআই ও এনডিআইর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত মার্কিন নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল গত ৮ থেকে ১২ অক্টোবর ঢাকায় নির্বাচন-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে ঢাকা সফর করে যাওয়া এ দলটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই মার্কিন প্রশাসনের বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোসহ নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা। দেশে ফিরে মার্কিন প্রতিনিধি দলটি পাঁচ দফা সুপারিশ করলেও কখন তা বাস্তবায়ন করতে হবে এবং না করলে কী হবে, সে বিষয়ে ওই বিজ্ঞপ্তিতে কিছু বলা হয়নি। এমনকি তারা আগামী নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাবে কিনা তা-ও ওই বিজ্ঞপ্তিতে পরিষ্কার করা হয়নি। এর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছিল। দেশের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা অনেক আগে থেকেই সংকট নিরসনে সংলাপের ওপরে জোর দিয়ে আসছেন। সম্প্রতি রাজধানীতে ‘দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট’ ও ‘সুজন’ আয়োজিত এক সেমিনারে অংশ নিয়ে বক্তারা বর্তমান সংকট নিরসনে আবারও সংলাপের তাগিদ দিয়েছেন। তবে নির্বাচন-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা’ নিয়ে গত তিন দশকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে একাধিক সংলাপ হলেও কোনো স্থায়ী সমাধান হয়নি। জাতিসংঘ দূতের মধ্যস্থতায় দু’পক্ষের শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠক হয়। এমনকি মধ্যস্থতা ছাড়াই সরাসরি দু’দলের সাধারণ সম্পাদক ও মহাসচিব পর্যায়ে (আবদুল জলিল ও আবদুল মান্নান ভূঁইয়া) সংলাপ হয়। তবে তাতেও কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি। এবারও সফল হবে এমন কোনো সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করছেন তারা। তবে অতীতের এ বাস্তবতা মেনে নিয়েও সংলাপের বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ। তাঁর মতে, এ পাঁচ দফা সুপারিশের মধ্যে দু’পক্ষের জন্যই মুখ রক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। দেশে একটি সুষ্ঠু এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির পথ সুগম করবে এই পাঁচ দফা। এটা করতে হবে দ্রুতই। সময় হাতে বেশি নেই। তিনি বলেন, সুপারিশে নির্বাচন নিয়ে সংলাপ-সমঝোতা এবং নির্বাচন কমিশনকে সত্যিকার অর্থে স্বাধীনভাবে কাজ করার বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অতীতে সমঝোতার উদাহরণ তুলে ধরে নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, প্রকাশ্য সংলাপ সফল হয়নি, এটা ঠিক। তবে অপ্রকাশ্য সমঝোতার নজির এ দেশে আছে। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনের আগে দুই মার্কিন সিনেটরের মধ্যস্থতায় তিন দফা চুক্তি হয়। যার আওতায় ওই বছরের ৩০ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেছিলেন। পরে সপ্তম সংসদ নির্বাচন হয়। ওই তিন দফা চুক্তির মধ্যে ছিল– প্রথমত, ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত; দ্বিতীয়ত, ওই সময়ে কারাগারে থাকা জাতীয় পার্টির প্রধান এইচ এম এরশাদের মুক্তি নিশ্চিত এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার স্বীকৃতি নিশ্চিত করা। গতকাল রোববার মার্কিন প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলের সুপারিশ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পরপরই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সরকারের একাধিক মন্ত্রী এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানান। তবে নির্বাচন কমিশন সংলাপের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। গতকাল নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর সাংবাদিকদের সঙ্গে নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার প্রস্তুতি নিয়ে কমিশনের অবস্থান তুলে ধরেন। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের আমন্ত্রণ প্রসঙ্গে মো. আলমগীর বলেন, বিদেশি পর্যবেক্ষক আসার জন্য যে প্রচেষ্টা, তা ইসি শুরু করেছে। মার্কিন পর্যবেক্ষক দলের সংলাপ প্রসঙ্গে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সমঝোতা গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। আগের সংলাপ সফল হয়নি বলে ভবিষ্যতেও সংলাপ সফল হবে না, এটি কোনো যুক্তি হতে পারে না। তবে এ জন্য উভয় পক্ষের সদিচ্ছার প্রয়োজন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মুখোমুখি অবস্থান উন্নয়ন, স্থিতিশীলতা এবং সাধারণ মানুষের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। এবারের সংকট আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হবে– এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, রাজনীতি নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা খুব কঠিন। কারণ এখানে শেষ কথা বলে কিছু নেই। মার্কিন পর্যবেক্ষক দলের অন্য সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে– বাকস্বাধীনতার সুরক্ষা ও ভিন্নমতকে সম্মানের পরিবেশ তৈরি করা, স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনাসহ এমন পরিবেশ তৈরি করা, যাতে সব দল একটি অর্থবহ নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় শামিল হতে পারে এবং নাগরিকদের মধ্যে সক্রিয় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনে অংশগ্রহণের সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করা। এ ব্যাপারে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সুপারিশের মধ্যে যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে তা হলো, এ পরিস্থিতি দেশে কীভাবে সৃষ্টি হলো সেটা চিহ্নিত করতে হবে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা, আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন, প্রশাসন ও বিচার বিভাগে দলীয়করণের ফলেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনসহ সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে। এর জন্য সংলাপের বিকল্প নেই। এদিকে পাঁচ দফা সুপারিশ প্রকাশের পরপরই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপি উভয়েই স্বাগত জানিয়েছে। আওয়ামী লীগ বলেছে, মার্কিন দলের সুপারিশগুলো চমৎকার এবং যারা সহিংসতা করে নির্বাচন ঠেকাতে চায় তাদের জন্য এটি একটি কড়া বার্তা। তবে বিএনপি বলেছে, এ সুপারিশে বাস্তব অবস্থা উঠে এসেছে। এগুলোই তারা দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে। এসব বাস্তবায়নের জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বিদায় করে নির্দলীয় সরকার জরুরি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সংলাপ প্রশ্নে বলেন, বিএনপির সঙ্গে শর্তযুক্ত সংলাপের ব্যাপারে সরকারের কোনো চিন্তাভাবনা নেই। তারা শর্ত প্রত্যাহার করলে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রশ্নে সংলাপের বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা হবে। তিনি বলেন, ‘মার্কিন প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে অনেক আলোচনা হলেও সংলাপ বিষয়ে কোনো কথা হয়নি। তারা কোথা থেকে সংলাপের কথা আনল, বুঝতে পারছি না। তবে তাদের সুপারিশের অন্য বিষয়ে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। সেগুলো নিয়ে আমরা সবাই একমত। এই প্রস্তাবগুলো নিয়ে তারা বিএনপির সঙ্গে কথা বলুক।’ একই দিন আরেক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, সংলাপে বসতে আইনি কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। তবে কথা হলো, সংলাপ হতে হলে কিছু আইনি জিনিস, যেগুলো বাস্তবে আছে, সেগুলো মেনে সংলাপে আসতে হয়। সেগুলো না মানলে সংলাপ হয় না। মার্কিন পর্যবেক্ষক দলের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ বলেন, তাদের সঙ্গে বৈঠকে সংলাপের প্রসঙ্গ সেভাবে আসেনি। তিনি বলেন, মার্কিন প্রতিনিধি দলের সুপারিশের লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, তারা বলেছে– ‘ইন গুড ফেইথ’ (সরল বিশ্বাস) বিএনপির সঙ্গে সংলাপ হতে পারে। এখন বিএনপি কি সরল বিশ্বাসে আসবে? তারা যেসব দাবি করছে, সেগুলো অযৌক্তিক। এগুলো মানতে গেলে সংবিধান ও আইনের লঙ্ঘন করতে হয়। এ অবস্থায় বিএনপির সঙ্গে সংলাপের কোনো সুযোগও নেই। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ঘোষণা ছাড়া কোনো সংলাপ নয়। সেই সরকার কীভাবে গঠন হবে, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এ ছাড়া অন্য কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা বা সংলাপ হতে পারে না। এর আগেও তাদের সঙ্গে সংলাপ হয়েছে। তাদের আহ্বানে নির্বাচনে গিয়েছিলেন। তখন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা। তাঁর ওপর আস্থা রাখতে বলেছিলেন। তারা বলেছিল, স্বাধীনভাবে প্রচারণা করার সুযোগ দেবে, সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। সে নির্বাচনে গিয়েছিলাম। পাঁচ দিনও প্রচারণা করতে দেওয়া হয়নি। কোনো ওয়াদাই তারা রাখেনি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সংলাপ হবে মানুষের প্রত্যাশা আর আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে। মানুষ নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চায়। তারা তাদের ভোটাধিকার ফিরে পেতে চায়। তবে সরকার তাদের সেই চাওয়াকে গুরুত্ব না দিয়ে আবার একতরফা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ রকম একটি পরিবেশে আগে জনগণের চাওয়া ও অধিকারকে ফিরিয়ে দেওয়ার শর্ত পূরণ করে কী প্রক্রিয়ায় সমাধান আসবে, সেটা নিয়ে সংলাপ হতে পারে। নির্বাচন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি প্রয়োগের ঘোষণা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর নির্বাচন-পূর্ব পরিবেশ পর্যালোচনা করতে আসা মার্কিন এ দলটির প্রতিবেদনকে আগামী নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।