মজুরি বাড়ানোর দাবিতে পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভে গতকাল মঙ্গলবারও উত্তাল ছিল রাজধানীর পল্লবী, গাজীপুর ও সাভার। উত্তেজিত শ্রমিকরা বেশ কিছু পোশাক কারখানা ভাঙচুর করেছে। কয়েকটি কারখানায় দেওয়া হয় আগুন। শুধু গাজীপুরেই আড়াই শতাধিক যানবাহন ভাঙচুর করেছে শ্রমিকরা। দিনভর চলতে থাকে শ্রমিকদের এমন তাণ্ডব। এরই মধ্যে ওই এলাকার প্রায় সব কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। গাজীপুর মহানগরের ভোগড়া বাইপাস, মালেকের বাড়ি, বোর্ডবাজার, নাওজোড় ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কোনাবাড়ী, মৌচাক, তেলিরচালা, সফিপুর, পল্লী বিদ্যুৎ, চন্দ্রা, কালিয়াকৈর-নবীনগর সড়কের বাড়ইপাড়া এলাকায় দফায় দফায় পুলিশ-শ্রমিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ দুই শতাধিক টিয়ার গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। এ ছাড়া গতকাল রাজধানীর মিরপুরের পল্লবীতে শ্রমিকরা রাস্তায় অবরোধ ও যানবাহনে ভাঙচুর চালিয়েছে। পোশাককর্মীদের অভিযোগ, পূরবী সিনেমা হলের কাছে ইপিলিয়ন নামে একটি পোশাক কারখানার আন্দোলনরত কর্মীদের ওপর হামলা করেছে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মী। তাদের কেউ কেউ স্থানীয় কাউন্সিলর তাইজুল ইসলাম বাপ্পী ও মহানগর উত্তর যুবলীগ নেতা আওলাদ হোসেন লাক্কুর অনুসারী। ঘটনার সময় লাক্কুর হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গেছে। তবে লাক্কু বলেন, ‘লাইসেন্স করা অস্ত্র আমার কাছে ছিল। কাউকে ভয় দেখানোর জন্য অস্ত্র প্রদর্শন করিনি।’ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অ্যাপোলো নিটওয়্যার, ইপিলিয়ন, ডেকো, কনকর্ডের একাধিক শ্রমিক জানান, মঙ্গলবার সকালে তারা কারখানায় যান। এর পরই বহিরাগত লোকজন অনেক শ্রমিককে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করে। এ সময় হুমকিও দেওয়া হয়। পাশের একটি কারখানার শ্রমিক আন্দোলনে ইপিলিয়নের কর্মীরা যোগ দিতে পারে– এ শঙ্কায় তাদের কর্মস্থল থেকে বের হতে দেওয়া হচ্ছিল না। ওই সময় কারখানার আশপাশ এলাকায় লাঠিসোটা নিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অনুসারীরা শ্রমিকদের ভয় দেখাচ্ছিল। এ নিয়ে ইপিলিয়নের কর্মীরা তাদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় জড়ায়। এর পরই পোশাককর্মীদের ওপর তারা হামলা করে। আহত অন্তত ৫০ জন পল্লবীর ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে আশপাশের বেশ কিছু কারখানার শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আসে। সকাল ১০টা থেকে মিরপুর ১১ নম্বরে ওই এলাকায় লাঠিসোটা নিয়ে সড়ক অবরোধ করে রাখা হয়। দফায় দফায় হয় যানবাহন ভাঙচুর। অনেক শ্রমিকের মাথায় হেলমেট ছিল। কেউ কেউ মুখোশ পরে ভাঙচুরে অংশ নেয়। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পল্লবীর সহকারী পুলিশ সুপার শাহিদুল ইসলাম বলেন, পুলিশ অনেক ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। কেউ অস্ত্র প্রদর্শন করেছে কিনা, জানা নেই। আমরা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখব, আসলে কী ঘটেছে। যুবলীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আওলাদ হোসেন কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেয় না। তাকে নিষ্ক্রিয় রাখা হয়েছে। কারণ, সে ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতি করে। একাধিক পোশাককর্মীর ভাষ্য, ইপিলিয়ন কারখানার শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ করতে কাউন্সিলর বাপ্পী কর্মীদের দিয়ে ভয় দেখান। এই অভিযোগ বিষয়ে ইপিলিয়ন নিটওয়্যার কারখানায় গেলেও ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। গাজীপুর রণক্ষেত্র মাসিক বেতন ন্যূনতম ২৩ হাজার টাকা করার দাবিতে গাজীপুরে বিভিন্ন পোশাক কারখানার হাজার হাজার শ্রমিক গতকালও রাস্তায় নেমে আসে। কোনো কোনো এলাকায় চলে উত্তেজিত শ্রমিকদের তাণ্ডব। ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ইটপাটকেল, সিমেন্টের পিলার ও কলাগাছ ফেলে চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। পুলিশ বক্সে অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি কারখানায় দেওয়া হয় আগুন। অন্তত আড়াইশ যানবাহনে ভাঙচুর চালায় শ্রমিকরা। হাসপাতাল ও রাস্তার পাশের বিভিন্ন দোকানে হামলা ও লুটপাট চালানো হয়। শ্রমিক ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কোনাবাড়ী ও মৌচাকের তেলিরচালা এলাকায় সকাল থেকেই শ্রমিকরা লাঠিসোটা নিয়ে সড়ক অবরোধ করে। এ সময় তারা রাসেল হাওলাদারের হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও মজুরি বাড়ানোর দাবিতে বিক্ষোভ করতে থাকে। পুলিশ শ্রমিকদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে তারা ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। এক পর্যায়ে পুলিশ কয়েক রাউন্ড টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। খবর পেয়ে মৌচাক এলাকার দোকানপাড়, সফিপুর বাজার, পল্লী বিদ্যুৎ এলাকায় শ্রমিকরা লাঠিসোটা নিয়ে সড়কে অবস্থান নেয়। দুপুর ১টার দিকে কোনাবাড়ী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার মধ্যে সিমেন্টের পিলার ও ইট ফেলে শ্রমিকরা অবরোধ করে। ওই সড়কে অন্তত ২০০ মালবাহী ট্রাক, কাভার্ডভ্যানের সামনের কাচ ভাঙে বিক্ষোভকারীরা। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সফিপুর বাজারে ১০-১২ জন পুলিশ দেখে শ্রমিকরা ধাওয়া করলে তারা পাশের তানহা হাসপাতালে অবস্থান নেয়। সেখানে শ্রমিকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে। পরে হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় শ্রমিকরা। এ সময় হাসপাতালের গ্যারেজে থাকা একটি মোটরসাইকেল, অ্যাম্বুলেন্সসহ চিকিৎসকের দুটি প্রাইভেটকার ভাঙচুর করা হয়। পরে মোটরসাইকেলটি সড়কের ওপর এনে আগুন ধরিয়ে দেয় শ্রমিকরা। হাসপাতালের ব্যবস্থাপক গোলাম মোস্তফা দাবি করেন, শ্রমিকরা ক্যাশ থেকে নগদ টাকাসহ প্রায় এক কোটি টাকার মালপত্র ভাঙচুর ও লুট করেছে। খবর পেয়ে পুলিশের যৌথ বাহিনী ঘটনাস্থলে গিয়ে অর্ধশতাধিক টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে শ্রমিকদের সড়ক থেকে সরিয়ে দেয়। এ ঘটনায় সফিপুর বাজারে পুলিশ-শ্রমিকের মধ্যে এক ঘণ্টা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এর আগে শ্রমিকরা বাজার এলাকায় সড়ক অবরোধ করে। তারা ৮-৯টি দোকান ভাঙচুর করে জিনিসপত্র ও নগদ টাকা লুট করে। শ্রমিকরা সফিপুর ফ্লাইওভারের নিচে থাকা একটি পুলিশ বক্সে আগুন দেয়। সকাল পৌনে ১১টার দিকে দ্বিতীয় দফায় মৌচাক বাজার এলাকায় শ্রমিকরা বিক্ষোভ এবং মহাসড়কে ৮-১০টি যানবাহন ভাঙচুর করে। তাদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে শত শত শ্রমিক পুলিশকে ধাওয়া করে। পুলিশ আত্মরক্ষার্থে মৌচাক বাজার এলাকার পুলিশ ফাঁড়িতে অবস্থান নিলে শ্রমিকরা সেখানে হামলা চালায়। এদিকে মৌচাক দোকানপাড় এলাকায় শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। এতে এক দল পুলিশ পিছু হটে একটি কারখানায় আশ্রয় নেয়। এ সময় শ্রমিকরা পুলিশ সদস্যদের এক ঘণ্টা অবরোধ করে রাখে। পল্লী বিদ্যুৎ এলাকায় শ্রমিকরা একটি পণ্যবাহী ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দেয়। কালিয়াকৈর-নবীনগর সড়কে দক্ষিণ চন্দ্রা এলাকায় ওয়ালটন কারখানার সামনে শ্রমিকরা ওয়ালটন প্লাজায় আগুন ধরিয়ে দেয়। পূর্ব চান্দরা এলাকায় ফটিক্স নামক একটি পোশাক তৈরির কারখানায় শ্রমিকরা প্রধান গেট ভেঙে ভেতরে ঢোকে। সেখানে ১৭টি মোটরসাইকেল, দুটি প্রাইভেটকার, একটি মাইক্রোবাস ও শ্রমিক বহনকারী একটি বাসে আগুন দেয়। সাভার থমথমে বেতন বাড়ানোর দাবিতে শ্রমিক বিক্ষোভে সাভার ও আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে মহাসড়ক ও পোশাক কারখানার সামনে মোতায়েন করা হয়েছে বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ। মঙ্গলবার সকালে শ্রমিকরা কারখানায় এলেও তারা কাজ না করে বেরিয়ে যায়। এর পর আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের দুই শতাধিক কারখানায় এক দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা বিভিন্ন কারখানা থেকে বেরিয়ে টঙ্গী-আশুলিয়া সড়কে বিক্ষোভ করে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে আশুলিয়ার নরসিংহপুর এলাকায় নাসা গ্রুপের একটি পোশাক কারখানার প্রধান ফটক ভাঙচুর করে। এর পর শ্রমিকরা মহাসড়ক অবরোধ করে গাড়ি ভাঙচুরে নামে। এতে বাধা দিলে শ্রমিকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে। পরে পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। এ সময় পুলিশ-শ্রমিকসহ অন্তত ৩০ জন আহত হয়। শিল্প পুলিশ-১ এর পরিচালক সরোয়ার আলম জানান, শ্রমিকদের বিভিন্ন মহল থেকে ইন্ধন দেওয়া হচ্ছে। আমরা কারও কারও পরিচয় নিশ্চিত হয়েছি। উচ্ছৃঙ্খল শ্রমিকদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে।