‘খরবটা আসে রাত ৩টায়। ফোন ধইর্যা ওর বাপে দিছে চিক্কর। আমি ভাবছি হয়তো অ্যাকসিডেন্ট করছে নাইম। কিন্তু পোলায় যে পুইড়্যা মরছে এইটা বুঝতে পারি নাই। লাশটা কয়লা হইয়া গেছিল। শেষবার দেখতেও পারি নাই।’ চলমান রাজনৈতিক অবরোধের শুরুতেই ২৯ অক্টোবর আগুন সন্ত্রাসের প্রথম শিকার হন পরিবহণ শ্রমিক নাইম। তিনি ডেমরা-গাবতলী রুটে চলাচলকারী অছিম পরিবহণের হেলপার (চালকের সহকারী) ছিলেন। স্বল্প উপার্জন দিয়ে কোনোমতে ৫ সদস্যের সংসার টেনে নিচ্ছিলেন নাইম। ফলে একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তানের মৃত্যুতে চোখে অন্ধকার দেখছে তার পরিবার। এদিকে রাজনৈতিক অবরোধে এখন পর্যন্ত শুধু ঢাকাতেই পুড়েছে ৪৮টি যাত্রীবাহী বাস। সারা দেশে পুড়েছে ৭২টি। এভাবে একের পর এক যাত্রীবাহী বাসে আগুনের ঘটনায় সংকটে পড়েছে পরিবহণ খাত। ঋণগ্রস্ত পরিবহণ মালিকদের অবস্থা শোচনীয়। এছাড়া রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বের হতে রাজি হচ্ছেন না আতঙ্কিত পরিবহণ শ্রমিকদের অনেকে। রাজনৈতিক আগুনে নিহত পরিবহণ শ্রমিক নাইমের বাড়ি বরিশালের চরমোনাই এলাকার মকরম প্রতাপ গ্রামে। জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মৃত্যুর পর তার পরিবারকে ঢাকায় ডেকে পাঠানো হয়। ২ নভেম্বর ঢাকায় আসেন নাইমের মা পারভিন বেগম। গোয়েন্দা সংস্থা, সরকারের প্রতিনিধি, ডিএমপি কমিশনারসহ অনেকেই কথা বলেন তার সঙ্গে। সহায়তার আশ্বাসও দেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কানাকড়িও পায়নি তার পরিবার। পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া ঠিকানা ধরে বুধবার পারভিনের খোঁজে ডেমরা এলাকায় হাজির হন প্রতিবেদক। স্টাফ কোয়ার্টারসংলগ্ন হোসেন মার্কেটের সামনে থেকে আরও ৩ কিলোমিটার দক্ষিণে হাজিনগর এলাকা। সেখান থেকে হাঁটা পথে স্থানীয় খন্দকার গলি। সেখানে ঢোকার মুখে কয়েক সারি টিনশেডের ঘর। এর একটিতে দেখা মেলে পারভিনের। ঘরের চৌকাঠে বসে ছিলেন তিনি। সাংবাদিক পরিচয় দিলে মোবাইল থেকে নাইমের একটি ছবি বের করেন পারভিন। শুরু হয় তার বুকভাঙা বিলাপ-‘গরিবের সংসার আমার। ওর বাপেও অসুস্থ। ঠিকমতো রিকশা নিয়া বাইর হইতে পারে না। ছোট ভাই দুইটা স্কুলে পড়ে। বড় বোনটার বিয়া দিতে গিয়া ২ লাখ টাকা ঋণ। তাই খায়া না খায়া পোলাডা টাকা বাঁচাইত। মেসে থাকলে ৭-৮শ টাকা বাড়তি খরচ। তাই বাসের মধ্যে ঘুমাইত নাইম।’ আঁচল টেনে চোখ মোছেন পারভিন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘সেদিনও (২৯ অক্টোবর) রাত ১২টা পর্যন্ত বোনের সঙ্গে কথা কইছে নাইম। আমিও কথা কইছি। এরপরই আগুনের খবর। আমরা তো ভাবছি গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করছে। কিন্তু নাইম যে আগুনে পুইড়া কয়লা হইছে হেইটা বুঝবার পারি নাই। ওরে শেষ দেখাটাও ভালো কইর্যা দেখতে পারি নাই। দাফনের দিন আমারে এট্টুখানি দেখাইছে। চেহারা চেনা যায় না। মুখের মাংসগুলাও সব পুইড়্যা গেছে।’ নাইমের ছোট মামা পারভেজও অছিম পরিবহণের গাড়িচালক। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘অবরোধে ট্রিপ নাই। স্টাফ কোয়ার্টার রোডে গাড়ি পার্ক করা। বাসের ভিতরেই ঘুমাইছে নাইম। রাইত তখন ৩টা। হঠাৎ বাসে আগুন। দাউ দাউ কইরা জ্বলতাছে। ঘুমের কারণে পালাইতে পারে নাই সে। আগুনে পোড়া চেহারাটা চেনার উপায় আছিল না।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, সেদিন গাড়িতে নাইমের সঙ্গে রুবেল নামে তার এক বন্ধুও ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু আগুন জ্বলতে দেখে কোনোমতে জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে রুবেল। এতে সে প্রাণে বাঁচলেও আগুনে গুরুতর দগ্ধ হয়। বর্তমানে মিটফোর্ড হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছে। বুধবার সকালে ধলপুর কমিউনিটি সেন্টারের সামনে কথা হয় অছিম পরিবহণের মালিক সাইদুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, আগুন লাগানোর জন্য গাড়িতে গানপাউডার মারা হয়। এ কারণে পুরো বাস পুড়তে ১০ মিনিটও লাগেনি। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, রাত ৩টার দিকে নাইটগার্ড বাসে আগুনের খবর দেয়। সঙ্গে সঙ্গে আমি ৯৯৯-এ ফোন করি। কিন্তু ফায়ার সার্ভিস আসার আগেই সব শেষ। সাইদুর রহমান বলেন, তার নিজেরও অর্থনৈতিক অবস্থা বেশি ভালো নয়। পড়ালেখা বেশিদূর করতে পারেননি। আগে সৌদি আরবে ছিলেন। ২০১৬ সালে দেশে ফিরে অছিম পরিবহণের ৮টি বাস নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। এজন্য প্রায় কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নিতে হয়েছে তাকে। কিন্তু রাজনৈতিক অবরোধে একের পর এক গাড়ি পোড়ানোয় তার অবস্থা খারাপ। এছাড়া যাত্রী সংকটে ব্যবসা প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে। ঢাকা সড়ক পরিবহণ সমিতি বলছে, অবরোধের আগে ২৮ অক্টোবর বিএনপির ডাকা মহাসমাবেশ ঘিরে ১০টি বাস পোড়ানো হয়। একেকটি বাসের মূল্য ন্যূনতম ৩৫ লাখ টাকা করে হলেও এতে ক্ষতির অঙ্ক সাড়ে ৩ কোটি টাকার বেশি। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত বাস মালিকদের জন্য সরকারি সহায়তার আশ্বাস দেওয়া হলেও এখনো অর্থ ছাড় হয়নি। সংশ্লিষ্টরা জানান, এখন পর্যন্ত অবরোধের ৭ দিনে একেকটি কোম্পানির একাধিক বাসও পুড়েছে। এর মধ্যে ৬নং মতিঝিল-বনানী কোচ লিমিটেডের দুটি, মিডলাইন, স্বাধীন, তুরাগ, পরিস্থান ও বসুমতি পরিবহণের বেশ কয়েকটি বাস পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আরও কয়েকটি পরিবহণের বাস ব্যাপক ভাঙচুরের শিকার হয়। এতে ক্ষতির অঙ্ক বিরাট। অবরোধের গাড়ি পোড়ানোয় তুরাগ পরিবহণের মালিক আব্দুর রশিদের কণ্ঠে ক্ষোভ। তিনি বলেন, অফিস-আদালত সবই চলছে। সিএনজি, রিকশা কিছুই থেমে নেই। তাহলে শুধু যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেওয়ার কারণ কী। তার মতে, রাজনৈতিক কর্মসূচি যে কেউ করতেই পারে। কিন্তু বাসে আগুন দিয়ে কর্মসূচি পালন পৃথিবীর আর কোনো দেশে আছে কিনা তার জানা নেই। পরিবহণ মালিকরা বলছেন, আগে হরতাল অবরোধের সময় রাস্তায় গাড়ি নামানো হলে আগুন দেওয়া হতো। কিন্তু এখন পার্ক করা গাড়িতেও আগুন দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া চলন্ত গাড়িতে যাত্রীবেশে উঠে পেছনের সিটে আগুন দিয়ে নেমে যাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। ফলে আগুন সন্ত্রাসীদের ধরা যাচ্ছে না। বাস মালিকরা বলছেন, আগুন সন্ত্রাস প্রতিরোধে নানাবিধ উদ্যোগ নিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশের পক্ষ থেকে গাড়িতে পানি, বালুসহ অগ্নিনির্বাপণ সামগ্রী রাখতে বলা হয়েছে। আগুনের খবর পেলে দ্রুততম সময়ে হাজির হচ্ছে ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু এতে খুব একটা লাভ হচ্ছে না। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গানপাউডার ব্যবহারের কারণে ইঞ্জিনসহ আস্ত একটি বাসের সবকিছু মুহূর্তেই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। আগুন সন্ত্রাসের কারণে প্রকট হচ্ছে যাত্রী সংকট।