কক্সবাজারবাসীর এক জীবনে অনেক জীবন

প্রকাশিতঃ নভেম্বর ১৫, ২০২৩ | ১০:৩৯ অপরাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

১০ নভেম্বরের রাত। কক্সবাজারের সমুদ্রের ধারে একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছি। ১১ নভেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজারে রেললাইন, আইকনিক রেলস্টেশন, মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দরের চ্যানেল, কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং এলজিইডি নির্মিত বাঁকখালী নদীর উপর ৫৬৫ মিটার দীর্ঘ একটি সেতু উদ্বোধন করবেন। এর সঙ্গে এলজিইডি এবং অন্যান্য সংস্থার আরও প্রায় ১৫টি প্রকল্প/স্কিমের উদ্বোধন/ভিত্তিপ্রস্তর রয়েছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সিনিয়র অনেক সরকারি কর্মকর্তা তখন কক্সবাজারে। সাগরের ধারঘেঁষে গড়ে ওঠা এ রেস্টুরেন্টে তাদের অনেকেই এসেছেন। আমাদের কিছু সহকর্মীও আছেন। এ রেস্টুরেন্টে কয়েকজন গায়ক নিয়ে আসা হয়েছে। মধ্যবয়সি মানুষ বেশি দেখলে যা হয়, গায়করা হারানো দিনের গান শুরু করেন। হারানো দিনের গান থেকে ক্রমেই আধুনিক গানে এগোচ্ছে। একজন আঞ্চলিক গানের অনুরোধ করলেন। গায়ক ‘ওরে সাম্পানওয়ালা’, ‘বুকের ভেতর বান্ধি রাইখুম তোয়ারে’ গানে ফিরে গেলেন। ‘ওরে নীল দরিয়া’, ‘সাগরের তীর থেকে মিষ্টি কিছু হাওয়া এনে’-বাংলা সিনেমার বিখ্যাত গানগুলো গাইতে লাগলেন। আমি স্মৃতির ভেতর বারবার ডুবে যাচ্ছি। ভাসছি, আবার স্মৃতিকাতর হচ্ছি। সাগরপাড়ে বাহারছড়া গ্রামে আমার বেড়ে ওঠা। বাবা ছিলেন পিটিআইর সুপারিনটেনডেন্ট। সাগরপাড়ের কাছাকাছি সরকারি বাসায় থাকতাম। বাসা থেকে বেরিয়ে ২০০ গজ হাঁটলেই পর্যটনের একতলা বেশ কয়েকটি কটেজ ছিল। ৪০০ গজ হাঁটলে পুরোনো হোটেল সায়মন। এখন সেখানে বহুতল ভবন হয়েছে। সাইমনের বেকারিতে রুটি-বিস্কুট আনতে গিয়ে শুটিং পার্টির সঙ্গে দেখা হয়ে যেত। কখনো ভাগ্যক্রমে বড় নায়ক-নায়িকাদের দেখতে পেতাম। বাসার পাশের বড় সড়কটিই ছিল ‘মোটেল রোড’। মোটেল রোডে শীতকালে পিকনিকের বাস আর মাইকের গান শৈশবের একটি বড় অংশজুড়ে থেকে গেছে। সত্তর-আশির দশকে হোটেল-মোটেল ছিল খুবই কম। বিভিন্ন স্কুল-কলেজের পর্যটকরা কক্সবাজারের স্কুল-কলেজের বেঞ্চে রাত পার করতেন। সঙ্গে বাজার-বাবুর্চি, হাঁড়িপাতিল নিয়ে আসতেন। এত কষ্ট করে আসা-তবু সমুদ্রের জলে সব কষ্ট ধুয়েমুছে সমুদ্রের ফেনায় নিজেদের ভেতর-বাইর ভিজিয়ে নেওয়ার চেষ্টা। রেললাইন প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজার নিয়ে তার কৈশোরের গল্প বললেন। বঙ্গবন্ধু জেলের বাইরে থাকলে পরিবার নিয়ে কক্সবাজার আসার চেষ্টা করতেন। ১৯৬১ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রথমবার কক্সবাজার আসেন। ‘মোটেলে’ থাকতেন, মোটেলের সঙ্গে কিচেন ছিল। নিজেরা রান্নাবান্না করে খেতেন। ৬১-এর পর বঙ্গবন্ধুর জেলজীবনের ফাঁকা সময়টায় বাবার সঙ্গে আরও কয়েকবার এসেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্মৃতিতে কক্সবাজার নিয়ে বড় একটা জায়গা আছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আবেগ এবং কক্সবাজারের অমিত সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে দেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের জন্য তার অদম্য আগ্রহ। কক্সবাজার বদলে গেছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরেই। মেরিনড্রাইভ দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের একেকটি বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। সত্তর-আশির দশকে খোলা জিপ-চাঁদের গাড়িতে করে শুটিং পার্টি এবং অ্যাডভেঞ্চারাস পর্যটকরা হিমছড়ি, ইনানির দিকে যেতেন। ৯০-এর দশক থেকে মেরিনড্রাইভ প্রকল্প শুরু হলেও বারবার অগ্রগতি থমকে গেছে। ১৯৯৬-এর সরকারে এসে এবং পরে ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় ইচ্ছায় মেরিনড্রাইভের কাজ শেষ হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘পৃথিবীতে দীর্ঘ সৈকত হয়তো আছে, কিন্তু ৮০ মাইল দীর্ঘ বালুকাময় সৈকত আর নেই। সৈকতের পুরো দৈর্ঘ্যই উপভোগ্য, এমন সৈকত পৃথিবীতে বিরল। জাপানেও দীর্ঘ সৈকতগুলোতে ঘুরেছি। কিন্তু কাদামাটির সৈকত বলে সহজে নামা যায়নি। নেদারল্যান্ডসেও একই অবস্থা। স্পেন, পর্তুগালে বালুকাময় সৈকত আছে, কিন্তু এত দীর্ঘ নয়।’ এ রকম একটা পৃথিবীখ্যাত সৈকত বেলাভূমি। পৃথিবীর কাছে সহজে উন্মুক্ত করার উপায় কী? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে বিমানবন্দর সম্প্রসারিত হয়ে আন্তর্জাতিক হয়েছে। সাগর ছুঁয়ে বিমান নামার স্বপ্ন দ্রুতই বাস্তবায়িত হবে। সাগরের একটি অংশ পুনরুদ্ধার করে রানওয়ে নির্মাণের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। এতদিন বালি দ্বীপ দেখে ভাবতাম-আমরাও কি এরকম পারি না! চীনের দুঃখ যেমন হোয়াংহো, কক্সবাজারের দুঃখ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কপথ। সেই ৮১ সালে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হয়ে ঘর ছাড়ি। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কক্সবাজারের যোগাযোগ ব্যবস্থা এগোচ্ছে না, এ দুঃখ কক্সবাজারবাসীর দীর্ঘদিনের। এ বছরের শুরুর দিকে এ সড়কেই একটা ভয়াবহ দুর্ঘটনায় আহত হয়েছি আমি। আমার মতো অসংখ্য মানুষ প্রতিনিয়তই এ সড়কপথে দুর্ঘটনায় পড়ছেন। অথচ ব্রিটিশরা ১৮৯০ সালেই কক্সবাজারের সঙ্গে রেললাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিল। পাকিস্তান আমলেও আরেকবার পরিকল্পনা হয়েছে, কিন্তু কাজ আর হয়নি। বিগত ১৩৩ বছরের ব্যর্থতাকে জয় করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শক্ত হাতে হাল ধরে এবার কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ উন্মুক্ত করে দিলেন। যে কোনো পর্যটক রাতে ঢাকা থেকে উঠে সকালে আইকনিক রেলস্টেশনে নেমে দেখবেন একটি ঝিনুক তার জন্য আধফোটা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু কক্সবাজার নয়, বিগত ১৫ বছরে রেলপথ সম্প্রসারিত হয়েছে প্রায় সারা দেশে। শুধু বরিশাল যাওয়া বাকি আছে মাত্র। কক্সবাজার শহরটা পূর্ব-পশ্চিম লম্বালম্বি এক সড়কের শহর ছিল। দক্ষিণে পাহাড়, উত্তরে বাঁকখালী নদী। এ শহরটা দিনে দিনে বড় হয়েছে। জনসংখ্যা অনেক বেড়েছে। বাইপাস সড়ক হয়েছে। বসতি ঘন হয়েছে; কিন্তু শহরটি সম্প্রসারিত হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত আগ্রহে বাঁকখালী নদীর উপর খুবই দৃষ্টিনন্দন ৫৬৫ মিটার দীর্ঘ একটি সেতু নির্মাণ করেছে এলজিইডি। এর ডিজাইনও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে দেখে অনুমোদন করেছিলেন। সাগরের মোহনার কাছাকাছি এ ব্রিজ নির্মাণে অনেক চ্যালেঞ্জিং অধ্যায় গেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় এলজিইডি এ অধ্যায়গুলো অতিক্রম করেছে। জাপান সরকারের সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুবই ভালো। একটি ২ মাসের প্রশিক্ষণে ২০০৯ সালে এবং পরে সরকারি কাজে আমি কয়েকবার জাপান এবং জাইকা সদর দপ্তরে গিয়েছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বব্যাপী যে অনন্য ভাবমূর্তি-জাপান এবং জাইকা সদর দপ্তরে তা সহজেই বোঝা যায়। জাইকা এখন মাতারবাড়ী মহেশখালী বদলে দিচ্ছে। কক্সবাজার হয়ে যাচ্ছে দেশের গোটা অর্থনীতির গেম চেঞ্জার। কক্সবাজার পৌরসভায়ও জাইকার সিটি গর্ভন্যান্স প্রকল্প শুরু হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন করছে এলজিইডি ও পৌরসভা। বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ শহরটা বদলে যাবে এবার। আমি প্রায়ই আশ্চর্য হয়ে ভাবি, বিগত ১৫ বছরে দেশটা কীভাবে পালটে গেল! এক জীবনে আমরা যেন পার করলাম অনেক জীবন। আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একজীবনে কোটি কোটি মানুষের জীবনে আশার ফুল ফোটাচ্ছেন। আমাদের স্বপ্ন দেখার সাহস বাড়িয়ে দিচ্ছেন। আমাদের স্বপ্নগুলো জিইয়ে থাক। আবুল মনজুর মো. সাদেক : প্রকল্প পরিচালক, বৃহত্তর চট্টগ্রাম গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প-৩, এলজিইডি