আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর জেলা কুষ্টিয়া। এখানকার দুটি সংসদীয় আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন ক্ষমতাসীন জোটের দুই হেভিওয়েট নেতা। রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এ জেলায় বর্তমান এমপিদের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। তৃণমূলের সঙ্গে বিবাদ রয়েছে তাদের। ইউনিয়ন থেকে ওয়ার্ড পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে দ্বন্দ্ব। নির্বাচন সামনে রেখে গৃহদাহ আরও বাড়ছে। বর্তমান এমপিদের বিপক্ষে মনোনয়ন পেতে মাঠে নেমেছেন একাধিক নেতা। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী বলেন, বড় দলে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। তবে নৌকার সঙ্গে কারও কোনো মতপার্থক্য নেই। যিনি নৌকার প্রার্থী হবেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তার সঙ্গেই থাকবেন। অপরদিকে এক সময়ের শক্ত ঘাঁটি কুষ্টিয়ার তিনটি আসনে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত বিএনপি। মনোনয়ন নিয়েও রয়েছে বিরোধ। নেতাদের অভিযোগ, দলের মধ্যে একাধিক ধারা, শীর্ষ নেতাদের মধ্যে কোন্দল ও যোগ্যদের মূল্যায়ন না হওয়ায় সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে বিএনপি। তবে নির্বাচন নিয়ে তেমন একটা ভাবছে না বিএনপির নেতাকর্মীরা। নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবেন না। যদি নির্বাচনের পরিবেশ হয় তবে কেন্দ্রীয় হাইকমান্ডের নির্দেশনা মোতাবেক নির্বাচনি মাঠে নামবেন তারা। এ নিয়ে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি চলছে তাদের। নির্বাচন প্রশ্নে জেলার একটি আসনে জটিলতা না থাকলেও বাকি তিনটি আসনে মনোনয়ন পেতে বিএনপির একাধিক নেতা তৎপরতা চালাচ্ছেন। তবে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সোহরাব উদ্দিন বলেন, দলের মধ্যে গ্রুপিং থাকলেও মনোনয়ন নিয়ে কোনো বিরোধ নেই। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে, দল যাকে মনোনয়ন দেবে, তার পক্ষেই নেতাকর্মীরা মাঠে থাকবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। কুষ্টিয়া-১ (দৌলতপুর) : এ আসনে বহুভাগে বিভক্ত ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। ২০১৮ সালে নির্বাচনের পর থেকে দলের মধ্যে বাড়তে থাকে বিভাজন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এখানে গৃহদাহ আরও বাড়ছে। চার গ্রুপে বিভক্ত আওয়ামী লীগে মনোনয়নপ্রত্যাশীর তালিকা বেশ দীর্ঘ। অপরদিকে এ উপজেলায় স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে একক দাপট নিয়ে চলছে বিএনপি। তবে পুলিশি হামলা-মামলার ভয়ে বর্তমানে বিএনপি নেতাকর্মীরা অনেকটাই নিশ্চুপ। এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন বর্তমান এমপি আকম সরওয়ার জাহান বাদশাহ, সাবেক এমপি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রেজাউল হক চৌধুরী, উপজেলা যুবলীগের সভাপতি বুলবুল আহমেদ টোকেন চৌধুরী, উপজেলা চেয়ারম্যান এজাজ আহমেদ মামুন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক শরীফ উদ্দিন রিমন, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাসানুল আসকর হাসু এবং আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা উপকমিটির সদস্য ড. মোফাজ্জেল হক। বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক এমপি রেজা আহম্মেদ বাচ্চু মোল্লা, উপজেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আলতাফ হোসেন ও সাবেক সভাপতি রমজান আলী। লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করতে চান সাবেক প্রতিমন্ত্রী কোরবার আলীর ছেলে জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার জামিল জুয়েল। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের সম্ভাব্য প্রার্থী জাসদ যুব জোটের কেন্দ্রীয় সম্পাদক শরিফুল কবির স্বপন। কুষ্টিয়া-২ (মিরপুর-ভেড়ামারা) : এ অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসন এটি। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদ মাহবুবউল আলম হানিফ, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও জাতীয় পার্টির (জাফর) কেন্দ্রীয় মহাসচিব আহসান হাবিব লিংকনের মতো হেভিওয়েট নেতা এই আসনের বাসিন্দা। এছাড়া জামায়াতেরও ভোটব্যাংক রয়েছে এ আসনে। গত নির্বাচনে মহাজোটে থাকা হাসানুল হক ইনুর জন্য এ আসনটি ছেড়ে দিয়ে কুষ্টিয়া-৩ আসনে নির্বাচন করে এমপি হন হানিফ। পরে ইনু নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে এমপি হন। এ আসনে এবারও নৌকার মনোনয়ন চাইছেন ইনু। তিনি ছাড়াও নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও একাধিকবার নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান কামারুল আরেফিন, চিকিৎসক নেতা কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ ও বিএমএ কুষ্টিয়ার সাবেক সহসভাপতি অধ্যাপক ডা. ইফতেখার মাহমুদ এবং কুষ্টিয়া নাগরিক কমিটি ও বিএমএ’র সভাপতি অধ্যাপক ডা. এসএম মুসতানজীদ। ধানের শীষের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন-জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক এমপি অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম। জাতীয় নির্বাহী কমিটির দুই সদস্য ব্যারিস্টার রাগিব রউফ চৌধুরী এবং ফরিদা ইয়াসমিন। জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) কেন্দ্রীয় মহাসচিব আহসান হাবিব লিংকন এবং জাতীয় পার্টি (এরশাদ) ডা. শহিদুল ইসলাম ফারুকী প্রার্থী হতে চান। জামায়াতে ইসলামীর মনোনয়নপ্রত্যাশী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির আব্দুল গফুর। কুষ্টিয়া-৩ (সদর) : বর্তমানে এ আসনের এমপি আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ। এবারও তিনি এ আসনের দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী। এ আসনে জেলার কয়েকজন নেতা প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলেও হানিফের মনোনয়ন অনেকটা নিশ্চিত বলে মনে করেন নেতাকর্মীরা। তবে জেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের মাঝে বিভক্তি আছে। এখানকার তৃণমূলেও আওয়ামী লীগের গ্রুপিং বেশ চাঙা। প্রতিটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দুই থেকে তিনটি বলয় রয়েছে। যার ফলে সর্বশেষ ইউনিয়ন নির্বাচনে ১৪টি ইউনিয়নের মধ্যে মাত্র দুটিতে জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ। বাকিগুলোতে ধরাশায়ী হয়েছে নৌকা। জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শেখ হাসান মেহেদী বলেন, কুষ্টিয়া জেলায় উন্নয়ন এখন দৃশ্যমান। দলমত নির্বিশেষে উন্নয়নের সুফল ভোগ করবে কুষ্টিয়াবাসী। দলে মতপার্থক্য থাকবেই, কিন্তু কুষ্টিয়ার উন্নয়নের স্বার্থে মাহবুবউল আলম হানিফের কোনো বিকল্প নেই। বৃহৎ দলে প্রতিযোগিতা থাকেই, কিন্তু প্রতিহিংসার কোনো অবকাশ নেই বলে মন্তব্য এই নেতার। হানিফ ছাড়াও এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও বিএমএ জেলা সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ ডা. এ.এফ.এম আমিনুল হক রতন, প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মাহাতাবুল হক জয়। অপরদিকে এক সময়ের শক্ত ঘাঁটি কুষ্টিয়া সদর আসনে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত বিএনপি। বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন, তিনবারের নির্বাচিত সাবেক এমপি ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সোহরাব উদ্দিন এবং জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন সরকার। লাঙ্গলের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসাবে আছেন জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কৃষক পার্টির সহ-সভাপতি নাফিজ আহম্মেদ খান টিটু। জামায়াতে ইসলামীর সম্ভাব্য প্রার্থী জেলা জামায়াতের সিনিয়র নায়েবে আমির ফরহাদ হুসাইন। কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী-খোকসা) : এ আসনে বর্তমান এমপি ব্যারিস্টার সেলিম আলতাফ জর্জের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতাদের। তিনি ছাড়াও নৌকার মনোনয়ন পেতে মাঠে নেমেছেন দলের হাফ ডজন প্রবীণ নেতা। তারা সবাই এক মঞ্চে একাট্টা হয়ে দাবি তুলেছেন দলের যে কোনো ত্যাগী ও প্রবীণ নেতাকে মনোনয়ন দেওয়ার। তৃণমূল নেতাকর্মীদেরও অভিযোগ এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে দলের প্রবীণ ও ত্যাগী নেতাকর্মীদের মাইনাস করে বিএনপি-জামায়াতের লোকজন নিয়ে রাজনীতি করেন এই সেলিম আলতাফ জর্জ। তাই নির্বাচন সামনে রেখে মনোনয়ন প্রশ্নে এ আসনে আওয়ামী লীগে গৃহদাহ আরও বাড়ছে। তবে সেলিম আলতাফ জর্জ বলেন, আমার সঙ্গে দলের কোনো গ্রুপিং নেই। এখানে সবাই ঐক্যবদ্ধ। একজন ব্যক্তিকে দিয়ে আওয়ামী লীগ বোঝায় না, কোনো ব্যক্তি আমার বিরুদ্ধে থাকতে পারেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠন সবাই আমার সঙ্গে আছে। এমপি সেলিম আলতাফ জর্জ ছাড়াও এ আসনে নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন সাবেক এমপি আবদুর রউফ ও সুলতানা তরুণ, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা সদর উদ্দিন খান, জেলা মুজিব বাহিনীর সাবেক ডেপুটি কমান্ডার, জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জাহিদ হোসেন জাফর এবং কুমারখালী উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মান্নান খান। বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন-দুবারের নির্বাচিত সাবেক এমপি ও জেলা বিএনপির সভাপতি সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমী এবং কুমারখালী পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক নুরুল ইসলাম আনসার প্রামাণিক। জাতীয় পার্টির (এরশাদ) মনোনয়নপ্রত্যাশী খোকসা উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি আরিফুল ইসলাম এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল থেকে সম্ভাব্য প্রার্থী জাসদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রোকনুজ্জামান রোকন। এছাড়া জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হচ্ছেন পৌর জামায়াতের আমির সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আফজাল হুসাইন।