অর্থনীতি আইএমএফে ঋণ করে ঘি খাওয়া যাবে না

প্রকাশিতঃ ফেব্রুয়ারী ৩, ২০২৩ | ১১:৫৭ পূর্বাহ্ন
ড. আবু আহমেদ: অর্থনীতি বিশ্নেষক

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্বাহী ও পরিচালনা পর্ষদে বাংলাদেশের ঋণ প্রস্তাব পাস হয়েছে। বাংলাদেশ পাচ্ছে সাড়ে তিন বছরের জন্য ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার। মোট সাত কিস্তিতে এই অর্থ পাওয়ার কথা। প্রথম কিস্তি ৪৫ কোটি ৪৫ লাখ ৩১ হাজার ডলার পাওয়ার কথা এই ফেব্রুয়ারিতেই। এখন দেশের অর্থনীতির এই ক্রান্তিকালে আইএমএফের ঋণ পাওয়ায় দম পাবে বাংলাদেশ। তবে প্রশ্ন হচ্ছে- এ ঋণে সংকট কতটা কাটবে। সহজে বুঝতে সাহায্য করতে পারে, এমন একটি তুলনামূলক উদাহরণ দিতে পারি। আইএমএফের এই অর্থ বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের বিবেচনায় আড়াই মাসের সমান। এখন এই অর্থ কি সংকট কাটানোর জন্য যথেষ্ট? আর কেনই বা এই সংকট দেখা গেল? ঠিক সময়ে যথাযথ নীতি প্রণয়ন করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়। বলা যেতে পারে, ২০১৯ সালের আমদানি ব্যয় ৪ হাজার ৯০০ কোটি ডলার থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ৮ হাজার ৯০০ কোটি ডলারে উন্নীত হওয়ার পর সরকারের হুঁশ ফিরেছে। এ সময়ে যে শুধু ডলারের দামই বেড়েছে, তা নয়; ডলারের সংকটও দেখা দিয়েছে। এখন সরকার আইএমএফের কাছ থেকে ধার করা অর্থ কীভাবে খরচ করবে ও শোধ করবে, তা আগেই নির্ধারণ করা দরকার। আশার কথা হচ্ছে, আইএমএফ টাকা ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা পেতে কিছু শর্ত দিয়েছে। এটাই তারা করে থাকে। আইএমএফ থেকে অনেক দেশই ঋণ নিয়েছে। কিন্তু সবাই যে উপকৃত- তা বলার সুযোগ নেই। আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়ার পর পরিশোধ করতে গিয়ে অন্য উৎস থেকে ঋণ নিতে হয়েছে অনেক দেশের। এর উদাহরণ পাকিস্তান। ঋণ নিতে হলে আইএমএফ কিছু শর্ত দেয়। এর মধ্যে কিছু শর্ত ঋণগ্রহীতা দেশের প্রতিকূলে যায়। আবার অনেক শর্ত দেশের অর্থনীতির অনুকূলেও থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বাড়ছে। বিদেশি ঋণ আগে জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ ছিল। তা এখন ২০ শতাংশ অতিক্রম করেছে। সম্ভবত সরকার সামনের দিনগুলোতে আরও বেশি ঋণ নেবে। ঋণ নিলে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য ভয়ের কিছু নেই; কিন্তু সমস্যা হতে পারে সামনের দিনগুলোর জন্য। একটি বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে- শেষ বিচারে আইএমএফ নিজেও একটি ঋণ বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান। তারা এমন কোনো দেশকে ঋণ দেবে না, যার অর্থনীতি একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে কিংবা ধ্বংসের প্রান্তে। যাদের পরিশোধ করার সক্ষমতা নেই, তাদের আইএমএফ ঋণ দেয় না। যেমন- শ্রীলঙ্কা; ঋণ চেয়েছিল কিন্তু পায়নি। আজকে আমরা যদি বর্তমান পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিতে পারি, তবে ভবিষ্যতে অর্থনীতি নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আইএমএফ থেকে ঋণ নিলে আমাদের রিজার্ভ একটু শক্তিশালী হবে সাময়িক সময়ের জন্য। কিন্তু এর আরেকটি দিক হচ্ছে, দেশের ভাবমূর্তি। এর মাধ্যমে বাইরে এমন বার্তা যাবে- বাংলাদেশের অর্থনীতি বোধ হয় বিপদে আছে। তবে শুধু আইএমএফের ঋণের প্রশ্ন নয়। সার্বিকভাবে ভর্তুকি নিয়ে চিন্তাভাবনা করা উচিত। সরকারের চিহ্নিত করা উচিত, কোন খাতে ভর্তুকি কতটুকু যৌক্তিক এবং কোথায় কোথায় ভর্তুকি বেশি হচ্ছে। আবার সরকারের নীতি দুর্বলতা বা ব্যর্থতার বিষয়ও রয়েছে। বিদ্যুৎ না কিনেও হাজার হাজার কোটি টাকা দিতে হয়েছে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলোকে। এগুলো থেকে আমাদের নিস্কৃতি পাওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। আইএমএফের অর্থ পাওয়ার প্রধান শর্তের দিকে যদি আমরা দেখি, তিন খাতের সংস্কার করতে হবে। আইএমএফের ভাষায় এগুলো হচ্ছে, গুণগত মান উন্নয়ন-সংক্রান্ত শর্ত, অবকাঠামোগত মান উন্নয়ন-সংক্রান্ত শর্ত ও সাধারণ প্রতিশ্রুতি। এখন এই শর্ত মেনে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা; বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব পদ্ধতি ঠিক করা; জিডিপির তুলনায় অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহের হার বৃদ্ধি করতে হবে। এ ছাড়া জ্বালানির মূল্য নির্ধারণে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে কার্যকর; আয়কর আইন সংসদে পাস; ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন; কর ছাড়ের ওপর বিশদ নিরীক্ষা; সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ ইত্যাদির নিশ্চয়তা রাখতে হবে। এগুলোর মধ্যে কিছু বিষয় আমরা এখনই দেখতে পাচ্ছি। গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন এই চাপটি গিয়ে পড়বে জনসাধারণের ওপর। কারণ জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব তাদেরই ভোগ করতে হবে। এখন আমরা যদি ভালো দিকের প্রতি দৃষ্টিপাত করি, তাহলে বলা যায়- এই ঋণের ভালো প্রভাব আছে। এখন এই ঋণটা দরকার। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপে ছিল। তা ছাড়া এই ঋণের সঙ্গে কিছু রিফর্মস (সংস্কার) আসবে। এসব সংস্কার বাংলাদেশের জন্য দরকার ছিল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমরা আত্মতুষ্টিতে ভুগি। রিজার্ভ যখন বেড়ে গেল, আমরা বেসরকারি খাতকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ করে দিলাম। তারা অনেক টাকা ঋণ করে ফেলেছে। আমাদের ১৭ বিলিয়ন তো স্বল্পমেয়াদি ঋণ। আমাদের নীতিনির্ধারক ও আমলারা আত্মতুষ্টিতে ভোগেন। এখন যদি এই ঋণ পেয়ে তাঁরা গা-হাত-পা ছেড়ে দেন; মনে করেন, আমরা তো পার হয়ে গেছি, তাহলে বাংলাদেশ আবারও বিপদে পড়ে যাবে। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, আইএমএফের ঋণ আমরা কী কাজে ব্যবহার করব? ঋণ পরিশোধ, বিদেশ থেকে পণ্য, কাঁচামাল আমদানিসহ আন্তর্জাতিক প্রায় সব ধরনের লেনদেনে রিজার্ভে থাকা বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহার করা হয়। ফলে রিজার্ভের পরিমাণ কমে গেলে আমদানি বাধাগ্রস্ত হয়। এতে অর্থনীতির গতি কমে যায়। এ ছাড়া রিজার্ভ কমে গেলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধেও বিলম্ব হতে পারে। এসব কাজে এই অর্থ ব্যবহার করা যাবে। এখন আইএমএফ বলছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে দাঁড়াবে ৩০ বিলিয়ন বা ৩ হাজার কোটি মার্কিন ডলারে। তবে আগামী অর্থবছর থেকে ধারাবাহিকভাবে তা বাড়বে। ২০২৬-২৭ অর্থবছর শেষে দেশের রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ৫০ বিলিয়ন ডলার বা ৫ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এ সবই সম্ভাবনা, যদি সঠিকভাবে পরিচালনা করা যায়; যদি অর্থ পাচার রোধ করা যায়। ঋণের অর্থ চলে এলে যেন আমাদের দায়িত্ববানরা আরও সচেষ্ট থাকেন- সেটাই কাম্য। নইলে ঋণ পেয়ে উদ্ধারের বদলে উল্টো ঘটনাও ঘটতে পারে।