মূল্যস্ফীতি হারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার মধ্যেই আজ সোমবার শুরু হচ্ছে নতুন বছর (২০২৪)। এ বছর মূল্যস্ফীতির হার আরও বাড়বে না কমবে তা নিয়ে সর্বত্র হিসাব-নিকাশ চলছে। তবে কিছুটা স্বস্তির খবর হচ্ছে মূল্যস্ফীতির তেজিভাব কমে আসবে। এমন পূর্বাভাস দিয়েছে অর্থ বিভাগসহ বিদেশি একাধিক আর্থিক সংস্থা। এতে দেশের মানুষের জীবনে অনেকটা স্বস্তি নেমে আসবে। একইভাবে নতুন বছরে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যও কমে আসবে। যা মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে নিয়ামক হিসাবে কাজ করবে। অর্থনীতির বড় দুটি উপদানের পূর্ভাবাস ইতিবাচক হিসাবে দেখছে অর্থ বিভাগ। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ও অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এমন পূর্বাভাস মিলছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী নভেম্বর পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে হয়েছে ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। আগের মাস অক্টোবরে সাধারণ মূল্যস্ফীতির এ হার ছিল ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে গড় মূল্যস্ফীতি কমেছে দশমিক ৪৪ শতাংশ। বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে অর্থবছরে ২০২৪-এ গড়ে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ বিরাজ করবে। অর্থাৎ গত নভেম্বর মাসের তুলনায় ৩ দশমিক ০৯ শতাংশ কমবে মূল্যস্ফীতি। অন্যদিকে অর্থ বিভাগ বলছে, ২০২৪ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি বিরাজ করবে ৬ দশমিক ৫ শতাংশের ঘরে। অর্থাৎ বিদ্যমান হার থেকে ২ দশমিক ৯৯ শতাংশ কম। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক’-এ নতুন বছরে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি হবে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। যা বর্তমানের চেয়ে ২ দশমিক ৮৯ শতাংশ নেমে আসবে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে সম্প্রতি বলেন, আমাদের নেওয়া ফিসক্যাল ও মনিটরি পলিসির সুফল শিগগিরই পাওয়া যাবে। তিনি আরও বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সুলভমূল্যে বিক্রয়, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি পরিচালনা, ১ কোটি পরিবারের জন্য ফ্যামিলি কার্ড ছাড়াও নির্দিষ্ট পণ্য অধিক হারে আমদানির সুযোগের মাধ্যমেও মূল্যস্ফীতিকে কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি। এছাড়া সরকারের পরিচালন ব্যয়ে কৃচ্ছ সাধন ও মুদ্রানীতিতে সুদের হার বৃদ্ধি, মুদ্রা বিনিময় হারের প্রত্যাশিত স্থিতিশীলতা স্বল্প সময়ের মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে সহায়ক হবে। একই সঙ্গে এটিও লক্ষণীয়, ব্যাংক উৎস হতে সরকারি ঋণ গ্রহণ কমছে, প্রকারান্তে যা মূল্যস্ফীতি হ্রাস করবে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্য, সারসহ অনেক পণ্যের দাম দ্রুত বাড়তে থাকে। ২০২০ সালে করোনার মধ্যে বিশ্বের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পরিমাপক বিশ্বব্যাংকের পণ্যমূল্য ইনডেক্স ছিল ৬৩ দশকি ১। মাত্র দুই বছরে যুদ্ধের পর ১২৭ শতাংশ বেড়ে ২০২২ সালে ১৪৩ দশমিক ৩ শতাংশে দাঁড়ায়। বিশ্বে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মধ্যেও দেশে ২০২১ সালে ৫ দশমিক ৬ এবং ২০২২ সালে ৬ দশমিক ১ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ধরে রাখা সম্ভব হয়। সে সময় কিন্তু অন্য সব দেশেরই মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে যায়। ইউরোপ-আমেরিকার মতো দেশেও ৮-৯ শতাংশ মূল্যস্ফীতি দেখা গেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তবে বিভিন্ন কারণে সেগুলো কার্যকর হচ্ছে না। আবার কার্যকর হতে কিছু সময় লেগে যাচ্ছে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি, বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে চরম দুর্ভোগে পড়েছে নিম্নআয়ের মানুষ। আর মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনযাত্রার মান কমিয়ে দিয়েছে। কারণ মূল্যস্ফীতির সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হলো এটি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি আরও মূল্যবৃদ্ধির প্রত্যাশা তৈরি করে। দীর্ঘ সময়ে অধিক মূল্যস্ফীতি অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, মূল্যস্ফীতির এই দানবকে শৃঙ্খলিত করার শিকল নিশ্চয় আমাদের হাতে আছে। শ্রীলংকা সেই শৃঙ্খল ব্যবহার করে এই দানবকে বাগে আনতে পারলে আমরা কেন পারব না? ২০০৯ সালে আমাদের মূল্যস্ফীতি বারো শতাংশের মতো ছিল। জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে ছিল। কিন্তু সে সময় আমাদের মুদ্রানীতিকে সংকোচনমূলক করার পাশাপাশি কৃষি ও গার্মেন্টসসহ রপ্তানি খাতকে বাড়তি প্রণোদনা দেওয়া হয়। এতে চাহিদা ও সরবরাহের দিক থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে মূল্যস্ফীতিকে ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে। জ্বালানি তেলের দাম কমবে : ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ও তেল উত্তোলনকারী বড় দেশগুলোর তেল উৎপাদন নিয়ে অনিশ্চয়তার প্রভাব পড়েছে জ্বালানি তেলের বাজারে। চলতি বছর এর প্রভাবে দাম ১০ শতাংশ কমেছে। শুক্রবার ছিল চলতি বছর জ্বালানি তেল কেনাবেচার শেষ দিন। সেদিন ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি শূন্য দশমিক ১৪ শতাংশ বা ১১ সেন্ট কমে ৭৭ দশমিক শূন্য ৪ ডলারে নেমে আসে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সংবাদে বলা হয়েছে, উভয় ধরনের তেলের দাম এ বছর ১০ শতাংশের বেশি কমেছে। ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। বছরের শেষ প্রান্তে অবশ্য দাম কমতে শুরু করে। আগামী বছর তেলের দাম কেমন থাকবে, তা নিয়ে রয়টার্স ৩৪ জন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষক নিয়ে জরিপ করেছে। অংশগ্রহণকারীদের পূর্বাভাস, ২০২৪ সালে ব্রেন্ট ক্রুডের গড় দাম হবে ব্যারেলপ্রতি ৮২ দশমিক ৫৬ ডলার। এর আগে নভেম্বর মাসের জরিপে তারা বলেছিলেন, আগামী বছর গড় দাম ৮৪ দশমিক ৪৩ ডলার হতে পারে। মূলত চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে দাম খুব বেশি বাড়বে না বলে তাদের পূর্বাভাস, যদিও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়লে তেলের দাম বাড়তে পারে। তেলের দাম বাড়াতে ২০২৩ সালজুড়ে ওপেকে ও সহযোগী দেশগুলো দফায় দফায় তেল উৎপাদন হ্রাস করেছে। জরিপে অংশ নেওয়া অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা অবশ্য ওপেকের এই সিদ্ধান্তের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, অর্থাৎ এই দেশগুলো উৎপাদন হ্রাসের অঙ্গীকার কতটা রাখতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বর্তমানে ওপেক ও সহযোগী দেশগুলো দৈনিক গড়ে ৬০ লাখ ব্যারেল তেল কম উৎপাদন করছে, যা বৈশ্বিক সরবরাহের ৬ শতাংশ। বছরের শেষ প্রান্তে এসে গাজায় ইসরাইলের হামলা আরও বেড়েছে। এতে জ্বালানি তেলের দামে প্রভাব পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জ্বালানি কোম্পানিগুলো অবশ্য গত তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রথম তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনের কূপসংখ্যা বাড়িয়েছে বলে জানিয়েছে জ্বালানিবিষয়ক সেবা প্রদানকারী কোম্পানি বেকার হিউজ। তারা বলেছে, ভবিষ্যতে তেলের উৎপাদন বাড়তে পারে।