তৃণমূলে মার খাচ্ছে আওয়ামী লীগ

প্রকাশিতঃ ডিসেম্বর ২৭, ২০২৩ | ৭:১১ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের স্বার্থে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মাঠ থেকে সরায়নি আওয়ামী লীগ। এতে নৌকা প্রতীকের দলীয় প্রার্থী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে-বিপক্ষে বিভক্তি হয়ে পড়েছেন নেতাকর্র্মীরা। বেড়েছে অভ্যন্তরীণ সংকট। নির্বাচনের প্রচার শুরুর পর থেকে প্রতিদিনই ঘটছে হামলা-সংঘর্ষের ঘটনা। এতে হতাহতও হচ্ছে অনেক। কোথাও নৌকার প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলা করছে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকরা। আবার কোথাও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা করছে নৌকার সমর্থকরা। আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড থেকে কঠোর হুঁশিয়ারি দেওয়া হলেও বন্ধ হচ্ছে না হামলা-সংঘর্ষের ঘটনা। গত আট দিনে অর্ধশতাধিক সহিংসতার ঘটনায় অন্তত দুই শতাধিক আহত এবং তিনজন নিহত হয়েছেন। গতকালও বিভিন্ন স্থানে হামলা হয়েছে। এই হামলা ও হামলার শিকার দুই পক্ষই আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফলে নির্বাচনি এসব সহিংসতায় তৃণমূলে মূলত মার খাচ্ছে আওয়ামী লীগই। বিশ্লেষকরা বলছেন, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের স্বার্থে দলীয় শৃঙ্খলার বিষয়ে দলের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, নির্বাচন যেন স্বচ্ছ ও শান্তিপূর্ণ হয় বিষয়টি প্রার্থীদেরও অবশ্যই মনে রাখতে হচ্ছে। কারণ আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রতিযোগিতা হবে। সেখান থেকে এলাকার জনপ্রিয় মানুষটিই জনপ্রতিনিধি হয়ে সংসদে আসবেন। কিন্তু দলীয় শৃঙ্খলা যেন কোনোভাবেই লঙ্ঘিত না হয় সেদিকে দলের নেতাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। নির্বাচন কমিশনও সার্বিকভাবে বিষয়গুলো মনিটরিংয়ে রাখবেন বলেও আমি বিশ্বাস করি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের অন্তত ২২৫টিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৩৯১ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী। যাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তাদের মধ্যে আছেন বর্তমান সংসদের এমপি, সাবেক এমপি ও মন্ত্রিসভার সাবেক সদস্য, জেলা ও উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরাও আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের পদধারী নেতাকর্মী। ভোটের মাঠে বিভক্ত এসব কর্মী-সমর্থকরা একে অপরের মুখোমুখি হয়ে সংঘাতে জড়াচ্ছেন। বিশেষ করে যেসব আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী শক্তিশালী সেসব আসনেই সংঘর্ষের ঘটনা বেশি ঘটছে। এতে ব্যক্তির পাশাপাশি দল হিসাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচন ঘিরে এসব বিষয় কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২১ ডিসেম্বর ভার্চুয়ালি জনসভায় যুক্ত হয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমরা এ নির্বাচন উন্মুক্ত করেছি, আমাদের নৌকার প্রার্থীও আছে, স্বতন্ত্র প্রার্থীও রয়েছে এবং অন্য দলের প্রার্থীও রয়েছে। আপনারা জনগণের কাছে যাবেন, জনগণ যাকে ভোট দেবেন তিনি নির্বাচিত হবেন। কেউ কারও অধিকারে হস্তক্ষেপ করবে না। এখানে কিন্তু কোনোরকমের সংঘাত বা মারামারি, কোনো কিছুই আমি দেখতে চাই না। কোনো সংঘাত হলে, সংঘাত যদি আমার দলেরও কেউ করে, তাদের কিন্তু রেহাই নেই। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও একাধিকবার এ বিষয়ে দল ও দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ সহিংসতামুক্ত শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। কোনো প্রকার সহিংসতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। অপরাধ প্রমাণিত হলে সে যেই হোক পড়তে হবে শাস্তির আওতায়। দলীয় কিংবা স্বতন্ত্র কারও প্রতিই কোনো পক্ষপাত করবে না আওয়ামী লীগ। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, আমরা এই বিষয়গুলো দেখছি। এগুলো বন্ধ করার চেষ্টা চলছে। আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদকও (ওবায়দুল কাদের) সাহেবও এটা নিয়ে সবার সঙ্গে কথা বলছেন। এসব ঘটনা বন্ধে তিনি নানা দিকনির্দেশনাও দিচ্ছেন। আশা করছি ২৯ তারিখের পরে এ ধরনের ঘটনা আরও কমে আসবে এবং বন্ধও হয়ে যাবে। এদিকে আওয়ামী লীগের কঠোর হুঁশিয়ারি থাকলেও বন্ধ হচ্ছে না নির্বাচনি সহিংসতার ঘটনা। প্রচার-প্রচারণা শুরুর গত আট দিনে অন্তত অর্ধশতাধিক সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। এতে মৃত্যু হয়েছে অন্তত তিনজনের, আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। ৯ ডিসেম্বর পিরোজপুর-১ আসনের নৌকার প্রার্থী শ. ম. রেজাউল করিম ও স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে আবদুল আউয়ালের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় লালন ফকির নামের একজনের মৃত্যু হয়। ১৯ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ সদর উপজেলার গুতাপাড়া গ্রামে দুপক্ষের সংঘর্ষে আওয়ামী লীগ কর্মী রফিকুল ইসলাম নিহত হন। রোববার মাদারীপুরের কালকিনিতে প্রতিপক্ষের হামলায় মারা যান স্বতন্ত্র প্রার্থী তহমিনা বেগমের সমর্থক ও আওয়ামী লীগের কর্মী এসকেন্দার খাঁ। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে জানা গেছে, গত সোম ও মঙ্গলবার অন্তত দশটি আসনে আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া নির্বাচনি অফিস ও দোকানে আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। এসব ঘটনায় আহত হয়েছে অন্তত অর্ধশত। এর মধ্যে ময়মনসিংহের ভালুকায় স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জেলা আ.লীগের সহসভাপতি এমএ ওয়াহেদের (ট্রাক প্রতীক) ক্যাম্পে হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ওই সময় শাহ আলম দুলাল ওরফে দুলাল নামে এক কর্মীকে মারধর করা হয়। মঙ্গলবার উপজেলার উথুরা ইউনিয়নের চান্দের বাজারে এ ঘটনাটি ঘটে। এর আগে সোমবার জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর নৌকার সমর্থকদের হামলায় ১০ জন আহত হয়েছে। ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ড. আবুল হোসেন দীপু সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পালটা ধাওয়া হয়েছে। এ সময় স্বতন্ত্র প্রার্থী ড. মো. আবুল হোসেন দীপুর (ট্রাক প্রতীক) সমর্থকরা নৌকার অফিসে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেছে। চান্দিনা উপজেলার গজারিয়ায় সোমবার বিকালে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক জহিরুল ইসলাম মুন্সীকে কুপিয়ে আহত করেছে নৌকার সমর্থকরা। এ সময় আরও ৩ জন আহত হয়েছেন। আহত জহিরুল স্বতন্ত্র প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুনতাকিম আশরাফ টিটুর সমর্থক। এদিকে নড়িয়া উপজেলার পাইকপাড়া এলাকায় শরীয়তপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী খালেদ শওকত ও আওয়ামী লীগ প্রার্থী এনামুল হকের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষে উভয়পক্ষের তিনজন আহত হন। নওগাঁর রাণীনগরে বাস টার্মিনাল এলাকায় স্বতন্ত্র ও নৌকার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। উভয়পক্ষের অন্তত দশজন আহত হয়। ফরিদপুর-৩ আসনের ঈশান গোপালপুর ইউনিয়নে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। প্রার্থী শামীম হকের সমর্থকদের ওপর স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের হামলায় নৌকা প্রার্থীর ছয়জন সমর্থক আহত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।