আসছে নতুন বছর থেকে দ্বিতীয়-তৃতীয় এবং অষ্টম ও নবম শ্রেণির নতুন শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে অভিভাবক ও শিক্ষকরা রয়েছেন শঙ্কার মধ্যে। প্রচলিত শিক্ষা কার্যক্রমে নতুনত্ব আনতে গিয়ে শিক্ষা বিভাগ সমালোচনার মুখে পড়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে চারটি শ্রেণির পাঠ্যক্রমে এমন সব বিষয় যুক্ত করা হয়েছে, যা বিদ্যমান উচ্চশিক্ষার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিক নামে যে তিনটি বিভাগের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা পরিচিত, নতুন কারিকুলামে সেই তিনটি বিভাগও তুলে দেওয়া হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী আলাদা কোনো বিভাগ বিভাজন থাকবে না। সব শিক্ষার্থীকেই দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১০টি অভিন্ন বিষয় পড়তে হবে। এছাড়া নতুন শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণির আগের সব পাবলিক পরীক্ষা তুলে দেওয়া হয়েছে। উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে বিভাগ বিভাজন হবে। এতে তিনটি বিষয় সবার জন্যই বাধ্যতামূলক থাকবে। আর নির্বাচিত বিষয়গুচ্ছ (যেমন পদার্থ, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, অর্থনীতি) থেকে একজন শিক্ষার্থী তার আগ্রহ অনুযায়ী যে কোনো তিনটি বিষয় নির্বাচন করতে পারবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন এই কারিকুলামের শিক্ষার্থীরা উচ্চ মাধ্যমিকে গিয়ে বিপাকে পড়বে। শিক্ষক ও অভিভাবকরা দীর্ঘদিন ধরে এ কারিকুলাম বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন। এজন্য অনেককে খেসারতও দিতে হচ্ছে। এমন বাস্তবতায় নতুন শিক্ষা কারিকুলাম বাস্ততবায়ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে বলে মন্তব্য করেছেন অনেক শিক্ষাবিদ। তারা বলছেন, নতুন শিক্ষা কারিকুলাম যেভাবে প্রস্তুত করা হচ্ছে তা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উপযুক্ত নয়। সে ধরনের পরিবেশও তৈরি হয়নি। যেসব দেশের অনুসরণ করে এই কারিকুলাম করা হয়েছে বাংলাদেশ সেসব দেশ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। জোর করে চাপিয়ে দেওয়া সিলেবাস কয়েক বছরের মধ্যেই মুখ থুবড়ে পড়বে বলেও আশঙ্কা তাদের। এদিকে চলতি বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের তিন শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন শেষ পর্যায়ে। এতে নতুন শিখন পদ্ধতি শিক্ষকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, যার জন্য তাদের তেমন কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। স্বল্পমেয়াদি অর্থাৎ মাত্র ৫ দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে তাদের। অধিকাংশ শিক্ষকরাই ৫ দিনে এই কারিকুলামের আগামাথা কিছুই বুঝে উঠতে পারেননি। আগামী বছর অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেণি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শনিবার থেকে শুরু হয়ে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলার কথা ছিল। কিন্তু এক বিজ্ঞপ্তিতে তা স্থগিত করেছে মাধ্যমিক উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। প্রথম পর্যায়ে নিবন্ধনধারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক প্রশিক্ষণ শুরু হওয়ার কথা। আর জানুয়ারিতে সুবিধাজনক সময়ে দ্বিতীয় পর্যায়ে নিবন্ধনবিহীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ হওয়ার কথা। এর আগে ১ ডিসেম্বর থেকে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেণি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা পেছানো হয়েছে। তবে কবে এ প্রশিক্ষণ শুরু হবে তাও নির্দিষ্ট করে কেউ কিছু বলছেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক মো. মজিবুর রহমান বলেন, উন্নত দেশগুলোতে যুগের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা কারিকুলাম পরিবর্তন করা হয়। তাদের অঞ্চলভেদে কারিকুলামও ভিন্ন হয়। কিন্তু আমাদের দেশে একটাই কারিকুলাম। তাই কারিকুলাম তৈরির আগে সারা দেশের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মতামত নেওয়া প্রয়োজন ছিল। সারা দেশের চিত্র ঢাকার মতো নয়। তিনি বলেন, আমাদের প্রত্যন্ত গ্রাম, চরাঞ্চল ও পার্বত্য এলাকা আছে। একেক এলাকার জনগণের একেক ধরনের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা বিদ্যমান। সবাই এটির ভার বহন করতে পারবে না। একটা বোধগম্য বিষয় বাদ দিয়ে অবোধগম্য মার্কিং পদ্ধতি (ত্রিভুজ, বৃত্ত ও চতুর্ভুজ) কেন আনা হলো-প্রশ্ন তোলেন তিনি। তিনি মনে করেন, সম্পূর্ণ প্রস্তুতি না নিয়ে নতুন কারিকুলামটি বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর আগে কোনো কারিকুলাম নিয়ে এত কথা হয়নি। এটি বাস্তবায়নে আমাদের ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়া উচিত। যেভাবে জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, এটি ৫ বছরও টিকবে না, তার আগেই মুখ থুবড়ে পড়বে বলে-যোগ করেন তিনি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক নাসির আহমেদ বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এটা একটা নতুন প্রজেক্ট। আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য এ প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এই শিক্ষা পদ্ধতিতে স্কুলের বাচ্চাদের মেধা ও যোগ্যতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এই শিক্ষাব্যবস্থা অবশ্যই বাতিল করতে হবে। অভিভাবকদের অভিযোগ, ঐতিহ্যগত শিক্ষা কাঠামো থেকে সরে এসে শিক্ষার্থীদের রান্না শেখা, তথ্য অনুসন্ধানে নামে ইউটিউব নির্ভর হওয়া, নাচ-গান, নবান্ন উৎসব, পিঠা তৈরি, সাজসজ্জাসহ অপ্রয়োজনীয় অনেক বিষয়কে শিক্ষাক্রমভুক্ত করা হয়েছে। মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে শিক্ষার্থী কোন বিষয়ে খারাপ করছে, কোন বিষয়ে ভালো করছে, তা জানার ভালো উপায় থাকবে না। নতুন শিক্ষা কার্যক্রমে আঁকাবুঁকিতে ব্যস্ত হয়ে পড়া, বাসায় অ্যাসাইনমেন্টের জন্য দলগতভাবে আড্ডা করাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। শিক্ষার্থীরা বাসায় পড়াশোনা না করে ডিভাইস নিয়ে পড়ে থাকে। তাছাড়া নবম বা দশম শ্রেণির নতুন পাঠ্যক্রমের ভেতরে যতটুকু বিজ্ঞান ও গণিত রয়েছে, তা একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞানের আলাদা আলাদা বইগুলোর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারবে না। এতে শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। ফলে উচ্চশিক্ষা নিতে গিয়েও হিমশিম খাবে তারা। এতে আমাদের সন্তানরা বড় বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার ও ডাক্তার হয়ে উঠতে পারবে না। যদিও শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি মনে করেন, নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে মিথ্যাচার করা হচ্ছে। কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী শিক্ষাক্রমের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমেছেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। রাজধানীর মালিবাগের বাসিন্দা মিজানুর রহমান। এই অভিভাবক বলেন, এই কারিকুলামে নবম শ্রেণিতে সবার জন্য একই টপিক হওয়ায় যারা বিজ্ঞান ও গণিত শিখতে আগ্রহী তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর মাধ্যমে সাধারণ ধারার শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সংকুচিত হবে। শিক্ষাবিদরা আরও বলছেন, এ শিক্ষাক্রম নিয়ে যাদের জানা দরকার সেই শিক্ষকরা জানেন না, অভিভাবকরা জানেন না, সর্বোপরি যাদের জন্য এই ব্যবস্থার প্রবর্তন, সবকিছুর মূলে যে শিক্ষার্থী তারা নিজেরাও জানে না তারা কী পড়ছে, কেন পড়ছে। ফিনল্যান্ডের আদলে করা হয়েছে এই নতুন কারিকুলাম। কিন্তু আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে জীবনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, জীবনমান কোনো দিক থেকেই আমাদের দেশ ফিনল্যান্ডের মতো নয়। জাপান যদি মডেল হয়, জাপানের সঙ্গে কোনো দিক দিয়েই তুলনীয় নয় বাংলাদেশ। ফিনল্যান্ড কিংবা জাপানের ছেলেমেয়েরা দেশের বাইরে সেটেল হওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য থাকে না। আমাদের অভিভাবকরা আতঙ্কিত বোধ করছেন এই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সন্তানরা দেশের বাইরে তাল মেলাতে পারবে কিনা। এই শিক্ষায় শিক্ষিতদের জন্য দেশে এবং বিদেশে চাকরির বাজার প্রস্তুত কিনা।