মাঠে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেই

প্রকাশিতঃ ডিসেম্বর ৩০, ২০২৩ | ৮:১৮ পূর্বাহ্ন
মোঃ রাছেল রানা, প্রধান সম্পাদক

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাঠে আচরণবিধি লঙ্ঘন বন্ধে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের দৃশ্যমান কার্যক্রম নেই বললেই চলে। নির্বাচন কমিশনে পাঠানো তাদের গত কয়েক দিনের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, তিনশ আসনে প্রতিদিন গড়ে ৫০টিরও কম ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রার্থীদের জরিমানা করার ঘটনা দৈনিক কমবেশি ৩০টি। কয়েক জেলায় তাদের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অথচ আচরণ বিধি বন্ধে তিনশ আসনে ৭৫৪ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে রয়েছেন। তবুও প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন আসনে প্রার্থীদের প্রচারে বাধা দেওয়া, প্রতিপক্ষকে মারধর, হুমকি-ধমকি দেওয়াসহ আচরণবিধি লঙ্ঘনের ব্যাপক অভিযোগ ইসিতে আসছে। বিশেষ করে সরকারি দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা প্রতিদিনই নানা ধরনের অভিযোগ করছেন। যদিও আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় দায়ীদের তাৎক্ষণিক মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৬ মাসের জেল ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। ইসি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। আরও জানা গেছে, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের নেতৃত্বাধীন নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি ইসিতে প্রতিবেদনেও দৃশ্যমান কঠোর ব্যবস্থার সুপারিশ খুবই কম রয়েছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় ২৯৬টি শোকজ করেছেন অনুসন্ধান কমিটি। এর মধ্যে ২০১টির ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়েছে। কমিশন মাত্র ৫৭টি প্রতিবেদনের ওপর সিদ্ধান্ত দিয়েছে। এতে কয়েকজনের প্রার্থী ও সমর্থকের বিরুদ্ধে মামলা করতে বলা হয়েছে। বাকিদের সতর্ক করে দায় সেরেছে। অবশ্য আচরণবিধি লঙ্ঘনের কয়েকটি ঘটনার সত্যতা পায়নি কমিটি। তবে অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কুমিল্লা-৬ আসনের আওয়ামী লীগর প্রার্থী আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারকে এক লাখ টাকা এবং একই দলের বরগুনা-১ আসনের প্রার্থী ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। যদিও ইসির জরিমানার রায় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও এ নির্বাচনে বড় ধরনের কোনো আচরণবিধি লঙ্ঘন হচ্ছে না বলে দাবি করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। বৃহস্পতিবার তিনি সাংবাদিকদের বলেন, মাঠপ্রশাসন ও প্রার্থীদের কাছ থেকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের খুব বেশি অভিযোগ আমরা পাইনি। কিছু ক্ষেত্রে সহিংসতা, ধাওয়া-পালটাধাওয়া, পোস্টার ছেঁড়া হয়েছে। কিন্তু মোটাদাগে খুব বেশি ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হয় না। প্রার্থীরা আচরণবিধি লঙ্ঘন করছে এবং সহিংসতা হচ্ছে, কেন মানাতে পারছেন না-এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, নির্বাচনি মাঠে আমরা এক্সটেনসিভ ঘুরে বেড়িয়েছি। প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছি। প্রশাসনের সঙ্গে সভা করেছি। তাদের কাছ থেকে খুব বেশি অভিযোগ আমরা পাইনি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সহিংসতা, কিছু ক্ষেত্রে ধাওয়া-পালটাধাওয়া, পোস্টার ছেঁড়া হয়েছে। কিন্তু মোটাদাগে খুব বেশি ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হয় না। তিনি বলেন, তবে সহিংসতা একেবারে হয়নি, সেকথা বলছি না। আশা করি এটা গ্র্যাজুয়েলি কমে যাবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রচার ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টায় শেষ হচ্ছে। আর ভোটগ্রহণ হবে ৭ জানুয়ারি। এ নির্বাচনে ২৮টি রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে। বিএনপিসহ ১৬টি দল অংশ নেয়নি। নির্বাচনে চূড়ান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এক হাজার নয়শর বেশি প্রার্থী রয়েছেন। নির্বাচনে মূলত আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে বেশি সহিংস ঘটনা ঘটছে। দৃশ্যমান নেই কার্যক্রম : ইসি সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা যেসব ব্যবস্থা নেন তার প্রতিবেদন নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়ে থাকেন। গত কয়েক দিনের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কিছু জেলাতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। বাকি আসনগুলো তাদের তেমন দৃশ্যমান তৎপরতা নেই। ২৬ ডিসেম্বরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ওইদিন আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় ১৩টি আসনের ৩০ প্রার্থীকে ৮৪ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ১৬ জনকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে দণ্ড দেওয়া হয়। এই জেল-জরিমানা দেন চট্টগ্রাম-২, কক্সবাজার-৩, ফেনী-১, ফেনী-৩, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩, লক্ষ্মীপুর-১, লক্ষ্মীপুর-২, লক্ষ্মীপুর-৩, লক্ষ্মীপুর-৪, ফরিদপুর-১, ফরিদপুর-২, ফরিদপুর-৩ ও ফরিদপুর-৪ আসনে নিয়োজিত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। বাকি ২৮৩টি আসনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি। ২৬ ডিসেম্বরের মতো ২৫ ডিসেম্বরও প্রায় একই জেলায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। ২৫ ডিসেম্বর যশোর-১, যশোর-৩, যশোর-৪, যশোর-৫ ও যশোর-৬, খুলনা-১, পিরোজপুর-১, লক্ষ্মীপুর-১, লক্ষ্মীপুর-২, লক্ষ্মীপুর-৩ ও লক্ষ্মীপুর-৪, রাজশাহী-১, রাজশাহী-২ ও রাজশাহী-৫, নাটোরের লালপুর, ও সদর, ফরিদপুর-১, ফরিদপুর-২ এবং ফরিদপুর-৩ আসনের ৩৭ প্রার্থীকে এক লাখ ১৯ হাজার ৬০০ টাকা জরিমানা এবং ৩৪ জনকে দণ্ড দেওয়া হয়। তার আগের দিন ২৪ ডিসেম্বর ২০টি আসনের ২৯ জনকে দুই লাখ ১৭ হাজার ৩০০ টাকা জরিমানা এবং ২০ জনকে দণ্ড দেওয়া হয়। ইসির কর্মকর্তারা জানান, যেসব আসনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা কোনো ব্যবস্থা নেননি, এমন অনেক আসনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এর উদাহরণ হিসাবে তারা বলেন, ২৫ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ-সদস্য প্রার্থী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাটুরিয়া উপজেলার বিভিন্ন স্থানে প্রচার চালানোর সময়ে ব্যক্তিগত গাড়িতে জাতীয় পতাকা ব্যবহার করেন এবং রাষ্ট্রীয় প্রটোকল নেন। এভাবে প্রচার চালিয়ে তিনি আচরণ বিধিমালার ১৪ নম্বর বিধি লঙ্ঘন করেছেন বলে প্রতিবেদন দিয়েছে নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি। অথচ ওইদিন মানিকগঞ্জ জেলার কোনো আসনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা তাদের প্রতিবেদনে ইসিকে জানাননি। একইদিন কুমিল্লা-১১ আসনে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের যুগ্ম সচিব এ কে এম জি কিবরিয়া মজুমদার ওই আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালান; যা আচরণবিধির লঙ্ঘন। এ ঘটনায় তাকে শোকজ করেছে নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি। সতর্ক করে দায়মুক্তি : ইসি সূত্রে জানা গেছে, বুধবার পর্যন্ত সারা দেশে আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘনের ঘটনায় ২৯৬টি শোকজ করেছে নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি। এর বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ প্রার্থী। ওইসব ঘটনায় নির্বাচন কমিশনে ২০১টি তদন্ত প্রতিবেদন পাঠিয়েছে কমিটি। এর মধ্যে মাত্র ৫৭টি প্রতিবেদনের ওপর ব্যবস্থা নিয়েছে কমিশন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শুধু সতর্ক করে অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। যদিও ইসি সচিবালয় বলছে, পর্যায়ক্রমে সব তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এসব প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম-১৬ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী মো. মোস্তাফিজুর রহমান, ঝিনাইদহ-১ আসনের প্রার্থী মো. আব্দুল হাইর বিরুদ্ধে মামলা করতে নির্বাচন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছে ইসি। বেশিরভাগ প্রার্থীদের সতর্ক করে আচরণবিধি লঙ্ঘন থেকে দায়মুক্তি দিয়ে আসছে ইসি। ইসির বক্তব্য কঠোর, পদক্ষেপ নমনীয় : জানা গেছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর এবং প্রচার শুরুর আগে দেশের বিভিন্ন জেলায় গিয়ে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন চার নির্বাচন কমিশনার। ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচনে প্রচার শুরুর পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও চারজন নির্বাচন কমিশনার দেশের বিভিন্ন জেলা সফর করেন। ওই সফরে তারা প্রার্থী, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওইসব বৈঠকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। সর্বশেষ শুক্রবার অনেকটা আকস্মিকভাবে নির্বাচন কমিশনে বৈঠক করেন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান, মো. আলমগীর ও মো. আনিছুর রহমান। ওইদিন বৈঠকের পর নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, কোনো না কোনো জায়গায়, কারও না কারও প্রার্থিতা বাতিল হবে-এইটুকু আভাস দিচ্ছি। শিগগিরই জানতে পারবেন। তিনি বলেন, ২৩ ডিসেম্বর আমরা কিছু কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করেছি। এজন্য আরও কিছু তথ্য-উপাত্ত দরকার, তা চেয়েছি। ওই তথ্য পেলে কিছু কঠোর সিদ্ধান্তে চলে যাব। এরপর আচরণবিধি বারবার লঙ্ঘনের ঘটনায় কুমিল্লা-৬ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার ও বরগুনা-১ আসনের প্রার্থী ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে তলব করে ইসি। বুধবার তাদের বক্তব্য শোনার পর বাহাউদ্দিন বাহারকে এক লাখ টাকা এবং ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে। আরপিওর ৯১(ক)(৬গ) বিধান অনুযায়ী তাদের এ জরিমানা করা হয়। এ দুই প্রার্থীকে অর্থদণ্ড দেওয়ার রায় নিয়ে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের মধ্যেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। ইসির একাধিক কর্মকর্তা শুধু অর্থদণ্ড দিয়ে রায় দেওয়ার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তারা বলেন, আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার ও ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ৯১(ক)(৬গ) ধারায় অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ওই ধারায় অর্থদণ্ড এবং প্রার্থিতা বাতিল উভয়দণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। সেখানে শুধু অর্থদণ্ড দেওয়ার সুযোগ নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, নির্বাচন কমিশন একটি আদালতের মতো। তারা যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইনে প্রার্থিতা বাতিল অথবা জরিমানার কথা বলা আছে। আরপিওর ৯১ ধারা এবং আচরণ বিধিমালার বিধি মিলিয়ে নির্বাচন কমিশন রায় দিয়েছেন। কমিশনের এই এখতিয়ার রয়েছে।