রাজশাহীর এমপি ফজলে হোসেন বাদশার বিরুদ্ধে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) প্রকল্প বরাদ্দে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অস্তিত্বহীন ও ভুঁইফোঁড় বিভিন্ন সংস্থাকে প্রকল্প বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ঘুরেফিরে নামসর্বস্ব একই সংস্থাকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া নিয়ম ভেঙে ওয়ার্কার্স পার্টির নেতাকর্মীরাও বিশেষ বরাদ্দ পেয়েছেন। জনকল্যাণ প্রকল্পের বরাদ্দ লুটপাট করা হয়েছে। ভুঁইফোঁড় ও অনিবন্ধিত সংস্থাগুলোকে বরাদ্দ পেতে এমপি বাদশার ব্যক্তিগত সহকারীকে (পিএ) উৎকোচ দিতে হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারাও বিশেষ সুবিধা নিয়েছেন। তিন অর্থবছরের টিআর প্রকল্পের নথিপত্র পর্যালোচনায় চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। কাছে এসব প্রমাণাদি ও তথ্য সংরক্ষিত রয়েছে। রাজশাহী জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে টিআরের আওতায় এমপি বাদশার প্রকল্প তালিকা সংগ্রহ করা হয়েছে। সর্বশেষ তিন অর্থবছরের তালিকায় দেখা গেছে, ২০১৯-২০, ২০-২১ ও ২১-২২ অর্থবছরে ফজলে হোসেন বাদশা মোট ৪ কোটি ৭৬ লাখ ৫৭ হাজার ৪৯৯ টাকা ৯৭ পয়সায় ৭৮৭টি প্রকল্প দিয়েছেন। এরমধ্যে ১৮৩টি প্রকল্প ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। আর ১২৬টিই হলো নামসর্বস্ব মহিলা সংস্থা। এসব সংস্থার দু-একটি ছাড়া বাকিগুলোর অফিস তো দূরের কথা; একটি সাইনবোর্ডও নেই। সরেজমিন দেখা গেছে, দুর্বার মহিলা সংস্থা নামে মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ে একটি প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা রাজশাহী মহানগরীর বিহাস আবাসিক এলাকায়। অথচ ওই এলাকায় প্রতিষ্ঠানটির কোনো অস্তিত্ব নেই। জানা গেছে, ওই সংস্থাটি একসময় চালাতেন আকলিমা খাতুন নামের একজন নারী। যোগাযোগ করা হলে আকলিমা খাতুন জানান, অনেক দিন ধরে সংস্থাটি চালান না। কোনো অফিস নেই। অথচ সংস্থাটি টিআর কর্মসূচির আওতায় প্রায় প্রতি অর্থবছরেই নগদ টাকা বরাদ্দ পায়। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৪ হাজার, ২০-২১ এ ৪৫ হাজার এবং ২১-২২ অর্থবছরে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ পেয়েছে সংস্থাটি। অনুসন্ধানে এরকম অনেক ভুঁইফোঁড় সংস্থার তথ্য বেরিয়ে এসেছে। যুব মহিলা লীগের এক নেত্রী বলেন, এমপি বাদশার প্রকল্প পেতে হলে গুনতে হয় টাকা। এমপির ব্যক্তিগত সহকারী কামরুল হাসান সুমন টাকা নেন। ওই নারী বলেন, কয়েকবার বরাদ্দ পাইনি। এবার ১০ হাজার টাকা দিয়েছি। আশা করি এবার তালিকায় আমার সংস্থার নাম থাকবে। আরও কয়েকজন নারী সুমনের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ করেছেন। তবে টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বাদশার ব্যক্তিগত সহকারী সুমন বলেন, এসব অভিযোগ সঠিক না। টাকা নিয়ে কাউকে বরাদ্দ দেওয়া হয় না। এ ধরনের অভিযোগ ভিত্তিহীন। ঘুরেফিরে যেসব সংস্থা : কয়েকটি সংস্থা তিন অর্থবছরে সর্বনিম্ন একবার থেকে ছয়বার পর্যন্ত প্রকল্প বরাদ্দ পেয়েছে। রঙের মেলা মহিলা সংস্থা নামের একটি নামসর্বস্ব সংস্থা তিন অর্থবছরে ৩ লাখ ১৭ হাজার টাকা বরাদ্দ পেয়েছে। প্রতি অর্থবছরেই সংস্থাটিকে দুবার করে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ সংস্থাটিরও কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি। পাঁচবার করে অর্থ বরাদ্দ পেয়েছে দুস্থ মহিলা সমাজকল্যাণ সমিতি, পথশিশুদের শিক্ষা নিকেতন, ইচ্ছামতি, উৎসব, গোধুলি, জোনাকী, মেঘালয়, সন্ধ্যাতারা ও সবুজ মহিলা কল্যাণ সমিতি। চারবার করে অর্থ পেয়েছে দুস্থ ও বেকার মহিলা কল্যাণ সমিতি, আলোকিত নারী, করতোয়া, গন্ধরাজ, ডালিয়া, মধুমতি, শতদল ও সোনামনি মহিলা কল্যাণ সংস্থা এবং ষষ্ঠীতলা মহিলা উন্নয়ন সংস্থা। তিনবার করে বরাদ্দ পেয়েছে হস্তশিল্প উন্নয়ন সংস্থা, প্রাথমিক ক্রীড়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মাদল সাংস্কৃতিক সংস্থা, আদিবাসী নারী কল্যাণ সংস্থা, অনন্যা, এসো করি, কৃষ্ণচূড়াফুল, দুর্বার, রংধনু, মীম, সাগরিকা, সুদর্শন, øেহের আঁচল ও হেতেমখাঁ লিচুবাগান মহিলা সংস্থা। দুইবার করে অর্থ বরাদ্দ পেয়েছে আরও ২৮টি নামসর্বস্ব মহিলা সংস্থা। এসব সংস্থার কারও কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না। অফিসও খুঁজে পাওয়া যায়নি। দলীয় নেতাকর্মীদের প্রকল্প : বরাদ্দের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতি অর্থবছরই ওয়ার্কার্স পার্টি এবং সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা বরাদ্দ পেয়েছেন। নামসর্বস্ব সংস্থা ও সংগঠন দেখিয়ে নেতাকর্মীরা এসব বরাদ্দ নিয়েছেন। এর মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টির সহযোগী সংগঠন নারী মুক্তি সংসদকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ লাখ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। শহিদ জামিল আক্তার রতনের স্মৃতি সংসদে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। শহিদ জামিল ব্রিগেড নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কোনো অফিস না থাকলেও কম্পিউটার কেনা বাবদ বরাদ্দ দেখানো হয়েছে ২ লাখ টাকা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বরাদ্দের ক্ষেত্রে সবেচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী পার্টির রাজশাহী মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক দেবাশিষ প্রামাণিক দেবু। কখনো নিজে, কখনো অন্য কাউকে প্রকল্প সভাপতি করে আদিবাসী উন্নয়ন কেন্দ্র, আসাউস, আস্থা নেটওয়ার্ক, অভিযাত্রী ক্লাব, আদিবাসী নারী-শিশু পাচার প্রতিরোধ সংস্থা, আলপনা সংগীত বিদ্যালয়, আস্থা সামাজিক উন্নয়ন সংস্থা, গণশিল্পী সংস্থা, আদিবাসী নারী কল্যাণ সংস্থাসহ বেশকিছু সংস্থার নামে বরাদ্দ নিয়েছেন দেবু। আস্থা নেটওয়ার্ক তিন অর্থবছরে ৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকা, আদিবাসী নারী কল্যাণ সংস্থা ১ লাখ ৯৫ হাজার এবং আসাউস সাড়ে ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছে। অন্য সংস্থাগুলো পেয়েছে ৪৪ হাজার ৫০০ থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত। অভিযোগের বিষয়ে দেবাশিষ প্রামাণিক দেবু বলেন, আমাকে অনেকের জন্য সুপারিশ করতে হয়। আস্থা নেটওয়ার্ক এবং আসাউস ছাড়া আমার কোনো সংস্থা নেই। আমার বিরুদ্ধে বেশি বরাদ্দ এবং সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ সঠিক না। আর বরাদ্দ পাওয়া টাকা নির্দিষ্ট কাজেই ব্যবহার করা হয়েছে। ছাত্রমৈত্রীর রাজশাহী মহানগর সভাপতি ওহিদুর রহমান ওহিও পথশিশুদের শিক্ষা নিকেতন নামে একটি সংগঠনের নামে বারবার টাকা নিয়েছেন। শহরে এ সংগঠনের কোনো কার্যক্রম কখনো দেখা যায়নি। অথচ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ লাখ, ২০-২১ অর্থবছরে ৯৫ হাজার এবং ২১-২২ অর্থবছরে ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা বরাদ্দ পেয়েছে সংগঠনটি। তবে ওহি বলেন, আমাদের স্থায়ী কার্যালয় নেই। তবে পথশিশুদের শিক্ষার উন্নয়নে টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এসব বরাদ্দের বিষয়ে এমপি ফজলে হোসেন বাদশা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ওরা চায়, তাই দিতে হয়।’ বিভিন্ন ভুঁইফোঁড় সংস্থায় বরাদ্দের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেশে এত বড় বড় দুর্নীতি হচ্ছে, এসব বাদ দিয়ে এ সংস্থাগুলোর ব্যাপারে কেন খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। বাদশা দাবি করেন, স্বচ্ছতার সঙ্গে তার দেওয়া প্রকল্পগুলো সংশ্লিষ্টরা বাস্তবায়ন করেনি। তবে সব টাকা লুটপাট হয়ে যায়-এ অভিযোগ সত্য নয়। এ ব্যাপারে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সালাহ উদ্দীন আল ওয়াদুদ বলেন, জনবল সংকটে সবকিছু দেখা যায় না। তবে আমরা চেষ্টা করি যেন নিবন্ধিত ভালো সংগঠন-সংস্থাগুলো টাকা পায়। অনিয়মের অভিযোগ যেহেতু সামনে এসেছে-তাই এবার থেকে প্রকল্প অনুমোদনের সময় আমরা সতর্ক থাকব।