ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ঢাকা বিমানবন্দর স্টেশনের দূরত্ব প্রায় ১৩ কিলোমিটার। এ পথে প্রতিদিন ১০৮টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করে। সবকটি ট্রেন বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে বিরতি দেয়। শুধু কমলাপুর-বিমানবন্দর রুটে একেকটি ট্রেনে গড়ে ৬০০ জন (আসা-যাওয়া) যাত্রী বিনা টিকিটে ভ্রমণ করেন। প্রতিদিন ১০৮টি ট্রেনে অন্তত ৩২ হাজার ৪০০ (যাওয়া আসা মিলিয়ে অন্তত ৬৪ হাজার) যাত্রী বিনা টিকিটে ভ্রমণ করেন। এ রুটে আন্তঃনগর ৫০ টাকা এবং মেইল ট্রেনের ভাড়া ৪৫ টাকা। এসব যাত্রী প্রতি গড়ে ৪৭ টাকা ৫০ পয়সা ভাড়া আদায় হলে-রোজ ৩১ লাখ টাকা আয় হতো রেলের। অর্থাৎ বছরে রেল হারাচ্ছে ১১২ কোটি টাকা। রেলসংশ্লিষ্টরা বলছেন, উল্লিখিত দুটি স্টেশনে ১৭ থেকে ২২ মিনিটে ট্রেন চলাচল করে। এ রুটে টিকিট চেকিং হয় না। ফলে যুগের পর যুগ বিনা টিকিটে যাত্রী পরিবহণ করে রেলওয়ে রাজস্ব হারাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে রেলওয়ে মহাপরিচালক প্রকৌশলী কামরুল আহসান জানান, রেল সাধারণ মানুষের বাহন। অল্প দূরত্বে প্রচুর মানুষ চলাচল করেন। আমরা দুটি স্টেশন থেকে টিকিট দিচ্ছি। বিনা টিকিটে যাত্রা রোধে আপ্রাণ চেষ্টা থাকলেও তা রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ রুটে আরও কয়েকটি কমিউটার ট্রেন চালু করা হবে। তখন সাধারণ মানুষ নিশ্চয়ই টিকিট কেটে ট্রেনে ভ্রমণ করবেন বলে প্রত্যাশা করি। আইন বা জোর করে টিকিট কাটানো সম্ভব হয় না। এখানে দেশপ্রেম জরুরি। সড়কপথে তো বিনা ভাড়ায় কেউ চড়তে পারে না, তবে ট্রেনে কেন চড়বে। যাত্রীদের মধ্যে মূল্যবোধ থাকা জরুরি। স্টেশন সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন ১০৮টি ট্রন কমলাপুর থেকে ছাড়ার পর অর্ধেকেরও বেশি যাত্রী উঠে বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে। গড়ে একটি ট্রেনে ৭৫০ যাত্রী চলাচল করেন। অর্ধেক যাত্রী বিমানবন্দর থেকে উঠলে কমলাপুর থেকে ৩৭৫ জন যাত্রী নিয়ে ট্রেন ছাড়ে। এ হিসাব শুধু আসন সংখ্যার বিপরীতে। বাস্তবে একেকটি ট্রেন প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি যাত্রী নিয়ে চলছে। অনুরূপভাবে কমলাপুরে প্রবেশের আগে সবকটি ট্রেন বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে বিরতি দেয়। ওই সময় অর্ধেকের বেশি যাত্রী বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে নেমে পড়েন। এক প্রকার ফাঁকা ট্রেনে শত শত বিনা টিকিটের যাত্রী উঠে-কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছে বিনা বাধায় বেরিয়ে পড়ে। কমলাপুর স্টেশনে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা জানান, কিছুক্ষণ পরপর কমলাপুর স্টেশনে ট্রেন আসে। স্টেশন থেকে যাত্রীরা হুড়হুড় করে বেরিয়ে পড়েন। বাহির গেটে নামেমাত্র কয়েকজন টিটিই দাঁড়িয়ে থাকেন। সন্দেহজনক কোনো যাত্রীকে চেকিং করতে গেলে-ওই সময়ের মধ্যে শত শত যাত্রী বেরিয়ে পড়েন। একজন টিটিই জানান, ট্রেন এলে স্রোতের মতো মানুষ বের হন। ফলে ২ শতাংশ যাত্রীর টিকিটও চেক করা সম্ভব হয় না। কমলাপুর-বিমানবন্দর স্টেশন পর্যন্ত কিছু যাত্রী রোজ এবং মাসিক টিকিট কেটে চলাচল করেন। তবে অধিকাংশ যাত্রীই বিনা টিকিটে চড়েন। কমলাপুর বুকিং অফিস সূত্রে জানা গেছে, ৫ ডিসেম্বর ১২ নম্বর কাউন্টার থেকে ঢাকা-বিমানবন্দর স্টেশন পর্যন্ত প্রায় ১৭শ টিকিট বিক্রি হয়। এছাড়া ডিসেম্বর মাসে ৩৫৯, নভেম্বরে ৫০০টি মাসিক টিকিট বিক্রি হয়। প্রতি মাসের ৫ তারিখের মধ্যে ১ হাজার ৫০০ টাকায় মাসিক টিকিট কাটতে হয়। প্রতিদিন ১০৮টি ট্রেন কমলাপুর থেকে ছেড়ে যায়। অর্থাৎ কাউন্টার থেকে যে পরিমাণ টিকিট বিক্রি হয়-তা একটি ট্রেনে চড়া যাত্রীদের সমান। সড়কপথে যানজট ও বেশি ভাড়া এড়াতে দুই স্টেশন হয়ে শত শত যাত্রী ভ্রমণ করছেন। অধিকাংশ যাত্রীই কর্মজীবী। কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন ঘুরে দেখা গেছে, সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত প্রতিটি যাত্রীবাহী ট্রেন ঘিরে শহরতলির যাত্রীদের ভিড়। সবকটি ট্রেন স্টেশন দুটিতে দাঁড়ানোয় একটি ট্রেন আসা মাত্র যাত্রীরা হুড়হুড় করে তাতে উঠে পড়েন। টিকিট কাটার ব্যাপারটি সাধারণ যাত্রীরা কোনোক্রমেই আমলে নেন না। কমলাপুর-বিমানবন্দর রুটে নিয়মিত যাতায়াতকারী বিল্লাল হোসেন জানান, প্রায় ২৩ বছর ধরে এ রুটের ট্রেনে চড়েন। উত্তরায় একটি কোম্পানিতে তিনি চাকরি করেন। তিনি কখনো টিকিট কাটেননি। সমস্যা হলে ৫-১০ টাকা ধরিয়ে দিলেই হয়। শুধু বিল্লাল নন, এমন শত শত মানুষ বিনা টিকিটে কমলাপুর-বিমানবন্দর স্টেশন হয়ে চলাচল করছেন। এ রুটে চলা শাহিন, রোকসানা, হাফিজুর, চঞ্চল, সুকুমার রায়, রাশেদসহ ৫০ জন যাত্রী জানান, স্টেশন দুটিতে টিকিট কাটার ব্যবস্থাও ভালো নয়। কাউন্টারের লাইনে সব সময় ভিড় লেগে থাকে। তাই তারা কখনো টিকিট কাটার চেষ্টা করেননি। রাজশাহী-বিমানবন্দর রুটে চলাচলকারী যাত্রী জোহা করিম জানান, বিমানবন্দর স্টেশনে এক প্রকার জোর করে টিকিট নিয়ে নেয় সংশ্লিষ্টরা। টিকিট দেখিয়ে কেউ যেতে চাইলে তারা বিতর্কে লিপ্ত হন। জানা গেছে, যাত্রীদের কাছ থেকে রাখা ব্যবহৃত টিকিট স্টেশনে আবার বিক্রি হয়। টিটিই, রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের একটি চক্র কমলাপুরগামী যাত্রীদের কাছে এসব টিকিট ১০ টাকা করে বিক্রি করেন। কিছু যাত্রী আত্মসম্মানের ভয়ে এসব টিকিট কেনেন। মাসের পর মাস বিনা বাধায় কমলাপুর স্টেশন পার হতে পারায় তারা ১০ টাকার টিকিটও কাটতে অনীহা প্রকাশ করেন। বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনের এক কর্মকর্তা জানান, যুগের পর যুগ ধরে এমনটা হয়ে আসছে। এ স্টেশন একেবারে উন্মুক্ত। সাধারণ মানুষ খুব সহজে স্টেশনে প্রবেশ করেন। ব্যবহৃত টিকিট খুব একটা বিক্রি হয় না। চক্রের সদস্যরা অবৈধভাবে এক প্রকার জোর করে ১০ টাকা করে টিকিট বিক্রি করেন। এক বুকিং সহকারী জানান, কাউন্টারে ভিড় না থাকলে কমলাপুরগামী যাত্রীদের মধ্যে গুটি কয়েকজন টিকিট কাটেন। এ পথে প্রায় ৯৫ শতাংশ যাত্রী বিনা টিকিটে ভ্রমণ করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর পরপরই প্ল্যাটফর্ম টিকিট বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঢাকা রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফেরদৌস আহমেদ বিশ্বাস বলেন, স্টেশনে টিটিইর সঙ্গে রেলওয়ে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা কাজ করেন। অভিযানে বিনা টিকিটের শত শত যাত্রী আটক করা হয়। এতে বোঝা যায়, কী পরিমাণ মানুষ ট্রেনে বিনা টিকিটে চড়েন। তিনি বলেন, ব্যবহৃত টিকিট আবার বিক্রির অভিযোগ বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সরওয়ার বলেন, কমলাপুর স্টেশন হয়ে প্রতিদিন প্রায় লক্ষাধিক যাত্রী চলাচল করেন। বিনা টিকিটে ভ্রমণ রোধ করতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার পর আউটার থেকে চলন্ত ট্রেনে অনেক যাত্রী উঠেন। রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলী বলেন, রেলে বিনা টিকিটের যাত্রী রোধে প্রায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। একটি মাত্র স্টেশনে বিনা টিকিটের শত শত যাত্রী আটক করা হয়। বিনা টিকিটে ভ্রমণ রোধে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। কিন্তু, অল্প দূরত্বে হাজার হাজার যাত্রী ভ্রমণ করায় টিকিট চেক করা সম্ভব হয় না। প্রবেশের ক্ষেত্রে শতভাগ বেষ্টনি ও টিকিট চেকিং নিশ্চিত করা গেলে রোধ করা সম্ভব।