উড়োজাহাজ বিক্রি ও ফ্লিট প্ল্যান সাজাবে এয়ারবাস

প্রকাশিতঃ অক্টোবর ২০, ২০২৩ | ৮:৩৩ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

শুধু উড়োজাহাজ বিক্রি নয়, বাংলাদেশ বিমানের ফ্লিট (বহর) প্ল্যানও সাজিয়ে দিতে চায় ইউরোপের উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এয়ারবাস। এজন্য মেগা মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজ শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তারা জানিয়েছে, বাংলাদেশ বিমানের জন্য ১০টি ওয়াইডবডি উড়োজাহাজ (এয়ারবাস ৩৫০-৮০০) নির্মাণে সব ধরনের প্রস্তুতি আছে তাদের। কার্যাদেশ পেলে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের মধ্যে প্রথম যাত্রীবাহী অত্যাধুনিক এ ৩৫০ এয়ারক্রাফটটি সরবরাহ করতে পারবে। ইউরোপের চার জায়ান্ট-যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি ও স্পেনের যৌথ অংশীদারত্বে প্রতিষ্ঠিত বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এয়ারবাস মাসে এ ৩৫০ মডেলের একাধিক ওয়াইডবডি এয়ারক্রাফট নির্মাণ করছে। প্রতিটি উড়োজাহাজের ৪টি মূল অংশ এই চার দেশ তৈরি করে। এরপর সবগুলো অংশ এসেম্বলিং হয় ফ্রান্সের তুলুজে অবস্থিত কারখানায়। এর নাম এয়ারবাস ফাইনাল এসেম্বেলিং লাইন (এফএএল)। গত ৯ অক্টোবর সরেজমিন ওই ফ্যাক্টরি ভিজিট ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে উল্লিখিত সব তথ্য। এ সময় দেশের বিভিন্ন মিডিয়ার ১০ জন সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এয়ারবাস বাংলাদেশে এভিয়েশন ইকোসিস্টেম ডেভেলপ করার জন্য একটি মেগা মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে কাজ করছে। এর মধ্যে রয়েছে বিমান চলাচলকেন্দ্রিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করা, এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট এবং এয়ার ট্রাফিক পরিষেবার উন্নয়নে এয়ারপোর্ট অপারেশনে সহযোগিতা, বেসামরিক বিমান চালনার কর্মীদের দক্ষতা বাড়াতে উদ্যোগ গ্রহণ এবং পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও কার্বন নির্গমন হ্রাস করা। এছাড়া বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে কৌশলগত পরামর্শ ও বিপণন সেবা প্রদান করবে এয়ারবাস। ২০৩০ পর্যন্ত একটি ফ্লিট প্ল্যান তৈরি করবে। উড়োজাহাজের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা, রাজস্ব তৈরির জন্য রুট সম্প্রসারণ ও বিপণন পরিকল্পনা তৈরি করবে। এছাড়া বাংলাদেশে বাণিজ্যিক পাইলট ও মেকানিক্স তৈরির জন্য ইনস্টিটিউট স্থাপন করবে। এখান থেকে ১৮ মাসে এটিপিএল (এয়ারলাইন ট্রান্সপোর্ট পাইলট লাইসেন্স) নিয়ে দক্ষ ও পেশাদার পাইলট তৈরি হবে। গত ৫ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লন্ডন সফরের সময় এয়ারবাসের কাছ থেকে দুটি কার্গো এবং আটটি যাত্রীবাহী বিমানসহ ১০টি ওয়াইডবডি বিমান কেনার বিষয়ে এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়। সেখানে এয়ারবাস কোম্পানি বিমান অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য এই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রস্তাব করে। বাংলাদেশে কাজ করা এয়ারবাসের প্রধান প্রতিনিধি মোরাদ বোরোউফালা তুলুজে এ-৩৫০ এয়ারক্রাফটের ফ্যাক্টরি (ফাইনাল লাইন) পরিদর্শনকালে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি বাংলাদেশের উড়োজাহাজ চলাচলের বাজার পুরোপুরি ব্যবহার করা হয়নি। দেশে গত সাত বছরে বিমান যাত্রীর সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। প্রতিদিন যাত্রী সংখ্যা বাড়ছে। ২০৩৭ সালের মধ্যে দেশের ৮৫ ভাগ যাত্রী ব্যবহার করবে আকাশপথ। বিশ্বের আরও অনেক দেশের সঙ্গে নতুন নতুন রুট খোলার সম্ভাবনা রয়েছে। এ কারণে আরও অনেক নতুন বিমানের প্রয়োজন। মোরাদ বোরোউফালা আরও বলেন, বাংলাদেশের কাছে বিমান বিক্রি কেবল একটি লেনদেন নয়। আমরা কিছু বিক্রি করব আর দেশ ছেড়ে চলে যাব বিষয়টি এমন নয়। এটি একটি অংশীদারত্ব এবং আমরা সত্যিই চাই বাংলাদেশ একটি বিমান চলাচলের গন্তব্য হয়ে উঠুক। তিনি বলেন, বাংলাদেশ একটি উজ্জ্বল অর্থনীতির দেশ। এটি গত বছর বিশ্বব্যাপী ৩৪তম অর্থনীতি (বৃহত্তম) দেশ হিসাবে স্থান লাভ করেছে । আমরা এর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং জনসংখ্যার সঙ্গে প্রচুর সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। ২০৪১ সালের মধ্যে একটি স্মার্ট বাংলাদেশের রূপকল্প নিয়ে বাংলাদেশ সরকার এভিয়েশন সেক্টরকে সম্প্রসারিত করার টার্গেট নিয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সম্প্রতি নির্মিত হয়েছে অত্যাধুনিক আন্তর্জাতিক টার্মিনাল। এয়ারবাসের ওয়াইডবডি মার্কেট ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার জোহান ক্যামিলো রদ্রিগেজ বলেন, বাংলাদেশি বিমান চলাচলের ভবিষ্যৎ তুলুজ থেকে শুরু হবে। আমরা একটি নিরাপদ এবং ঐক্যবদ্ধ বিশ্বের জন্য টেকসই মহাকাশের অংশীদার হতে চাই। তিনি বলেন, আগামী ২০ বছরে বিশ্বব্যাপী ৪০ হাজারের বেশি নতুন যাত্রীবাহী ও মালবাহী বিমানের চাহিদা আছে। ২০৪২ সালের মধ্যে চীন বাদে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে ৯,৫০০টি নতুন উড়োজাহাজের চাহিদা তৈরি হবে। এর মধ্যে ২০০০ ওয়াইড বডির এয়ারক্রাফট থাকবে। আগামী ১০ বছরে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বিমান ব্যবহারকারীর সংখ্যা ভারতের পরেই থাকবে বাংলাদেশ। রদ্রিগেজ বলেন, বিমান ব্যবহারের পাশাপাশি সব ধরনের পরিষেবাও বাড়বে। বিশ্বব্যাপী ১ লাখ ৩১ হাজার নতুন পাইলট, ১ লাখ ৪৪ হাজার নতুন টেকনিশিয়ান এবং ২ লাখ ৮ হাজার নতুন কেবিন ক্রু প্রয়োজন হবে। এয়ারবাস এই চাহিদা পূরণে দক্ষ কর্মসংস্থানের উন্নয়নে সাহায্য করবে। তিনি আরও বলেন, এই সময়ে বাংলাদেশের যাত্রী পরিবহণও দ্বিগুণ হবে। তাই বাংলাদেশকে এই বাজার ধরতে আরও বিমান ক্রয় করতে হবে। এয়ারবাস এ-৩৫০ মডেলের প্রথম ফ্লাইটটি হয়েছিল ২০১৩ সালের ১৪ জুন। গত ১০ বছরে, এই মডেলের ৫৫২টি বিমান সরবরাহ করেছে এয়ারবাস। এগুলো ১,০৭১টি রুটে উড়ছে। ইউরোপ আমেরিকার পাশাপাশি কাতার এবং সিঙ্গাপুরভিত্তিক বড় বড় এয়ারলাইনগুলোতে এয়ারবাসের প্রাধান্য রয়েছে। ভারতের বেশ কয়েকটি এয়ারলাইনেও রয়েছে এ-৩৫০ মডেলের বিমান। দেশটির বেসরকারি বিমান সংস্থা ইন্ডিগো গত জুন মাসে ৫০০টি এ-৩২০ মডেলের পারিবারিক বিমানের জন্য কার্যাদেশ দিয়েছে। বাণিজ্যিক বিমান চলাচলের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বড় একক ক্রয় চুক্তি। বর্তমানে বিমানের বহরে কোন এয়ারবাস নেই। পুরো বহরটি সাজানো রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কোম্পানির ওয়াইডবডির উড়োজাহাজ দিয়ে। এয়ারবাসের উড়োজাহাজ ক্রয় করা হলে বিমানে মিশ্র বহর তৈরি হবে। এতে খরচ বাড়বে, নতুন করে আরও ক্রু নিয়োগ দিতে হবে। এ রকম এক প্রশ্নের জবাবে এয়ারবাসের একক-আইল বিপণনের প্রধান আন্তোনিও দা কস্তা বলেন, আগের প্রজন্মের তুলনায় ২৫ শতাংশ কম জ্বালানি লাগছে এ-৩৫০ এয়ারবাসে। বিমানটি আগেরটির তুলনায় পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ সহজ। ওজনও কম। যাত্রী ও কার্গো কেবিনের আকার আগের চেয়ে বড়। অন্যান্য এয়ারক্রাফটের তুলনায় ১৭ শতাংশ চওড়া। তাই বিদেশি এয়ারলাইন্সের সঙ্গে প্রতিযোগিতার জন্য বিমানকে এয়ারবাস বড় সহায়তা করবে। তার মতে, বাংলাদেশ বিমান চলাচল কেন্দ্র হওয়ার জন্য এশিয়াতেও খুব ভালো অবস্থানে আছে। বাংলাদেশ একটি এভিয়েশন হাব হতে পারে। অর্থাৎ দেশটি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণের জন্য একটি প্রবেশদ্বার হিসাবে কাজ করবে। তিনি আরও বলেন, এয়ারবাসের একজন পাইলট তাদের সবগুলো মডেলের উড়োজাহাজ পরিচালনা করতে পারে। বাংলাদেশ এখন এ-৩৫০ কিনছে। এই বিমানের পাইলটরা ভবিষ্যতে বাংলাদেশ যদি এ-৩২০ বা অন্য মডেলের উড়োজাহাজ কেনে তাহলে সেগুলো চালাতে সক্ষম হবে। তুলুজে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক ব্রিফিংয়ে এয়ারবাসের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, ২০২১ সালে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন ছিল ৪১৬ বিলিয়ন ডলার। ওই সময়ে ভিয়েতনামের ছিল ৩৬৬ বিলিয়ন ডলার এবং ফিলিপাইনের ছিল ৩৯৪ বিলিয়ন ডলার। তখন বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ৭.৫ মিলিয়ন অভিবাসীসহ ১৬৯ মিলিয়ন। আর ভিয়েতনামের জনসংখ্যা ছিল ৩.৪ মিলিয়ন অভিবাসীসহ মোট ৯৭ মিলিয়ন। ফিলিপাইনের ৬.১ মিলিয়ন মোট ১১৪ মিলিয়ন। অথচ বাংলাদেশে এখন ১০টি ওয়াইডবডি মোট এয়ারক্রাফটের সংখ্যা মাত্র ৩৬টি। অপরদিকে ভিয়েতনামে ৩৫টি ওয়াইডবডিসহ মোট এয়ারক্রাফট ১৮৭টি। ফিলিপাইনে ২৯টি ওয়াইডবডিসহ মোট ১৭২টি এয়ারক্রাফট রয়েছে। সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অব বাংলাদেশের (সিএএবি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলো ২০২২ সালে ৯.৬৩ মিলিয়ন আন্তর্জাতিক যাত্রী পরিচালনা করেছিল যা ২০১৯ সালে ৮.৫৯ মিলিয়ন ছিল। দিনে দিনে এই সংখ্যা আরও বাড়বে। ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে বিমান ভ্রমণ দ্বিগুণ হবে। অথচ রাষ্ট্রীয় ক্যারিয়ার বিমানসহ দেশের এয়ারলাইন্সগুলো এই সুবিধা ভোগ করতে পারছে না। এই সুযোগে বাংলাদেশি যানবাহনের বেশিরভাগই বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো দখলে নিয়েছে।