দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ খাতেই এ পর্যন্ত এক হাজার ৭১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে। নির্বাচনে পুলিশ, আনসার, র্যাব, বিজিবি ও কোস্টগার্ডের সদস্য মোতায়েন এবং তাদের যাতায়াতের পেছনে এ পরিমাণ টাকা ব্যয় হবে বলে বাহিনীগুলো থেকে নির্বাচন কমিশনকে জানানো হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ৪৩০ কোটি ২৫ লাখ টাকা চেয়েছে পুলিশ। আর আনসার চেয়েছে ৩৬৬ কোটি ১২ লাখ টাকা। ইসিসংশ্লিষ্টরা জানান, নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য মোতায়েন এবং গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা কাজের জন্য এখনো টাকার চাহিদা দেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ওইসব বাহিনীর চাহিদা ধরে এ নির্বাচনে শুধু আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের চাহিদা এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। যদিও পাঁচ বছর আগে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৫৬৫ কোটি টাকা। সূত্র আরও জানায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন খাতে ব্যয় বাড়বে। প্রায় নয় লাখ প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তাকে ভোটগ্রহণের ভাতা বাবদ গত নির্বাচনের চেয়ে এবার দ্বিগুণ টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এছাড়া যাতায়াত বাবদ তারা প্রত্যেকে অতিরিক্ত আরও এক হাজার টাকা করে পাবেন। শুধু ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের ভাতা বাবদ ব্যয় বেড়েছে ২৮০ কোটি টাকা। এগুলোসহ নির্বাচন পরিচালনা খাতে সম্ভাব্য ব্যয় দাঁড়াচ্ছে এক হাজার কোটি টাকার বেশি। এছাড়া নির্বাচনি প্রশিক্ষণ খাতে ব্যয় হচ্ছে আরও ১৩৫ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যয় ধরা হচ্ছে দুই হাজার ৩০০ কোটি টাকার বেশি। যদিও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা ও নির্বাচন পরিচালনা-এই দুই খাত মিলিয়ে ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। পরে তা আরও বেড়েছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে যে পরিমাণ টাকার চাহিদা দেওয়া হয়, সাধারণত তা পুরোপুরি দেওয়া হয় না। নির্বাচনে কোন বাহিনীর কত সংখ্যক সদস্য কয়দিন মাঠে থাকবেন-তার ওপর টাকা বরাদ্দের পরিমাণ নির্ভর করে। গত নির্বাচনেও তাই হয়েছে। তবে এ নির্বাচনে ভোটগ্রহণের ১৫ দিন পর পর্যন্ত প্রয়োজনে মাঠে পুলিশের টহল রাখতে চায় ইসি। এবার আইনশৃঙ্খলা খাতে ব্যয় বাড়ার অনেক কারণের মধ্যে এটিও একটি। আইনশৃঙ্খলা খাতের ব্যয় এখনো চূড়ান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর চাহিদা পাওয়ার পর আমরা বৈঠক করব। ওই বৈঠকে আলোচনা করে যৌক্তিকভাবে বরাদ্দ দেওয়া হবে। তিনি জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চাহিদা এখনো তার হাতে পৌঁছেনি। জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ ৩৯টি রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছিল। সব দল অংশ নেওয়ায় ওই নির্বাচনে সহিংসতাও কম ছিল। এবারের নির্বাচনের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে করণীয় নির্ধারণসংক্রান্ত সভায় তফশিল ঘোষণার পর নির্বাচনের পরিবেশ অবনতির আশঙ্কার কথা জানায় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। সেখানে বলা হয়, নির্বাচন উপলক্ষ্যে কয়েকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচন নিয়ে কর্মসূচি দিচ্ছে। বিএনপিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, বড় কোনো দল নির্বাচনে না এলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও বাড়ানো লাগতে পারে। এছাড়া আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল বাড়তে পারে বলেও সতর্ক করা হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হবে। ইসির ওই কর্মকর্তারা জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোটাদাগে তিনটি খাতে বাজেট ধরা হয়। সেগুলো হচ্ছে-আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, নির্বাচন পরিচালনা ও নির্বাচনি প্রশিক্ষণ। সাধারণত নির্বাচন পরিচালনা খাতের চেয়ে আইনশৃঙ্খলা খাতে দ্বিগুণ বাজেট ধরা হয়। এবারের নির্বাচনি বাজেট ব্যতিক্রম। আইনশৃঙ্খলা ও নির্বাচন পরিচালনা-এই দুই খাতের বাজেট প্রায় সমানে সমান। জাতীয় নির্বাচনে ব্যয় বাড়ার কারণগুলোর বিষয়ে তারা আরও জানান, গতকাল পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নির্বাচনের প্রায় দুইশ খাত-উপখাতে বরাদ্দের হার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এছাড়া গত নির্বাচনের চেয়ে এবার ভোটকেন্দ্র ও কক্ষ বেড়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ৪০ হাজার ১৯৯টি ভোটকেন্দ্র ও দুই লাখ সাত হাজার ৩১৯টি ভোটকক্ষ ছিল। তখন ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ছিলেন ৬ লাখ ৬২ হাজার ১১৯ জন। আর ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছয় লাখ ৮ হাজার। এবার ভোটার বেড়ে যাওয়ায় প্রায় ৪২ হাজার ভোটকেন্দ্র ও দুই লাখ ৬০ হাজার ভোটকক্ষ হিসাবে ধরে সব পদক্ষেপ নিচ্ছে ইসি। এবার ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা প্রয়োজন হবে প্রায় নয় লাখ। একইভাবে ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায়ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য সংখ্যাও বাড়বে। যদিও এ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে কতজন সদস্য মোতায়েন করা হবে সে সংক্রান্ত পরিপত্র এখনো জারি করেনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্থগিত হওয়া কেন্দ্র এবং যারা একাধিক আসনে সংসদ-সদস্য হবেন, তাদের একটি ছাড়া বাকি ছেড়ে দেওয়া আসনে উপনির্বাচন করতে হবে। ওইসব উপনির্বাচনের ব্যয় ধরেই এই হিসাব করা হয়েছে। কোন বাহিনী কত টাকা চেয়েছে : পুলিশ ৪৩০ কোটি ২৫ লাখ টাকা চেয়েছে। গত নির্বাচনে পুলিশ চেয়েছিল ৪২৪ কোটি টাকা। ওই নির্বাচনে তাদের বরাদ্দ দেওয়া হয় ১২৯ কোটি ৫৭ লাখ কোটি টাকা। এবার আনসার ও ভিডিপি চেয়েছে ৩৬৬ কোটি ১২ লাখ টাকা। গত নির্বাচনে এ বাহিনীকে দেওয়া হয় ২৪২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এবার বিজিবি চেয়েছে ১৪৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। গত নির্বাচনে বিজিবি পেয়েছে ৭৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে র্যাব চেয়েছে ৫০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা; যা গত নির্বাচনে ছিল ২২ কোটি ১২ লাখ টাকা। এবার কোস্টগার্ড চেয়েছে ৭৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা, যা গত নির্বাচনে ছিল ২৫ কোটি টাকা। এছাড়া গত নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনীকে ৬৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল। এবার এখনো সশস্ত্র বাহিনীর চাহিদা পাওয়া যায়নি। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তারা দ্বিগুণ টাকা পাবেন : এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তারা টাকার অঙ্কে দ্বিগুণ ভাতা পাবেন। গত নির্বাচনে প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা একদিনের জন্য ৪ হাজার টাকা ভাতা পেয়েছিল। এবার একই কাজের জন্য ২ দিনের ভাতা পাবেন তারা। এই হিসাবে একজন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আট হাজার টাকা, সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ৬ হাজার টাকা ও পোলিং কর্মকর্তারা ৪ হাজার টাকা হারে পাবেন।