আমদানি ডলারের নির্ধারিত দাম ১১০ টাকা। কিন্তু বাস্তবে এ দামে কোনো ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। গুনতে হচ্ছে ১২৩-১২৪ টাকা। কখনো ১৩০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। এভাবেই দেশের প্রায় সব ব্যাংকে চলছে ডলারের ব্যবসা। হাতে গোনা প্রভাবশালী কয়েকজন ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে কিছুটা কম দামে ডলার কিনতে পারলেও সাধারণ ব্যবসায়ীদের আমদানি দায় পরিশোধে ঘোষিত দামের চেয়ে বেশি দরে ডলার কিনতে হচ্ছে। একইভাবে ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ব্যাংকের কাছ থেকে সুবিধা পেলেও সাধারণ ব্যবসায়ীদের অনেককেই ডলার সংকটের কারণে এলসি খুলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আমদানিকারকরা যখন ঘোষিত দামের চেয়ে ১২-১৩ টাকা, কখনো ১৫-২০ টাকা বেশি দিয়ে ডলার কিনছেন, তখন ব্যাংকারদের দুই সংগঠন মিলে একাধিক দফায় ডলারের ঘোষিত দাম কমিয়েছে। এতে ঘোষণা অনুযায়ী, ডলারের দাম কমলেও বাস্তবে ওই দামে ডলার মিলছেই না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে চলতি মাসে ঋণপত্র খুলতে তারা বেশি সমস্যায় পড়ছেন। এর মধ্যে ঘোষিত দামে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে তাদের। বাড়তি সেই দাম পরিশোধ করা হচ্ছে ভিন্ন উপায়ে। এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ-এর শর্ত অনুযায়ী, চলতি মাসের মধ্যে রিজার্ভে অতিরিক্ত ডলার যোগ করতে হবে। অর্থাৎ ডিসেম্বর শেষে বাংলাদেশকে নিট বা প্রকৃত রিজার্ভ ১৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৭৭৮ কোটি ডলারে উন্নীত করতে হবে। নিট রিজার্ভ এখন ১৬ বিলিয়ন ডলারের কিছুটা বেশি। এ অবস্থায় রিজার্ভ ধরে রাখতে বাজারে ডলারের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) আকার ৭০০ কোটি থেকে কমিয়ে ৩১০ কোটি ডলারে নামিয়ে এনেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ডলার কিনে ডিসেম্বরের শেষ দিনে রিজার্ভ কাক্সিক্ষত পর্যায়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ কারণে তীব্র তারল্য সংকটে থাকা শরিয়াহভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংক থেকে ডলার কিনছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি শীর্ষ ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী বলেন, এখন যাদের ক্ষমতা আছে, তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা উপেক্ষা করে বেশি দামে ডলার কিনে আনছে। যারা বেশি দামে ডলার কিনছে, আমদানির দায় পরিশোধেও তারা বেশি দাম নিচ্ছে। ব্যবসায় প্রভাব খাটানো ব্যাংকগুলোই বেশি করছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্বে সরবরাহব্যবস্থায় সংকট শুরু হয়, দাম বাড়ে বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের। খরচ বাড়ে জ্বালানি ও পরিবহণ খাতে। ফলে দেশে আমদানির জন্য ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়। ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম তখন ৮৬ থেকে বাড়তে শুরু করে, যা এখন ১১০ টাকা। তবে অনানুষ্ঠানিক দাম আরও বেশি। ঠিক এ সময়েই ডলারের দাম নিয়ে নানা পরীক্ষা চালায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোকে এখন ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হলেও তারা এ কাজটি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শে। এক্ষেত্রে বাজার পরিস্থিতি উপেক্ষিত থেকে যায়। ফলে দেখা যায়, গত এক মাসে তিন দফায় ডলারের দাম ১ টাকা কমানো হয়েছে। ব্যাংকগুলো এখন প্রবাসী ও রপ্তানি আয়ে ডলারের দাম ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করছে। বৃহস্পতিবার বিদেশি রেমিট্যান্স হাউজ ট্যাপ সেন্ড ডলার সংগ্রহ করেছে ১২০ টাকা দামে এবং স্মল ওয়ার্ল্ড ১১৭ টাকা ৮০ পয়সায়। সংকটে থাকা কয়েকটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক ও কয়েকটি প্রচলিত ধারার ব্যাংক ১২২ টাকা দরে প্রবাসী আয় কিনছে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে প্রবাসী আয় কেনার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো সরকারের আড়াই শতাংশের প্রণোদনার পাশাপাশি নিজেরাও সমপরিমাণ প্রণোদনা দিচ্ছে। ফলে ডলারের দাম ঘোষিত দরের চেয়ে বেশি পড়ছে, আর আমদানিকারকদের বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে। আমদানিতে ডলারের দাম আনুষ্ঠানিকভাবে ১১০ টাকা হলেও বাস্তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১২৮-১২৯ টাকা দিতে হচ্ছে। আমদানিকারকদের পাশাপাশি রপ্তানিকারকরাও বিপদে পড়ছেন। কারণ, তাদের রপ্তানি আয়ের ডলার অন্যদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। পরে কাঁচামাল আমদানির জন্য তাদেরই আবার বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে। ব্যাংকারদের দুটি সংগঠন ডলারের যে দাম নির্ধারণ করছে, ব্যাংকগুলো সেই দাম অনুসরণ করছে না। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই ডলারের বিনিময় মূল্য বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন। এ বিষয়ে নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ-এর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘ব্যাংক এখন ডলার নিয়ে রমরমা ব্যবসা করছে। কারণ, রপ্তানি ডলারের দাম দিচ্ছে মাত্র ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। আর আমদানি ডলারের দাম রাখছে ১১৫ থেকে ১২৮ টাকা। আমাদের রপ্তানি আয়ের ডলার অন্যদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। এরপর আমাদেরই তা আবার বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। ডলার নিয়ে ব্যাংকগুলো সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। ফলে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ওপর যে ক্ষত তৈরি হচ্ছে, তার দায় কে নেবে? আমরা নিতে পারব না।’ ব্যাংকারদের দুটি সংগঠন ডলারের যে দাম নির্ধারণ করেছে, ব্যাংকগুলো সেই দাম অনুসরণ করছে না। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই ডলারের বিনিময় মূল্য বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন। আইএমএফ-এর পক্ষ থেকেও নমনীয় বিনিময় হার গ্রহণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছাড়তে আগ্রহী নয়। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘যদি ঘোষিত দামের চেয়ে এক টাকা কম-বেশি হতো, তাহলে হয়তো ঠিক ছিল। সমস্যা হলো, পার্থক্যটা অনেক বেশি। এর প্রভাব পড়ছে ভোক্তা পর্যায়েও। এজন্য বাজারের কাছাকাছি দাম ঠিক করতে হবে। বাজারের দামে রিজার্ভ থেকে ডলার কেনাবেচা করা উচিত।’ আইএমএফ এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) ঋণের কিস্তির অর্থ পাওয়ার পর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা বেড়েছে। ১৫ ডিসেম্বর আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার ও এডিবির ঋণের ৪০ কোটি ডলার রিজার্ভে যোগ হয়েছে। মোট বা গ্রস রিজার্ভ বেড়ে এখন হয়েছে ২ হাজার ৬০৪ কোটি ডলার বা ২৬ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। আর আইএমএফ-এর বিপিএম ৬ হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী, রিজার্ভের অঙ্ক ২ হাজার ৬৮ কোটি ডলার বা ২০ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। তবে নিট বা প্রকৃত রিজার্ভ ১৬ বিলিয়ন ডলারের কিছুটা বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি মাসের শেষ কয়েকদিনে বিদেশ থেকে ঋণের আরও অর্থ রিজার্ভে যোগ হবে। পাশাপাশি ব্যাংক থেকে ডলার কিনে রিজার্ভ বাড়ানো হবে। আইএমএফ-এর লক্ষ্য পূরণে এবার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে রিজার্ভ সংরক্ষণ সংক্রান্ত শর্ত পূরণ করতে পারেনি সংস্থাটি। মানি চেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. হেলাল উদ্দিন সিকদার বলেন, ‘ডলার সংকট এখনো কাটেনি। তবুও আমরা নিয়ম মেনেই বিক্রি করছি।’ তবে গলিপথে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অলিগলিতে খুচরা বাজারে যে যা পারছে বিক্রি করছে। সেখানে নিয়মনীতির বালাই নেই। এমন অভিযোগও রয়েছে, ঘুসের বিনিময়ে ডলার মিলছে। কিন্তু স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ডলার পাওয়া যাচ্ছে না।