২০২২ ছিল অনিশ্চয়তার বছর। আর ২০২৩ সাল হচ্ছে অসমতার বছর। আশা ছিল কোভিড-১৯ মহামারির ধ্বংসাত্মক ক্ষয়ক্ষতি থেকে অর্থনীতি স্বাভাবিক গতিতে ফিরে আসবে। কিন্তু যুদ্ধ ও সংঘাত, খাদ্য নিরাপত্তার জটিল হুমকি, ডলার সংকট ও অস্থিতিশীল পণ্যমূল্য, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আরও কঠিন করে তুলেছে পরিস্থিতি। বৈশ্বিক সংকটে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলো। সে সংকট মোকাবিলায় সরকার ঋণ গ্রহণ করছে বেশি। এতে ঋণ ও ঋণের সুদ ব্যয় বেড়ে গিয়ে চাপ সৃষ্টি হয়েছে অর্থনীতিতে। এছাড়া নেতিবাচক ধাক্কা আসছে প্রবৃদ্ধিতে। বাধ্য হয়ে সরকার প্রবৃদ্ধি সংশোধন করছে। আর টানা মূল্যস্ফীতির হার ঊর্ধ্বমুখী বিরাজ করার কারণে বহু মধ্যবিত্ত পরিবারের বাজেট তছনছ হয়েছে। সবমিলিয়ে এ বছর অর্থনীতিতে বড় ছয়টি খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব আঘাত হেনেছে। সার্বিক অর্থনীতি প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সংকটময় সময় পার করছে-এমনটি ভাবার যৌক্তিক কারণ দেখছি না। সাম্প্রতিক সময়ের দু-একটি সমস্যার কথা বাদ দিলে সার্বিকভাবে অর্থনীতি ধারাবাহিকভাবে দৃঢ় অবস্থান বজায় রেখেছে। এ মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি কিছুটা বাড়তির দিকে থাকলেও আমরা সবাইকে সঙ্গে নিয়ে একইভাবে ঘুরে দাঁড়াব। দারিদ্র্যের চাপ : বিশ্বের ১৫৯টি দেশের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে তৈরি করা জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে গত ৩ মাসে ৭ কোটি ১০ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে। মূলত খাদ্য ও জ্বালানির ঊর্ধ্বমূখী মূল্যই এর জন্য দায়ী। এদিকে বাংলাদেশও এ পরিস্থিতিতে টিসিবির মাধ্যমে এক কোটি পরিবারকে স্বল্পমূল্যে কয়েকটি পণ্য সরবরাহ করে আসছে। পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো প্রায় দারিদ্র্য সীমার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। অনেক পরিবারের পক্ষে পণ্যমূল্য ব্যয় মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। তারা পারিবারিক বাজেট কাটছাঁট করে চলছেন। ঋণের চাপ : বৈশ্বিক সংকটের প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতির ওপর। এই সংকট মোকাবিলায় সরকার এ বছর সোয়া লাখ কোটি টাকার বেশি বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করেছে। এর আগে বছরে ঋণ গ্রহণ করা হয়েছিল ১ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে জ্বালানি তেল ক্রয় এবং প্রকল্পের জন্য প্রায় ২৯৮ কোটি (প্রায় ৩ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার ঋণ নিচ্ছে সরকার। সব ঋণই অনমনীয় অর্থাৎ কঠিন শর্তের। এর মধ্যে শুধু জ্বালানি তেল কেনার জন্যই ১৪০ কোটি ডলার ব্যয় হবে। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি এসব ঋণের নয়টি প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছেন অনমনীয় ঋণসংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটির (এসসিএনসিএল) সভাপতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহিবলের (আইএমএফ) ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ৬৮ কোটি মার্কিন ডলার ইতোমধ্যে পাওয়া গেছে। অপরদিকে ঋণ গ্রহণের কারণে সুদ খাতে খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। চলতি অর্থবছরে বিদেশি ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধে বাজেট বরাদ্দের চেয়ে সরকারের ব্যয় প্রায় ১১ শতাংশ বাড়বে। এর মধ্যে সুদ পরিশোধ করা হবে ১৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে-সংকটের মুখে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (আইডিএ) থেকে দরিদ্র দেশগুলো এরই মধ্যে প্রায় ৮৮৯০ কোটি মার্কিন ডলার এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো ৪৪ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার নিয়েছে। অর্থনীতিবিদ এমকে মুজেরি জানান, বর্তমান বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। পাশাপাশি অনেক দ্বিপাক্ষিক ঋণ নেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ ঋণই দীর্ঘমেয়াদি নয়, স্বল্পমেয়াদি। অনেক ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে। ফলে আগামী বছরগুলোতে বিদেশি ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধ ব্যয় বাড়বে। প্রবৃদ্ধিতে ধাক্কা : গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস রিপোর্টে বলা হয়, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, উচ্চ সুদহার, বিনিয়োগ হ্রাস এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রবৃদ্ধি তীব্রভাবে মন্থর হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ এই নেতিবাচক ধাক্কার বাইরে নয়। অর্থ মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নামিয়ে এনেছে। চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। নানা প্রেক্ষাপটে এটি অর্জন সম্ভব হবে না। তাই প্রবৃদ্ধি কমিয়ে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর জানান, প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা হয়েছে, সেটিও উচ্চমানের প্রবৃদ্ধি। তবে সেটি অর্জন নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। কোথা থেকে প্রবৃদ্ধি আসবে জানি না। ভালো খবর কোথাও নেই। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী : অর্থনীতির জন্য এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি। নভেম্বরে গ্রামাঞ্চলে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৬২ শতাংশ, শহরাঞ্চলে ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ উঠেছে। আর জাতীয় গড় মূল্যস্ফীতি উঠেছে ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশে। এটি চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। গ্রামীণ অঞ্চলে উচ্চ মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ উচ্চ খাদ্যমূল্য। যদিও বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ গ্রামে বাস করেন এবং এসব গ্রাম থেকেই সারা দেশের চাল, শাকসবজি, মাছ ও হাঁস-মুরগির বেশিরভাগ সরবরাহ আসে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অনেকেই অন্যান্য পণ্যের ব্যবহার কমাতে বাধ্য হয়েছেন। এতে গ্রামীণ বাজারে পোশাক ও অন্যান্য পণ্যের খুচরা বিক্রিতে প্রভাব পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে বাড়াচ্ছে। অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থ বিভাগ। অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, সরবরাহের ঘাটতি দাম বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। কারণ, কৃষকরা শহর ও শহরাঞ্চলে সরবরাহ করা পণ্য বেশি দামে মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে বিক্রি করে। বিশ্বব্যাংক বলেছে মুদ্রাস্ফীতি মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে মন্দাকালীন দারিদ্র্যের হার আরও বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে, যা এ সংকটকে আরও বাড়িয়ে দেবে। ডলার সংকট ও অস্থিতিশীল মূল্য : ডলার সংকট যেন কোনোভাবেই কাটছে না। এবিবি ও বাফেদার বেঁধে দেওয়া দর অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে সর্বোচ্চ ১১০ টাকা ৫০ পয়সায় রেমিট্যান্স ও রপ্তানির ডলার কিনতে বলা হয়েছে। এর বিপরীতে আমদানিকারকদের কাছে ডলার বিক্রির দর ধরা হয়েছে ১১১ টাকা। কিন্তু বাজারে বেঁধে দেওয়া ডলারের দর কার্যকর হচ্ছে না। ব্যাংকগুলোতে আমদানি ব্যয় পরিশোধের চাপ আছে। তাই আমদানিকারকদের কাছে ডলার বিক্রির আনুষ্ঠানিক দাম ১১১ টাকা হলেও বাস্তবে বিক্রি হচ্ছে ১২২-১২৮ টাকা। কোনো কোনো ব্যাংক নথিপত্রে ১১১ টাকা দেখালেও প্রকৃতপক্ষে দাম রাখছে অনেক বেশি। ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে না দেওয়ার কারণে দেশে রেমিট্যান্স আসা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক নমনীয় হয়ে যে কোনো মূল্যে ব্যাংকগুলোকে রেমিট্যান্স কিনতে উৎসাহিত করে। তাতে কিছুটা সুফল পাওয়া গেছে। অক্টোবরে দেশে পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৯৭ কোটি ৭৫ লাখ ডলারে, যা গত ৪ মাসে সর্বোচ্চ। ১-৬ নভেম্বর প্রবাসী আয় এসেছে ৪৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩৫ শতাংশ বেশি। দ্রব্যমূল্যের রের্কড : মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমান সংঘাত বৃদ্ধি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি বিশ্বের পণ্য বাজারগুলোকে অজানা গন্তব্যের দিকে ঠেলে দিতে পারে। ২০২২-এর তুলনায় ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী পণ্যের দাম প্রায় ২৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। যা মহামারির পরে সবচেয়ে তীব্র হ্রাস। বর্তমান ত্রৈমাসিকে তেলের দাম গড়ে প্রতি ব্যারেল ৯০ ডলার হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০২৪ সালে গড়ে প্রতি ব্যারেল ৮১ ডলারে নেমে আসতে পারে। সরবরাহ বাড়লে পরের বছর কৃষিপণ্যের দাম কমবে এবং ২০২৪ সালে ৫ শতাংশ কমে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০২৫ সালে পণ্যের দাম স্থিতিশীল হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশ্ব পরিস্থিতি এমন হলেও বাংলাদেশের বাজারে এর কোনো প্রভাব নেই। বছরজুড়েই চিনি, পেঁয়াজ, ডিম ও আলুর মূল্য বাড়িয়ে ব্যবসায়ীরা শত শত কোটি টাকা ভোক্তার পকেট কেটে নিয়েছে। বর্তমান শীত মৌসুমে পর্যাপ্ত সবজি উৎপাদন হলেও বাজারে কম মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে না। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা পালটে দিয়েছে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি।