দেশের ব্যাংক খাতের অবস্থা ভুয়া ঋণের কারণে এখন খুবই নাজুক। বিশেষ করে বেনামি ঋণ কয়েক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। তাই যাচাই-বাছাই ছাড়া নতুন ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক থাকার দাবি জানিয়েছে সরকারের ছয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এক্ষেত্রে সংস্থাগুলো গ্রাহকের একক মোবাইল নম্বর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দিয়েছে। একক মোবাইল নম্বর ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে কেউ নতুন করে ভুয়া ঋণ নিতে পারবে না বলে তারা দাবি করছেন। রোববার বিকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সজেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), বিমা নিয়ন্ত্রক ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ), মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ), রেজিস্টার অব জয়েন স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্ম (আরজেএসসি), ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি) ও সমবায় অধিদপ্তর এ পরামর্শ দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে বৈঠকে সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান ও প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, আর্থিক খাতের অনিয়মগুলো সব সময় একক সংস্থার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। এজন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর যৌথভাবে কাজ করার ওপর বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তখন কোনো গ্রাহক একটি সংস্থাকে ফাঁকি দিলেও অন্য সংস্থাগুলো সেই অনিয়ম চিহ্নিত করতে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারবে। সব সংস্থা যৌথভাবে কাজ করতে থাকলে একটা সময়ে অনিয়ম-দুর্নীতি, উচ্চ খেলাপি ঋণ, অর্থ পাচার, আর্থিক কেলেঙ্কারি ইত্যাদি কমে আসবে। সুশাসন ফিরে আসবে আর্থিক খাতে। বেগবান হবে অর্থনীতি। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সভাপতির বক্তব্যে বলেন, দেশের অর্থনীতি এখনও সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এজন্য আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা একটি অন্যতম কারণ। দেশের অর্থনীতিকে আরও বেগবান করতে সংস্থাগুলোকে সমন্বিত করার সময় এসেছে। কারণ কোনো একক সংস্থার পক্ষে পুরো অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। বিএসইসি’র কমিশনার ড. শেখ শামসুদ্দিনের এক প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে গভর্নর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর জন্য বিদ্যমান আইনে মজুরি কমিশন গঠন করার সুযোগ নেই। বাংকের আইনে বেতন কাঠামো থাকলেও কোনো কমিশন সম্ভব নয়। এটা করতে হলে অর্থ মন্ত্রণালয় বা সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির এক্সিকিউটিভ ভাইস চেয়ারম্যান (ইভিসি) মো. ফসিউল্লাহ বলেন, আলোচনায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। তার মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আইনের সীমাবদ্ধতা সংস্কার ও সংশোধনীর বিষয়গুলো অন্যতম। এগুলো বাস্তবায়ন হলে আর্থিক খাত আরও শক্তিশালী হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, আলোচনা সভাটি ছিল নিয়মিত বৈঠকের অংশ। এখানে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী পরিচালকদের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। এপ্রিল-জুন সময়ে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। ফলে জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। এই খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। যদিও আইএমএফ ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে দেশে পুনঃতফশিল করা ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। সুতরাং বাংলাদেশ ব্যাংক এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১০ দশমিক ১১ শতাংশ দেখালেও প্রকৃত খেলাপির পরিমাণ অনেক বেশি। এর বাইরেও মামলার কারণে আটকা আছে আরও প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। ফলে সব মিলিয়ে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ হবে ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি, শতাংশ হারে যা প্রায় ৩০ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) পুনঃতফশিল করা ঋণ ও আদালতের স্থগিতাদেশ দেওয়া ঋণকে খেলাপি হিসাবে দেখানোর পক্ষে।