তখনও নভেম্বর শেষ হয়নি, ঘাসের ডগায় পড়েনি শিশির। সারা দেশের আবহাওয়া বেশ গরম। এ বছর আগাম শীতের আমেজও নেই। শীতের উপহার মধুবৃক্ষ খেজুরগাছ থেকে রস নামানোর জন্য গ্রামাঞ্চলের পরিচিত গাছিরা কেবল বড় কাস্তে বা হাঁসুয়াতে শান দেওয়ার কথা ভাবছেন। কেউ কেউ মালিকের খেজুরগাছ লিজ নেওয়ার জন্য দামদর শুরু করেছেন। ঠান্ডা ও কুয়াশা না পড়লে খেজুরগাছে রসের হাঁড়ি লাগানো হয় না। রস নামানো শুরু হয়নি-অথচ বাজারে নতুন খেজুরের গুড় বিক্রির ধুম পড়ে গেছে। শুধু খেজুর গুড়খ্যাত দেশের বিখ্যাত জেলাগুলোতেই নয়-অনলাইনে নতুন খেজুর গুড় বিক্রির জন্য ছবিসহ বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতা আকর্ষণের চেষ্টা শুরু হয়ে গেছে। সম্প্রতি বাজার থেকে নতুন খেজুর গুড় কিনে এনে বাসায় পায়েস তৈরিও হয়ে গেছে! সেদিন সকালে নাশতার টেবিলে জানানো হলো, নতুন খেজুর গুড় দিয়ে তৈরি পায়েস-খেতে কেমন স্বাদ হয়েছে? সময়ের তাড়া থাকায় সামান্য একটু মুখে দিয়ে শুধু হুঁ-হ্যাঁ করে মাথা নেড়ে অফিসে দৌড়াতে হলো। আমার একজন সহকর্মীর মৌসুমি ফল ও ভেষজ দ্রব্যাদি সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান আছে। তিনি বিভিন্ন ফলবাগান মালিকদের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রাখেন এবং ভেজালমুক্ত পণ্য সরবরাহ করে থাকেন। তাকে এ বছরের নতুন খেজুর গুড়ের কথা বলতেই কিছুটা রেগে গিয়ে সাবধানিবাণী শোনালেন। তা হলো-তিনি অনলাইনে বিজ্ঞাপন দেখে নিজেও নতুন খেজুর গুড় কেনার জন্য অর্ডার করতে তার পরিচিত ‘গাছি’ ব্যবসায়ীর সঙ্গে দুদিন আগে যোগাযোগ করেছিলেন। তিনি তাকে নতুন খেজুর গুড় সম্পর্কে যে তথ্য দিয়েছেন তা বড় ভয়ংকর। তাকে জানানো হয়েছে, একজন গুড় ব্যবসায়ী ইতোমধ্যে ২০ মন নতুন খেজুর গুড় বিক্রি করে মুনাফা করেছেন; কিন্তু তিনি নিজে এ কাজে এখনো হাত দিতে পারেননি। কারণ শীত না পড়ায় ডিসেম্বরের আগে আমাদের এলাকায় খেজুর গাছে রসের হাঁড়ি লাগানো হয়নি। কাজেই ইতোমধ্যে যারা বাজারে নতুন খেজুর গুড় বলে বিক্রি শুরু করেছে, সেগুলো নতুন গুড় নয়। প্রতিবছর খেজুর গুড় তৈরির সময় নালি বা ময়লা-গাদসহ যেসব উচ্ছিষ্ট গবাদিপশুর খাবারের জন্য ড্রাম ভরে রেখে দেওয়া হয়, সেগুলোতেও খেজুর রসের গন্ধ থাকে। সেসব নালিকে পুনরায় চুলায় জ্বাল দিয়ে তার সঙ্গে অতিরিক্ত চিনি, হাইড্রোজ, ফিটকিরি ও নানা ক্ষতিকর কেমিক্যাল মিশিয়ে ‘নতুন খেজুর গুড়’ তৈরি করে বাজারে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তিনি জানালেন, এ অসাধু পন্থায় কেউ ২০ মন বিক্রি করে অবৈধ মুনাফা করলেও তিনি মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য সে অন্যায় কাজ করতে পারেন না। আরেকটি বিষয় হলো, যশোরের শার্শা, মনিরামপুর, চৌগাছা, রাজশাহীর বাঘা, বানেশ্বর, নাটোরের বড়াইগ্রাম, লালপুর, বাগাতিপাড়া, চারঘাট, বৃহত্তর কুষ্টিয়া, ফরিদপুরের বিভিন্ন জায়গায় একইভাবে অসাধু পন্থায় সময়ের আগে রস ছাড়াই নতুন খেজুর গুড় তৈরি করে বাজারে সয়লাব করে দেওয়া হয়েছে। আসল খেজুরের গুড় অনেকটা নরম প্রকৃতির এবং রং বাদামি ও কিছুটা কালচে ধরনের হয়ে তাকে। চিনি মেশালে খেজুর গুড় বেশ শক্ত হয়। ভেজাল গুড়কে হাইড্রোজ, ফিটকিরি দিয়ে পরিষ্কার করে বিষাক্ত রং মিশিয়ে ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। এছাড়া আমাদের দেশে সব জেলায় গ্রীষ্মকালে তালের রস নামানো হয়। সাধারণত ভাদ্র মাসে তালের রস পরিমাণে অনেক বেশি হয়। তালের রস সংগ্রহ করে সেগুলোতে খেজুরের নালি-গাদ গন্ধ ব্যবহার করে তালের গুড়কে খেজুরের গুড় বলে চালিয়ে দেয় অনেক ভেজালকারী। এসব তালের গুড় খুব শক্ত হয়। চিনি মিশিয়ে তালের গুড়ের মিষ্টি বাড়িয়ে তেতো ভাব দূর করা হয়। আমের মৌসুমে একই কায়দায় অনেকে কেমিক্যাল মিশিয়ে আম পাকায় এবং অবৈধ মুনাফা অর্জন করে থাকে। তিনি আরও জানালেন, আজকাল শীত মৌসুমে আগেকার দিনের মতো পিঠা-পুলি, প্যারা সন্দেশ, ক্ষীর-পায়েসে স্বাদ পাওয়া যায় না কেন। এখন প্রাকৃতিক সুগন্ধি চাল নেই, সেই চালের আটাও নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে খেজুর গুড় নকল-ভেজাল করে ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করার প্রতিযোগিতা। তিনি বললেন, বাজার থেকে মাঘের আগে নতুন খেজুর গুড় না কিনতে। কারণ, মাঘ মাসে বেশি শীতে বেশি মিষ্টি খেজুর রস পাওয়া যায় এবং সেই রসের গুড় বেশ ভালো মানসম্পন্ন হয়ে থাকে। কিছুটা কৌতূহলবশত জিজ্ঞাসা করলাম, ওখানে ভোক্তা অধিকারের বাজার তদারকি টিম যান না? এসব অপরাধীকে জেল-জরিমানা করে না? বললেন, এসব ভেজাল গুড় তৈরির সংবাদ পেলে মাঝেমধ্যে যান। কিন্তু যেসব এলাকায় অতি গোপনে ভেজাল গুড় তৈরি হয়, সেখানে তারা পৌঁছাতে পারেন না। জরিমানা করলে ওরা জরিমানা দেয়। কিন্তু তদারকি টিম চলে যাওয়ার পর জরিমানার ঘাটতি পুষিয়ে নিতে পুনরায় বেশি বেশি ভেজাল গুড় তৈরি করতে তৎপর হয়ে পড়ে। কারণ, ওদের মনের মধ্যে প্রতারণার কালিমা ছেয়ে গেছে। কথায় বলে, ‘কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না’। আজকাল সব জায়গায় বিষয়টি এমন হয়ে গেছে। এবার তার কথায় অনেকটা হতাশার ভাব লক্ষ করলাম। আসলে খাদ্য বাজার ভেজাল পণ্যে সয়লাব। ইরি ধানের চাল কয়েকবার কেটে চিকন করে সুগন্ধি মেখে পোলাও চাল, মাছ ও গরুর মাংসে রং ও ফরমালিন, সরিষার তেলে বিষাক্ত রঙের ঝাঁজ, চাল-ডালে কংকর, গুঁড়ো মশলায় ইট-কাঠের গুঁড়া, ফলের মধ্যে ফরমালিন-আরও কত কী মেশানো হচ্ছে! আমরা যাব কোথায়? আর খাব কী? অপরাধীদের জেল-জরিমানা করলেও ভেজাল খাদ্যের কারণে রোগবালাই থেকে মানুষের রেহাই নেই। দেশের মাথা থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সবকিছুতে ভেজালের ছড়াছড়ি। এসব ভেজাল পণ্য কিনতে হচ্ছে অতি চড়া দামে। অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যবাজার দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়ে নিু-আয়ের ক্রেতাদের অর্ধ-পঙ্গু করেছে। আমাদের ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা?’ খেজুরগাছের নতুন রস হাঁড়িতে না পড়তেই যদি বাজারে সেই নতুন রসের গুড় বিক্রির ধুম পড়ে যায়, তাহলে আমরা কতটা নিচে নেমে গেছি তা ভাবতে পারেন? এত মূল্যবান কথা শুনে ভাবলাম, সেই গুড়ের দোকানদার যেহেতু অনেকটা পরিচিত, বাসায় যদি সেই কেনা ভেজাল গুড়ের অবশিষ্ট কিছু থেকে থাকে, তাহলে সেগুলো তাৎক্ষণিক ফেরত দিয়ে আসতে বলব। আর জিজ্ঞাসা করলে বলব-এ বছর তখনও গাছ থেকে নতুন রসই নামেনি, অথচ নতুন গুড় পেয়েছিলেন কীভাবে? হয়তো দোকানদারের মুখে আরও অজানা তথ্য পাওয়া যাবে, যেটা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের চেষ্টায় নীতিগত কাজে লাগতে পারে। কারণ, প্রায় সবকিছুতেই চাতুরী করে নৈতিক অবস্থান থেকে সরে এসে প্রতারণা করা এখন আমাদের মজ্জাগত বিষয়ে রূপ নিয়েছে। এভাবে একটি স্বাস্থ্যহীন, মেধাহীন, নৈতিকতাবিহীন জনগোষ্ঠী বেড়ে উঠতে থাকলে সেসব প্রতারক-চোর-ডাকাত ও তাদের দোসরদের উদ্দেশ্যই চরিতার্থ হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এসব অন্যায়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে দিনদিন নীতি-নৈতিকতাহীন হয়ে পড়বে। তারা ভালো কিছু অনুসরণ করার উৎস খুঁজে পাবে না। তাই তারা মোবাইল যুগেও ঘরের কোনায় আবদ্ধ হয়ে বন্দিজীবন বেছে নিয়েছে। সেখানেও তারা নিরাপদ নয়। আধুনিক ডিজিটাল যুগের মেকি বুদ্ধির জোয়ারে নিজেদের ভাসিয়ে দিয়ে আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে তারা। চারদিকে কৃত্রিমতা ও নকলের হাতছানি তাদের উন্মাদ করে তুলছে। বাড়ছে সীমাহীন নীচতা, স্বার্থপরতা ও ভয়ংকর লোভ-লালসা। কোনো সাবধানিবাণী, এমনকি জেল-জরিমানাও এসব ঠেকাতে পারছে না। অসময়ে ভেজাল খেজুর গুড় তৈরি করা আর জালিয়াতির মাধ্যমে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দুর্নীতিকে অবলম্বন করে একাডেমিক হোক বা কমিশনিক হোক-যে কোনো পরীক্ষায় পাশ করার মধ্যে কার্যত কোনো তফাত নেই। এমন অবস্থা ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকলে সেটার ইতিবাচক সমাধান খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক fakrul@ru.ac.bd