বৈশ্বিক মন্দার নেতিবাচক প্রভাব ও দেশীয় মন্দার কারণে চলতি বছরজুড়েই দেশের বাজারে ডলারের প্রকট সংকট ছিল। চড়া দাম দিয়েও ডলার পাওয়া যাচ্ছিল না। এতে গত এক বছরের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার মানে রেকর্ড অবমূল্যায়ন হয়েছে। ডলারের দামের হেরফেরের কারণে বিভিন্ন হিসাবে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে বিভিন্ন হারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে গত এক বছরের ব্যবধানে টাকার মান কমেছে ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ। ব্যাংকগুলোতে ডলারের দামের হিসাবে অবমূল্যায়ন হয়েছে ২২ শতাংশ। খোলাবাজারে ডলারের দামে অবমূল্যায়ন হয়েছে ১৯ শতাংশ। ডলারের বিপরীতে টাকার মান ওই হারে কমলেও চাহিদা অনুযায়ী বাজারে ডলার মিলছে না। এদিকে ২০২২ সালে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছিল ২১ দশমিক ২১ শতাংশ। বছরের শুরুতে ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা। বছর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৪ টাকা। আলোচ্য সময়ে এর দাম বেড়েছে ১৮ টাকা ২০ পয়সা। ওই সময়ে ডলারের দাম বেশিরভাগ সময়ই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু চলতি বছরের শেষদিকে বেশিরভাগ সময়ই ছিল নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যা এখনো চলমান রয়েছে। দুই বছর ধরেই ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমছে। এর মধ্যে চলতি বছরে সবচেয়ে বেশি কমেছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন আক্রমণ করলে বৈশ্বিক সংকটের শুরু। তখন এর নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও পড়তে শুরু করে। এ হিসাবে গত দুই বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে হয়েছে ২৮ দশমিক ২১ শতাংশ। কিন্তু ব্যাংকগুলোতে ডলার বেচাকেনার গড় হিসাবে অবমূল্যায়ন হয়েছে ৪৪ দশমিক ৫২ শতাংশ। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমার কারণে অর্থনীতিতে বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বৈদেশিক দায়দেনার পরিমাণ বেড়ে গেছে, আমদানি খরচ বেড়েছে। এর প্রভাবে বেড়েছে আমদানি পণ্যের দাম। আমদানি পণ্যের দাম বাড়ায় এর প্রভাব পড়েছে অন্যান্য পণ্যের ওপরও। ডলারের দাম বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সব ধরনের পণ্য পরিবহণ খরচও বেড়েছে। এতে খাদ্যপণ্যসহ সব পণ্যের দাম বেড়েছে। এগুলোর দাম বাড়ার নেপথ্যে সিন্ডিকেটের কারসাজিও কাজ করেছে। একই সঙ্গে কমেছে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা। পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা কমায় মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। চলতি বছরের শেষদিকে এসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ডবল ডিজিট অতিক্রম করেছে। সূত্র জানায়, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ হলে আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এর প্রভাবে দেশের আমদানি ব্যয়ও বেড়ে যায়। ওই বছরের এপ্রিল থেকেই ডলারের দামে প্রভাব পড়তে থাকে। ফলে এপ্রিল থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। যা এখন আরও বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে বাণিজ্যিক পণ্যের আমদানির ক্ষেত্রে আগাম ডলারের সংস্থান ছাড়া ব্যাংকগুলো এলসি খুলছে না। ফলে এসব পণ্যের আমদানি কমে গেছে। একই সঙ্গে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের আমদানিতে ব্যাংকের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকও রিজার্ভ থেকে ডলারের জোগান দিচ্ছে। এভাবে অত্যাবশ্যকীয় আমদানি স্বাভাবিক রাখা হয়েছে। তবে বাণিজ্যিক আমদানিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এদিকে ডলারের দাম ২০২২ সালে মোটামাটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকলে চলতি বছরে অনেক ক্ষেত্রেই তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে মাঝে মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর হয়েছে। কিন্তু এতে বাজারে ডলারের দাম কমলেও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে। একই সঙ্গে খোলাবাজারে ডলারের লেনদেন বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বাজারে আরও অস্থিরতা বেড়েছে। ফলে বছরের শেষদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ অনেকটা শিথিল করেছে। এই শিথিলতার সুযোগ নিয়ে ব্যাংকগুলো নিজেদের চাহিদা মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি দামে ডলার কিনতে থাকে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে রেমিট্যান্স কেনার সর্বোচ্চ দর হচ্ছে ১০৯ টাকা ৭৫ পয়সা। এর সঙ্গে সরকারের আড়াই শতাংশ ও ব্যাংকগুলোর আড়াই শতাংশ প্রণোদনাসহ মোট ৫ শতাংশ প্রণোদনা দিতে পারে। এ হিসাবে রেমিট্যান্সের ডলারের দাম হওয়ার কথা ১১৪ টাকা ৩০ পয়সা। কিন্তু প্রায় সব ব্যাংকই ১২২ থেকে ১২৬ টাকা করে রেমিট্যান্সের ডলার কিনছে। এর কমে বিদেশে এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো রেমিট্যান্সের ডলার বিক্রি করছে না। ফলে ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়ে বাড়তি দামে রেমিট্যান্সের ডলার কিনছে। এসব ডলার গ্রাহকদের কাছে সর্বোচ্চ ১১০ টাকা করে বিক্রি করার কথা। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কেনা ডলার ছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নিজস্ব উদ্যোগে সংগ্রহ করা কোনো ডলার ওই দামে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে আমদানিতে ডলার কিনতে হচ্ছে ১২৪ থেকে ১২৮ টাকা করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি দামে ডলার কেনার নজিরও রয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা বলেছেন, বিদেশে এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো দেশে ডলার সংকটের কথা জানে। এ কারণে তারা ডলারের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। এখন বাড়তি দামে না কিনলে তারা ডলার দিচ্ছে না। ফলে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গিয়ে ডলার সংকট আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে চলতি বছরের শুরুর দিকে প্রতি ডলারের দাম ১০৪ টাকা। এখন তা বেড়ে ১১০ টাকা হয়েছে। এ হিসাবে টাকার মান কমেছে ৬ টাকা বা ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ। কিন্তু বাজারে এই দামে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে প্রতি ডলার কিনতে হচ্ছে ১২৪ থেকে ১২৬ টাকায়। কোনো কোনো ব্যাংক আরও বেশি দামে ডলার কিনছে। গড়ে প্রতি ডলার ১২৬ টাকা বিক্রি হলেও এক বছরে এর দাম বেড়েছে ২২ টাকা। এ হিসাবে টাকার মান কমেছে প্রায় ২২ শতাংশ। বছরের শুরুতে খোলাবাজারে ডলারের দাম ছিল ১০৬ টাকা। বছর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৭ টাকায়। এ হিসাবে টাকার মান কমেছে ২১ টাকা বা ১৯ শতাংশ। গত আগস্টে এর দাম বেড়ে ১৩০ টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর হস্তক্ষেপে ডলারের দাম খোলাবাজারে কিছুটা কমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, ২০২২ সালের জানুয়ারিতে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা। এ হিসাবে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ২৪ টাকা ২০ পয়সা বা ২৮ দশমিক ২০ শতাংশ। ব্যাংকগুলোতে ডলারের দামের হিসাবে অবমূল্যায়ন হয়েছে ৪৪ দশমিক ৫২ শতাংশ। ২০২২ সালের আগস্ট থেকে ডলারের খরচের তুলনায় আয় কম হচ্ছে। ফলে ডলার সংকট বেড়েছে। এই সংকট মোকাবিলায় রিজার্ভ থেকে ডলারের জোগান দেওয়া হয়েছে। এতে রিজার্ভও কমেছে। এক বছরের ব্যবধানে রিজার্ভ কমেছে ৭১২ কোটি ডলার। গত বছরের ডিসেম্বরে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ৩৯৪ কোটি ডলার। বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৮২ কোটি ডলারে। এর আগে ২০২২ সালের আগস্টে রিজার্ভ বেড়ে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৮০৬ কোটি ডলারে উঠেছিল।